Ajker Patrika

পুরুষেরা স্বাস্থ্য নিয়ে উদাসীন, অসংক্রামক রোগ সামলাতে কৌশল খুঁজছে যুক্তরাজ্য

অনলাইন ডেস্ক
পুরুষেরা উচ্চ কোলেস্টেরল ও রক্তচাপের সমস্যায় বেশি ভোগে। ছবি: পেক্সেলস
পুরুষেরা উচ্চ কোলেস্টেরল ও রক্তচাপের সমস্যায় বেশি ভোগে। ছবি: পেক্সেলস

অ্যান্ড্রু হ্যারিসন। যুক্তরাজ্যের ব্র্যাডফোর্ডের একটি যুব কেন্দ্রে পুরুষদের স্বাস্থ্য ক্লিনিক পরিচালনার দায়িত্বে আছেন। একদিন ক্লিনিকের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখেন সেখানে কেউ নেই। পরে আবার শুনলেন, কেউ তার নাম ডাকছে। চারদিকে তাকিয়ে পরে একটি জানালার পাশে এক যুবককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। অবাক হয়ে কারণ জানতে চাইলে শোনেন ওই যুবক কনডম নিতে এসেছে।

কয়েক বছর আগের এই ঘটনার স্মৃতিচারণ করে হ্যারিসন বলেন, ‘আমি প্রথম তলায় ছিলাম। ছেলেটা ভবনের বাইরের দিকের ড্রেনের পাইপ বেয়ে উপরে উঠে এসেছিল। সে সরাসরি রিসেপশনে এসে কনডম চাইতে লজ্জা পাচ্ছিল।’

এই ঘটনাটি তুলে ধরে যুক্তরাজ্যের পুরুষদের স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত ভাবনার চিত্র। তাদের সমস্যাগুলোর পেছনে কারণ হিসেবে উঠে এসেছে—ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ এবং স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে যোগাযোগ করার আত্মবিশ্বাস ও দক্ষতার অভাব।

বিবিসির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ধূমপান, অ্যালকোহল পান ও মাদক গ্রহণের কারণে যুক্তরাজ্যের পুরুষেরা উচ্চ কোলেস্টেরল ও রক্তচাপের সমস্যায় বেশি ভোগে। ৭৫ বছর বয়সের আগেই হৃদ্‌রোগ, ফুসফুসের ক্যানসার, লিভারের রোগ এবং দুর্ঘটনায় প্রায় ৬০ শতাংশের বেশি হারে মৃত্যু হয়। এসব কারণে পুরুষদের গড় আয়ু নারীদের তুলনায় চার বছর কম।

পুরুষ স্বাস্থ্যে এই অবস্থা দেখে যুক্তরাজ্য কৌশল খুঁজছে কীভাবে পুরুষদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানো যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পদক্ষেপ অনেক আগেই নেওয়া উচিত ছিল। কারণ পুরুষেরা নারীদের তুলনায় কম বয়সে মারা যায়। কিন্তু পুরুষদের স্বাস্থ্যের অবস্থা এত খারাপ কেন এবং এ সমস্যা সমাধানে করণীয় নিয়ে এতকাল কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

দাতব্য সংস্থা মেনস হেলথ ফোরামের সহপ্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক অ্যালান হোয়াইট লিডস বেকেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরুষদের জন্য একটি বিশেষ স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি বলেন, পুরুষ স্বাস্থ্যের বিষয়টি আরও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার। উদাহরণ হিসেবে কোভিড মহামারির সময়কার কথা তুলে ধরেন তিনি।

হোয়াইট বলেন, কোভিডে নারীদের তুলনায় পুরুষ মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৯ হাজারেরও বেশি। সে সময় বিষয়টি নিয়ে কেউ ক্ষোভ দেখায়নি, যে কারণে বিষয়টি গুরুত্বও পায়নি।

হোয়াইট মনে করেন, শুধু জীবনধারার দোষ দিয়ে পুরুষদের খারাপ স্বাস্থ্যের ব্যাখ্যা দেওয়া খুব সহজ, কিন্তু ব্যাপারটি আসলে অনেক জটিল। এর পেছনে জৈবিক কারণও আছে। পুরুষদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে দুর্বল, যার ফলে সংক্রমণ সহজে প্রতিরোধ করতে পারে না। তবে অনেক পুরুষের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার দক্ষতাও কম থাকে।

অধ্যাপক হোয়াইট বলেন, ‘পুরুষেরা স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত বিষয়ে কম সচেতন। তারা কীভাবে নিজেদের স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলবে, কোন লক্ষণগুলো গুরুত্বপূর্ণ—তা চিনতে ও ব্যবস্থা নিতে শেখে না। সাধারণভাবে, কিশোর বয়স থেকে শুরু করে ৪০ বছর পর্যন্ত পুরুষদের স্বাস্থ্য প্রায় একই রকম থাকে। তারা অনেক সময় ধরে চিকিৎসকের কাছে যায় না।’

হোয়াইট বলেন, ‘নারীদের ক্ষেত্রে বিষয়টি আলাদা। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ, জরায়ু পরীক্ষা এবং পরে সন্তান জন্মদানের কারণে তারা নিয়মিতভাবে স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে যুক্ত থাকে, যেটা পুরুষদের ক্ষেত্রে হয় না।’

পুরুষ ও ছেলেদের বিষয়ে কাজ করে থাকে অল-পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপ। তারা সরকারকে পুরুষদের জন্য একটি স্বাস্থ্য কৌশল তৈরি করতে উৎসাহিত করার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এই গ্রুপটির নীতিগত উপদেষ্টা মার্ক ব্রুকস মনে করেন এ অবস্থার পেছনে পুরুষের পুরুষত্ব জাহিরের চেষ্টাও একটা বড় কারণ।

তিনি বলেন, “আমাদের সমাজে পুরুষদের থেকে আলাদা রকমের প্রত্যাশা থাকে। তাদের বলা হয়, ‘পুরুষ হও’, শক্ত হও, সবকিছু চুপচাপ সহ্য করো।”

ব্রুকস মনে করেন, পুরুষদের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে দারিদ্র্যের প্রভাবকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। সবচেয়ে দরিদ্র ১০ শতাংশ এলাকার মানুষের গড় আয়ু সবচেয়ে ধনী এলাকার তুলনায় ১০ বছর কম। এই পার্থক্য নারীদের চেয়ে পুরুষদের ক্ষেত্রে আরও বেশি। সবচেয়ে দরিদ্র এলাকাগুলোতে একজন পুরুষের ৭৫ বছর বয়সের আগেই মারা যাওয়ার সম্ভাবনা ৩ দশমিক ৫ গুণ বেশি।

যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা এনএইচএস প্রতি ৪০ থেকে ৭৪ বছর বয়সীদের প্রতি পাঁচ বছর অন্তর একটি স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার সুযোগ দেয়। এটি এমন অনেক রোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যেগুলোতে অবহেলার কারণে পুরুষদের অকালে মৃত্যু হয়ে থাকে। কিন্তু দেখা যায়, দশজন পুরুষের মধ্যে চারজনেরও কম এই সুযোগ গ্রহণ করেন।

ব্রুকস বলেন, “স্বাস্থ্যসেবার যেভাবে নকশা করা হয়েছে, তা পুরুষদের জন্য কার্যকরভাবে কাজ করছে না। আপনি পিছিয়ে পড়া সমাজ ও নির্মাণ বা কারখানার মতো ‘ব্লু-কলার’ পেশার শ্রমিকদের অবস্থা উপেক্ষা করতে পারেন না। নির্মাণকাজ বা কোনো ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকায় কাজ করা একজন লোকের পক্ষে স্বাস্থ্য পরীক্ষা বা জিপির কাছে যাওয়ার জন্য ছুটি নেওয়া খুব কঠিন। ”

তিনি আশা করেন, কর্মীদের দুই ঘণ্টা বেতনসহ ছুটি দেওয়া হবে যাতে তাঁরা স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে যেতে পারে। পাশাপাশি, এই স্বাস্থ্যসেবাগুলো যেন শিল্প এলাকা বা কারখানার কর্মীদের কর্মস্থলেই দেওয়া হয়।

তবে মার্ক ব্রুকস এটাও বলেন, শুধু স্বাস্থ্যসেবা নয়, বিষয়টি কর্মসংস্থানের সঙ্গেও জড়িত। পুরুষদের ৪০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে যেসব শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে, তাদের অনেকে এই সমস্যা প্রকাশ করতে ভয় পান। অনেকে প্রাথমিক লক্ষণগুলো উপেক্ষা করেন বা অসুস্থতা বসের কাছ থেকে গোপন রাখেন। তারা ভাবেন এতে তাদের চাকরি বা আয়ের ক্ষতি হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, ‘চাকরি নিয়ে উদ্বেগ, আর্থিক দুশ্চিন্তা ও সম্পর্কজনিত সমস্যাগুলোই পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার উচ্চহারের অন্যতম কারণ। আত্মহত্যা করা ব্যক্তিদের চার ভাগের তিন ভাগই পুরুষ।’

মেনস হেলথ ফোরামের সহপ্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক অ্যালান হোয়াইট বলেন, বর্তমানে চলমান কাউন্সেলিংয়ের ধরনগুলো পুরুষদের মানসিক অবসাদ বা উদ্বেগের লক্ষণগুলো সহজে ধরতে পারে না। সেগুলোর পরিষেবাগুলো পুরুষদের প্রকাশভঙ্গির সঙ্গে মেলে না। পুরুষেরা সাধারণত রাগ দেখায়, অতিরিক্ত অ্যালকোহল খায় অথবা চুপচাপ হয়ে যায় ও মানুষকে দূরে ঠেলে দেয়।

এসব ক্ষেত্রে জাতিগত পার্থক্যগুলোও গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন হোয়াইট। তিনি বলেন, ইংল্যান্ডে কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের প্রোস্টেট ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা দ্বিগুণ আর ভারত বা বাংলাদেশ থেকে আসা পুরুষদের ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি খুব বেশি।

তবে এসব তথ্যের মানে এটা নয় যে, পুরুষেরা তাদের নিজের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতন হতে আগ্রহী নয়। ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরুষ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক পল গ্যালডাস বলেন, ‘পুরুষেরা নিজেদের কথা বলতে চায়, যুক্ত হতে চায় কিন্তু সেটা করতে হলে কার্যকর কাজ ও কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সুযোগ তৈরি করতে হবে।’

গ্যালডাস পুরুষ স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা সংস্থা ‘মোভেম্বার’-এর সঙ্গে একটি ছয় সপ্তাহের মানসিক ফিটনেস প্রোগ্রাম তৈরি করতে কাজ করেছেন। কোভিডের পর এনএইচএসের ফ্রন্টলাইন কর্মীদের ওপর এটি পরীক্ষা করা হয়েছিল। এখন এটি লিডস ইউনাইটেড ফুটবল ক্লাব তাদের যুব খেলোয়াড়দের জন্য ব্যবহার করছে।

এই প্রোগ্রামে পুরুষদের নিজেদের আচরণ কীভাবে মনের অবস্থাকে প্রভাবিত করে তা বুঝতে সাহায্য করা হয়। নিজেদের অভ্যাস পর্যবেক্ষণ করতে ও স্বাস্থ্যকর কাজের জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করতে তাদের উৎসাহ দেওয়া হয়।

গ্যালডাস বলেন, ‘এটা হতে পারে হাঁটতে যাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো, গলফ খেলা কিংবা সমস্যা সমাধানের দক্ষতা তৈরি করা। এসব কাজ মানসিক স্বাস্থ্যকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। ভালো মানসিক স্বাস্থ্য থেকে আসে ভালো শারীরিক স্বাস্থ্য।’

বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা স্থানীয় পর্যায়ে স্থানীয় পরিষদ এবং পুরুষদের বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে মিলে পুরুষ স্বাস্থ্যের জন্য এ ধরনের প্রোগ্রাম তৈরির চেষ্টা করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় উদ্যোগগুলোর একটি হলো—মেনস শেডস মুভমেন্ট। এখানে পুরুষদের একত্রিত হওয়ার সুযোগ মেলে। তাঁরা একসঙ্গে বসে ব্যবহারিক প্রকল্পের কাজ করতে করতে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে এবং একে অপরকে মানসিকভাবে সহায়তা করে।

অধ্যাপক হোয়াইট বলেন, এই ইতিবাচক উদ্যোগগুলোকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এখনই সময়। এ জন্য একটি জাতীয় পুরুষ স্বাস্থ্য কৌশল তৈরি করা খুবই জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

হোয়াইট বলেন, যুক্তরাজ্যে ২০২২ সালে নারীদের স্বাস্থ্য কৌশল তৈরি হয়েছিল। জাতীয় পুরুষ স্বাস্থ্য কৌশলটি তেমনই পুরুষদের স্বাস্থ্যের উন্নয়নে কাজ করবে। তিনি আশা করেন, এই কৌশলটি পুরুষদের জন্য একটি ‘জেগে ওঠার বার্তা’ হিসেবে কাজ করবে।

পুরুষদের উদ্দেশ্যে অধ্যাপক হোয়াইট বলেন, ‘আপনার কোমরের মাপ দেখুন। যদি বেশি ওজন থাকে, যদি পেট বড় হয়ে যায়, তাহলে এর পরিবর্তন আনার চেষ্টা করুন। শরীরচর্চা করুন, বাইরে যান, মানুষের সঙ্গে কথা বলুন। সুযোগ পেলেই স্বাস্থ্য পরীক্ষা বা স্ক্রিনিং করান। আর শরীরে কোনো পরিবর্তন দেখলে বা সমস্যা দেখা দিলে সাহায্য নিন।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত সড়ক কার্পেটিং বিচারপতি খিজির হায়াতের, প্রমাণ পেয়েছে দুদক

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

বগুড়ায় ছাত্রদল নেতার ওপর হামলা, পাঁচ নেতা-কর্মীকে শোকজ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত