Ajker Patrika

উন্নয়নশীল দেশে রক্ত স্বল্পতা রোধে ফর্টিফায়েড চা ও লবণ কতটা সফল

উন্নয়নশীল দেশে রক্ত স্বল্পতা রোধে ফর্টিফায়েড চা ও লবণ কতটা সফল

ধারণা করা হয় বিশ্বব্যাপী দুইশ কোটিরও বেশি মানুষ খাবারের গৌণ উপাদানের (মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট) অভাবে ভুগছে। এ গৌণ উপাদানগুলো হলো খাবারে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ। সুস্বাস্থ্যের জন্য খাবারে এসব ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের উপস্থিতি জরুরি। পরিমিত ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের অভাব স্বাস্থ্যের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। 

শিশুদের মধ্যে ভিটামিন এ–এর ঘাটতি দেখা দিলে প্রতিরোধযোগ্য অন্ধত্বের সৃষ্টি হতে পারে; রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য জরুরি উপাদান হলো জিংক; এবং আয়রনের ঘাটতি থেকে হতে পারে রক্তশূন্যতা। শিশুদের মধ্যে রক্তশূন্যতা দেখা দিলে তাদের বুদ্ধি ও শারীরিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। বুদ্ধির বিকাশের ফলে শিশুরা বুঝতে শেখে, ভাবতে শেখে ও চারপাশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে শেখে। শারীরিক বিকাশের সঙ্গে শিশুর বেড়ে ওঠা, হাঁটতে শেখা, বসতে শেখা, দৌড়াতে শেখা, ভারসাম্য করতে শেখা ইত্যাদি জড়িত।       

বেশ কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশেই রক্তাল্পতা চরম আকার ধারণ করেছে। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য দেশগুলো সুষম খাদ্য নিশ্চিত করার মাধ্যমে গৌণ উপাদান ঘাটতি রোধ করার প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করতে একটি রেজ্যুলেশন গ্রহণ করেছে। 

কানাডার ওন্টারিওতে অবস্থিত টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লেভেন্তে ডায়োস্যাডি ও তাঁর দল দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে খাদ্য প্রকৌশল পরীক্ষাগারে লবণে আয়রন ও আয়োডিন মেশানোর চেষ্টা করছেন। এর আগে এ নিয়ে ভারতের প্রাথমিক গবেষণা সফল হয়েছিল এবং সম্প্রতি আফ্রিকায়ও বেশ কয়েকটি প্রকল্পে ভালো ফলাফল এসেছে।     

ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যে ২০০৪ সালে একটি জরিপ চালানো হয়। ওই জরিপে অংশ নেওয়া ৩৫ লাখ শিশুর মধ্যে ৮৫ শতাংশই রক্তাল্পতা ভুগছিল। এদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ শিশুই আট মাস পর সুস্থ হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে তাদের আট মাস পর্যন্ত স্কুলের মিডডে মিলে আয়রন ও আয়োডিন সমৃদ্ধ লবণে তৈরি খাবার খেতে দেওয়া হয়।  

তখন থেকেই উত্তরপ্রদেশ রাজ্য সরকার ২ কোটি ৪০ লাখ নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে এ লবণ বিতরণের জন্য ৪ কোটি ডলার ব্যয় করেছে। ভারতে অন্যান্য রাজ্যগুলোতেও এ নিয়ে তাদের নিজস্ব পরিকল্পনা আছে বলে সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। 

অধ্যাপক লেভেন্তে ডায়োস্যাডি বলেন, ‘এখন ভারতে প্রায় ৫ থেকে ৬ কোটি মানুষ আয়রন ও আয়োডিন সমৃদ্ধ খাবার খাচ্ছে, যা বেশ ভালো কথা। আমরা যখন প্রথম তামিলনাড়ুতে পরীক্ষা চালাই, তখন অপ্রত্যাশিতভাবেই তা সফল হয়। এতে জনপ্রতি খরচও বেশ নগণ্য হয়। প্রতি বছর, জনপ্রতি ২৫ সেন্টের মতো খরচ হয়।’  

লবণের প্রতি ডায়োস্যাডির আগ্রহ ১৯৯০ দশকের শুরু থেকেই। ইউনিসেফের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ভেঙ্কটেশ মান্নারের সঙ্গে মিলে তিনি লবণ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করেন। ভেঙ্কটেশের পরিবার দীর্ঘকাল থেকেই লবণ উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত। তিনি শিশুদের জন্য আয়োডিন সমৃদ্ধ লবণের একটি সফল দাতব্য কর্মসূচির আয়োজন করেন। এতে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮৯ শতাংশ মানুষ আয়োডিন সমৃদ্ধ লবণ ব্যবহার শুরু করে। 

মান্নার দেখতে চেয়েছিলেন আয়রনের ক্ষেত্রেও একই ফলাফল পাওয়া যায় কিনা। এটি সাধারণ একটি ভিশন হলেও তা বাস্তবায়ন করা সহজ ছিল না। ডায়োস্যাডি যখন প্রথম আয়রন ও আয়োডিন একত্রিত করেন তখন এরা একে অপরের সঙ্গে বিক্রিয়া করা শুরু করে এবং একপর্যায়ে আয়োডিন বাষ্পীভূত হয়ে যায়। 

ডায়োস্যাডি বলেন, ‘আমাদের এ দু্টিকে আলাদা করার পথ খুঁজতে হয়েছিল, যেন তারা একটি আরেকটির সঙ্গে বিক্রিয়া না করে।’ সমাধানটি ছিল মাইক্রোএনক্যাপসুলেশন। এ প্রক্রিয়াতে আয়রন অণুকে উদ্ভিজ্জ স্নেহপদার্থ দিয়ে আবৃত করা হয়। এতে আয়রন আয়োডিনের সংস্পর্শে আসে না এবং বিক্রিয়া রোধ করা সম্ভব হয়। 

এ সমস্যাটির সমাধান হওয়ার পরই গবেষক দলটি লবণের সঙ্গে আরও পুষ্টি উপাদান যোগ করা শুরু করেন। এতে লবণের সঙ্গে ফলিক অ্যাসিড, জিংক ও ভিটামিন বি১২ যোগ করা হয়। প্রত্যেকটি উপাদান যুক্ত করার সময়ই নতুন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। 

ডায়োস্যাডি বলেন, ‘আপনি সব সময় যতটা সহজ আশা করবেন ততটা হবে না। ফলিক অ্যাসিড স্থিতিশীল নয়, আবার ফলিক অ্যাসিড ও বি১২–এর সহাবস্থান সম্ভব হয় না। তাই এটি তাৎক্ষণিক হয়ে যায়নি। তবে এখন আমরা লবণে ছয়টি উপাদান যুক্ত করতে পারি।’

এরই মধ্যে ইথিওপিয়ায় আয়োডিন এবং ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ লবণ ব্যবহার করে পরীক্ষা চালানো হয়েছে। এ পরীক্ষায় জন্মগত ত্রুটি হার কমে এসেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া তানজানিয়ায়ও এ নিয়ে গবেষণা চলছে। 

শুধু লবণই নয় চায়ের সঙ্গেও আয়রন মিশিয়ে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন ডায়োস্যাডি। ২০১৩ সালে কানাডা, নরওয়ে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের কয়েকটি সংস্থা এবং বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত ‘সেভিং লাইভস অ্যাট বার্থ: এ গ্র্যান্ড চ্যালেঞ্জ ফর ডেভেলপমেন্ট’ ডায়োস্যাডিকে বেশ মোটা অঙ্কের অনুদান দেয়। এ ছাড়া তানজানিয়া ও বিশ্বব্যাপী নারীর স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য প্রকৌশল অ্যালামনাই হিউক্রোথ দম্পতির কাছ থেকে অনুদান পেয়েছে ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং ল্যাবরেটরি। 

লবণের মতো চা–ও বিশ্বব্যাপী প্রচলিত বলে এর প্রতি আগ্রহী হন ডায়োস্যাডি। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে চা বেশ প্রচলিত পানীয়। তিনি বলেন, ‘আমরা চা নিয়েও কাজ করি কারণ ভারতে—শিশু, প্রাপ্তবয়স্ক, ধনী, দরিদ্র—সবাই দিনে অন্তত দুই কাপ চা পান করে। আমরা লবণের ক্ষেত্রে সফল হয়েছি কারণ অতি দরিদ্র কৃষকও লবণ কেনেন। একই কথা চায়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এভাবে আমরা সবার কাছে পৌঁছে যাব।’ 

তবে চায়ে এসব উপাদান মেশানো সহজ ছিল না। চায়ে আয়রন মেশালে তা নীল বর্ণ ধারণ করে বলে জানান ডায়োস্যাডি। তবে এ সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে গবেষক দলটি। তাঁরা আয়রন সমৃদ্ধ চা ‘ব্ল্যাক টি’–এর স্বাদ, বর্ণ ও ধরনের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে পেরেছেন। তবে দুধ মেশালে এ সামঞ্জস্য বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। শিগগিরই এর সমাধান পেয়ে যাবেন বলে আশাবাদী ডায়োস্যাডি। 

আয়রন সমৃদ্ধ চা একবার বাজারজাত যোগ্য হলে ভোগ্যপণ্যের বহুজাতিক সংস্থা ইউনিলিভারের সঙ্গে সুসম্পর্ক কাজে দেবে বলে আশাবাদী ডায়োস্যাডি। ইউনিলিভারের মাধ্যমে এটি সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে। প্রতি বছর বহুজাতিক এ সংস্থাটি হাজার হাজার টন চা উৎপাদন করে।

ডায়োস্যাডির ল্যাবে ১৫ জন গবেষকের মধ্যে একজন হলেন ফোলেক ওয়েওল। তিনি বলেন, ‘আমরা আয়রন নিয়ে কাজ করছি কারণ, বৈশ্বিকভাবে সাধারণত এই পুষ্টি উপাদানটিরই ঘাটতি সবচেয়ে বেশি।’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুসারে, শুধু নাইজেরিয়াতেই প্রায় ৫৫ শতাংশ প্রজননক্ষম নারী রক্তাল্পতায় ভুগছেন।

ওয়েওল বলেন, ‘রক্তাল্পতা প্রকট হওয়ার একটি কারণ হলো উদ্ভিদ নির্ভর খাদ্যাভ্যাস। বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলোতে মাংসের দাম বেশি হওয়ায় খাবারের চাহিদা পূরণে উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ে। কয়েকটি উদ্ভিদে পলিফেনল নামের উপাদান থাকে। এর নিজস্ব পুষ্টি উপাদান থাকলেও এটি শরীরে আয়রন শোষণের শক্তি কমিয়ে দেয়।’

ডায়োস্যাডির এ ক্ষুদ্র উদ্ভাবনের বেশির ভাগ উপকারভোগী দেশ হলো—ভারত, বাংলাদেশ, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও আফ্রিকার কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

নতুন মেট্রো নয়, রুট বাড়ানোর চিন্তা

সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত সড়ক কার্পেটিং বিচারপতি খিজির হায়াতের, প্রমাণ পেয়েছে দুদক

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত