Ajker Patrika

গণতন্ত্র ও সংস্কৃতির নিরাপত্তা

মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব
গণতন্ত্র ও সংস্কৃতির নিরাপত্তা

সাধারণত দেখা যায় যে কোনো স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন কোনো একটি পরিণতি পেয়ে গেলে উত্তাল জনগোষ্ঠী পরবর্তী দায়িত্ব নেয় না। কারণ ক্ষমতার রদবদল হয় এবং আরেকটি ক্ষমতাবান গোষ্ঠী দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। তখন ওই আন্দোলনকারীদের আর কোনো ভূমিকা থাকে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যাঁরা ক্ষমতায় আসেন, তাঁরাও আন্দোলনের যে দফাগুলো ছিল, সেগুলো ভুলে যান। ফলে সব সিদ্ধান্ত হয় শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে। আন্দোলনের উষ্ণতা আর তাঁরা অনুভব করেন না। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে দীর্ঘ সময় সংস্কৃতিকর্মীরা পথে ছিলেন। কিন্তু আন্দোলন শেষ হওয়ার পর কোনো সরকারই সংস্কৃতিকর্মীদের দাবিদাওয়াগুলো তেমনভাবে পূরণ করেনি এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে সব সময় একটি করুণার পাত্র হিসেবে দেখা হয়েছে। দেশে শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে অনেকগুলো মঞ্চ হয়েছে, অধিকাংশ মঞ্চই অভিনয় উপযোগী নয়। শিল্পীদের জীবিকা নির্বাহের জন্য কোনো সুদূরপ্রসারী চিন্তা করা হয়নি। সংস্কৃতির গুরুত্বই কেউ অনুভব করেনি।

গণভবন লুটের দৃশ্যের ফুটেজ দেখছিলাম। এ কথা ঠিক, মানুষের জয়ের উল্লাস স্বীকার করে নিলেও যেভাবে লুট হয়ে গেল সবকিছু, তা কি একেবারে আকাঙ্ক্ষিত ছিল? অধিকারের জন্য যে মানুষ আন্দোলন করে রক্ত দিয়েছে, সেই মানুষগুলোর কথা ভেবে ওই দুষ্কৃতকারীরা নিজেদের সংযত করতে পারত, কিন্তু তা হয়নি। সংসদ বারবার অকার্যকর হয়েছে– এ কথা সত্য, কিন্তু একটি কার্যকর সংসদ তো আমাদের আকাঙ্ক্ষা। সেখানে সংসদ সদস্যদের চেয়ারে বসে ধূমপান করা এটা কি বড় বেমানান লাগে না? বারবার ছাত্রনেতারা সতর্ক করা সত্ত্বেও ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো সংখ্যালঘুদের ভীতি প্রদর্শন। দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নেই, সেখানে এই অসহায় লোকগুলো কার কাছেই বা সাহায্য চাইবে? যদিও দেখা গেছে, কিছু কিছু জায়গায় ছাত্র-জনতা এসব ব্যাপারে সতর্ক অবস্থানে থাকছে। এই সবকিছুই সংস্কৃতির ব্যাপার। মানবিক সংস্কৃতি যদি থাকত, তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতই না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আজকাল মানবিক সংস্কৃতির শিক্ষা দেওয়া হয় না। যে কারণে আমাদের রাষ্ট্রটাও মানবিক হয় না।

কোটা সংস্কার যা পরবর্তীকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে, সেখানে তারাও এসব ব্যাপারে সচেতন। দ্রোহের সঙ্গে আমরা আত্মত্যাগ দেখেছি। এই দ্রোহের সঙ্গে মানবিক মূল্যবোধেরও একটা প্রতিফলন প্রয়োজন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা–ও দেখা গেছে। সম্প্রতি ট্রাফিক পুলিশের অনুপস্থিতিতে ছাত্ররা সেই দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। গত রাতে (মঙ্গলবার) মোহাম্মদপুরের নবোদয় হাউজিংয়ে ডাকাতির পর সেনাবাহিনী ও ছাত্ররা যৌথভাবে একটা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। এরই সঙ্গে আমার মনে পড়ছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় গ্রামাঞ্চলে ডাকাতির প্রবণতা দেখা দিয়েছিল।

ডাকাতরা বিভিন্ন থানা থেকে লুট করা অস্ত্রগুলো ব্যবহার করেছে। সেই সময়ে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনী সাতজন ডাকাতকে ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করেছিল। তারপরই এলাকায় ডাকাতি বন্ধ হয়ে যায়। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই সব সমাজেই আছে, কিন্তু এই সব পরিস্থিতিতে সাধারণত তারা নেমে পড়ে না। যেহেতু গতকাল রাতে যেভাবে ছাত্র, এলাকাবাসী এবং সেনাবাহিনী একটা যৌথ উদ্যোগ নিয়েছে, তাই আশা করছি এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না। এর পেছনে কিন্তু শিক্ষা ও সংস্কৃতি আছে। আমি একজন প্রধান শিক্ষকের ঘটনা জানি। তিনি দীর্ঘদিন ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে শিক্ষকতা করে প্রধান শিক্ষক হয়েছিলেন। তাঁর বাড়িতেও ডাকাতি হয়। ডাকাতির পরদিন তিনি থানায় গেলেন না, কারও কাছে বিচার চাইলেন না, পদত্যাগ করে চলে গেলেন। বহুদিন এই পদত্যাগের কারণ তিনি বলেননি। পরে জানা গিয়েছিল, ওই ডাকাত দলে তিনি তাঁর একজন ছাত্রকে চিনতে পেরেছিলেন। এই দায়ও তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিলেন যে তিনি স্কুলে এত বছর ধরে কী শিক্ষা দিয়েছেন, যার ফলে একজন ডাকাতের জন্ম হয়। সেই প্রধান শিক্ষক ঢাকা শহরে এসে নানা জীবিকার চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত জীবনযুদ্ধে পরাজিত হয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করেন।

একটি শিক্ষাব্যবস্থা যদি সত্যিকার অর্থে মানবিক, অসাম্প্রদায়িক এবং বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখায়, তাহলে তার পক্ষে দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া, অসততার পথে যাওয়া কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়। কিন্তু আজ গোটা সমাজই কী করে দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে গেল। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের একটা বড় অংশই এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। সমাজে যখন অর্থই একমাত্র মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, তখন অন্যান্য বিষয় গৌণ হয়ে যায়। এই গৌণ বিষয়গুলোর মধ্যেই আছে শিক্ষা, সংস্কৃতির মূল্যবোধ। একটা সময়ে প্রত্যেক শিক্ষককে মনে হতো বিদ্যাসাগর। জীবনযাপনে, ব্যক্তিগত আচরণে, পাণ্ডিত্যে সহমর্মিতায় তাঁরা ছিলেন আমাদের আদর্শ। তখন আমাদের চিন্তাই ছিল বড় হয়ে ওই শিক্ষকের মতোই শিক্ষকতা করব। সেই শিক্ষকদের প্রেরণাতেই ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করা সম্ভব হয়েছিল। এখনকার তরুণ ছাত্রদের মধ্যেও তাদের জ্বলজ্বল করা চোখে আবার স্বপ্ন দেখতে পাই। কোনো দলীয় রাজনৈতিক প্রেরণা থেকে নয়, একেবারেই নিজস্ব প্রেরণায় তারা পথে এসে দাঁড়িয়েছে। একটা গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণে এবং রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলছে।

কিন্তু একটাই ভয়, একসময়ে এই আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাবে, ছাত্ররা ক্লাসরুমে প্রবেশ করবে, কিন্তু তখন যে রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় আসবে, তারা কি ছাত্রদের এই আকাঙ্ক্ষা নিজেদের মধ্যে ধারণ করবে? ইতিহাস বলে, সাধারণত তা হয় না। যদিও ছাত্ররা বারবার উচ্চারণ করছে যেকোনো ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য তারা পথে থাকবে। এই আন্দোলনে ক্ষুব্ধ জনতার একটা বিরাট অংশ যোগ দিয়েছে। কারও কারও ক্ষোভ একেবারেই ব্যক্তিগত বঞ্চনা থেকে। ব্যক্তিগত বঞ্চনা সব সময়ই প্রতিশোধস্পৃহার দিকে এগিয়ে যায়। এই প্রতিশোধস্পৃহার লোকেরও অভাব নেই। যেকোনো আন্দোলনের সুযোগে তারা নিজেদের হিংসাকে চরিতার্থ করে। আবার কল্যাণহীন অমানবিক রাজনীতি এর জন্য সুযোগও করে দেয়। কারণ রাজনৈতিক দলের কাছে পেশিশক্তিও প্রয়োজন। যে কারণে একধরনের মাস্তান গড়ে ওঠে, যারা অর্থের বিনিময়ে আদর্শহীন অন্যায় কাজ করে যায়। এই সব মাস্তান কখনো কিংবদন্তিতে পরিণত হয়। একেক সময় ক্ষমতার রদবদলের সুযোগে তারা বিত্তবান হয়ে নানা ধরনের সহিংস কাজে অংশ নেয়।

একটা সাবধান বাণী উচ্চারণ হওয়া প্রয়োজন। তা হলো—পেশিশক্তি নয়, আদর্শবাদী শিক্ষাই সমাজকে পরিচালিত করবে। ১৮৬৬ সালের আগে জাপানে পেশিশক্তি প্রবল ছিল। মেইজি সংস্কারের পর আস্তে আস্তে শিক্ষার মাধ্যমে জাপানি সমাজে বড় পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তনে তাদের ৩০ বছর লেগেছে।

জাপানের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পাঠক্রমে নানা ধরনের মূল্যবোধের অনুশীলন থাকে। আমেরিকার শাসকগোষ্ঠী পুঁজিবাদকে প্রতিনিধিত্ব করে। এ কথা সত্যি এবং দেশে-বিদেশে তারা নানা ধরনের আগ্রাসী ভূমিকা নেয়। কিন্তু সেখানে শিক্ষাব্যবস্থা একেবারেই উল্টো। তাই সম্প্রতি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ফিলিস্তিনের পক্ষে ছাত্ররা বিশাল প্রতিবাদী আন্দোলনের সূচনা করেন। ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এই অন্ধ সমর্থনের বিরোধিতা করে অনেক স্থানেই সরকারি কার্যক্রমকে অচল করে দেয়। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেনের অংশগ্রহণও বাধাগ্রস্ত হয় এবং তিনি সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন।
আমাদের ছাত্ররা যা চাইছে, সেটা আমাদের দীর্ঘদিনের লালিত আকাঙ্ক্ষা; তা হলো—গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের মতো নিরাপদ ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি।

পরিবার থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত যদি গণতন্ত্র থাকে, তাহলে মানুষের জীবনযাপনও নিরাপদ হয়। গণতন্ত্রের অভাব হলে পারিবারিক শৃঙ্খলা যেমন বিপর্যস্ত হয়, তেমনি রাষ্ট্র শাসনে শোষকেরা একটা বড় সুযোগ পেয়ে যায়। এই সুযোগে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠনের ব্যবস্থা হয়ে যায়। এই লুণ্ঠিত অর্থ দেশে থাকে না। কারণ ওই শোষকেরা দেশটাকে নিরাপদ ভাবে না। তাই তাদের নিরাপত্তার কারণে বিদেশের ব্যাংকে অথবা কোথাও লগ্নি করতে হয়। আজকে ইংল্যান্ড, কানাডা, আমেরিকা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড—এসব দেশে ওই সব দুর্বৃত্তের প্রচুর অর্থ লগ্নি করা আছে। অথবা সেখানে বাড়িঘর কিনে সেকেন্ড হোমের স্বপ্ন দেখে তারা। তাই রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে বিদেশে যাওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। আবার পরবর্তী পালাবদলে গলায় ফুলের মালা নিয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করে। লুট, বিদেশে অর্থ পাচার বন্ধ করা এবং প্রকৃত শিক্ষার জন্য একটি আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। যে আন্দোলন থেকে সংস্কৃতিমান মানুষেরা নতুন ভাবনা নিয়ে বেরিয়ে আসবেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সাবেক সিইসি নূরুল হুদার গলায় ‘জুতার মালা’ দিয়ে পুলিশে সোপর্দ

ইরানের পতন হলে, এরপরই রাশিয়া—অভিমত রুশ বিশ্লেষকদের

লাইভ-২ (২৩ জুন, ২০২৫): ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা, হরমুজ প্রণালী বন্ধের হুঁশিয়ারি, জাতিসংঘে জরুরি বৈঠক

ইসরায়েলে ২০ লাখ রুশভাষীর বাস, রাশিয়াকে তাঁদের কথা ভাবতে হয়: পুতিন

হরমুজ প্রণালিতে প্রবেশ করে ইউটার্ন নিল দুটি জাহাজ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত