রজত কান্তি রায়
এই রাহুগ্রস্ত দুশ্চিন্তাময় সময়ের একটা ভালো দিক আছে। বই পড়া যাচ্ছে। শুরু করেছিলাম তারাপদ রায়ের ‘চারাবাড়ি পোড়াবাড়ি’। বাংলা সাহিত্যের এক আশ্চর্যজনক আত্মজৈবনিক উপাখ্যান। কিন্তু তাল কেটে যাচ্ছিল মাঝে মাঝেই।
যেতে হবে বাজারে। বাইরে যা-ই হোক না কেন, পেটে তো দানাপানি দিতে হবে। আর বাজার করতে যেহেতু আমার ভালো লাগে, তাই সবকিছু তুচ্ছ করে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বাজারের থলে হাতে বেরিয়ে পড়লাম—যা থাকে কপালে। না, তেমন কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই বাসায় ফিরতে পেরেছিলাম। শুধু মাঝখানে কিছুটা ঝামেলা বাধিয়েছিলেন রিকশাচালক মুসা, খুলনার মুসা মিয়া।
গলির মুখেই তাঁকে পেয়ে গিয়েছিলাম। তরুণ বয়স। কিন্তু এক নিদারুণ বিষাদ ঘিরে আছে তাঁর তারুণ্যময় শরীরে। চোখ ঘোলাটে। স্বর নম্র হতে হতে মিনমিনে হয়ে গেছে। কেন যেন চোখ আটকে গেল মুসার শরীরে। গন্তব্যের কথা বলে জানতে চাইলাম, ‘যাবেন?’ জানালেন, ভাড়া ৫০ টাকা। মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেলেও কোনো এক অদ্ভুত কারণে ঠান্ডা রইলাম। বললাম, ‘চল্লিশ।’ ‘চলেন’, মুসা রাজি হয়ে গেলেন। না হলেই হয়তো ভালো হতো।
স্বাভাবিকের চেয়ে রিকশার গতি কম। ভেতরে-ভেতরে তেতে উঠছি। কিন্তু মুখে কিছু বলছি না। কেন যেন জানতে চাইলাম, মুসার বাড়ি কোথায়। এটা আমার পুরোনো অভ্যাস। এই এক প্রশ্নের কারণে একেবারে পাশের গ্রামের রিকশাচালককে পেয়ে গিয়েছিলাম ঢাকা শহরের জনারণ্যে। সেই আশাতেই হয়তো অবচেতনেই জানতে চেয়েছিলাম, মুসার দেশের কথা। জানালেন, খুলনা। তরুণদের মিনমিনে স্বর আমায় বিরক্ত করে। তাই খানিক বিরক্তি নিয়েই জিজ্ঞেস করলাম, কে কে আছে বাড়িতে। জানালেন, বাবা নেই। মা আছেন। ভাইবোন, তাঁরাও আছেন। তবে তাঁদের বিয়ে হয়ে গেছে, আলাদা থাকেন। মা আছেন। কিন্তু হাসপাতালে।
কেন? মুসা জানালেন, তাঁর মায়ের বুকের ডান দিকে একটা টিউমার হয়েছিল। সেটা বড় হয়ে ফেটে গেছে। খুলনার সরকারি হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চলছে। প্রতি সপ্তাহে ওষুধ কিনতে হয় হাজারখানেক টাকার। সেই টাকা জোগাড় করেন মুসা, ঢাকায় রিকশা চালিয়ে। ভাইবোনেরাও খানিক সহায়তা করেন। কিন্তু মূলত দায়িত্বটা মুসার।
আমার বাজারের ফর্দে লেখা একটি হাঁস, এক ডজন ডিম, কুঁচো চিংড়ি, লাউ, শাক আর পছন্দমতো অন্যান্য সবজি। পকেটে যে টাকা আছে, আমার অভ্যাসমতো এপাশ-ওপাশ না করলে তাতে হয়ে যাওয়ার কথা। এসব যখন ভাবছি, রিকশার সিটে বসে থাকা ছেলে জানতে চাইল, ‘ওর মার কী হয়েছে বাবা?’
আমি উত্তর দেওয়ার আগেই মিনমিন স্বরে মুসা বলতে শুরু করলেন, ‘অপারেশন আংকেল। বুকে অপারেশন। বাঁচবে না মনে হয়।’
বড় রাস্তায় হাতের ডান দিক দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া টহল যানের সাইরেন, অযথাই বাজানো বাইক আর গাড়ির হর্নে মুসার কথা ঠিক ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়। রিকশা চলে। মুসা তার গতি খানিক বাড়িয়ে দেন। আনমনে বলেন, ‘সপ্তাহে হাজার টাকার ঔষধ, স্যার! আপনাদের কাছে তাই কিছু বেশি টাকা চাইতেই হয়। কিছু মনে কইরেন না। সম্ভব হইলে দিয়েন। যে কয়দিন বাঁচে, টাকাটা আমাকে পাঠাতে হবে।’ বাজারের সামনে নেমে মুসার পিঠে হাত দিয়ে শুধু বললাম, ‘ভালো থাকবেন। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
মুসা কিছু বলেননি। শুধু আমার মুখের দিকে একমুহূর্ত তাকিয়ে নিজের মাথাটা বাম দিয়ে নামিয়ে নিয়েছিলেন মাটির দিকে। আর আমি সন্তর্পণে ছেলের হাত ধরে রাস্তা পেরিয়ে ফর্দ ধরে বাজার করতে ঢুকে গিয়েছিলাম—একটা হাঁস, চিংড়ি মাছ, লাউ...
কী মহান বৈপরীত্য জীবনের!
হ্যাঁ, ফর্দ ধরে বাজার করা হয়েছিল সেদিন। ছেলের পছন্দে টুকটাক আরও কিছু। বাজার করার আনন্দে মুসার কথা ভুলেও গিয়েছিলাম। কিন্তু এক সকালে ছেলের পাতে হাফ ডিম দেখে কারণ জানতে চাইলাম। স্ত্রী জানাল, মুদিদোকানে ডিমের ডজন ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা। তাই রেশন করা হচ্ছে।
মুসার কথা মনে পড়ে গেল। খুলনার মুসা মিয়া। রিকশা চালাতে চালাতে কথার একফাঁকে জানিয়েছিলেন, মায়ের চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে বহুদিন পুরো একটা ডিম খাওয়া হয়নি তাঁর! জীবন কখনো উপন্যাসের চেয়েও জটিল।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
এই রাহুগ্রস্ত দুশ্চিন্তাময় সময়ের একটা ভালো দিক আছে। বই পড়া যাচ্ছে। শুরু করেছিলাম তারাপদ রায়ের ‘চারাবাড়ি পোড়াবাড়ি’। বাংলা সাহিত্যের এক আশ্চর্যজনক আত্মজৈবনিক উপাখ্যান। কিন্তু তাল কেটে যাচ্ছিল মাঝে মাঝেই।
যেতে হবে বাজারে। বাইরে যা-ই হোক না কেন, পেটে তো দানাপানি দিতে হবে। আর বাজার করতে যেহেতু আমার ভালো লাগে, তাই সবকিছু তুচ্ছ করে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বাজারের থলে হাতে বেরিয়ে পড়লাম—যা থাকে কপালে। না, তেমন কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই বাসায় ফিরতে পেরেছিলাম। শুধু মাঝখানে কিছুটা ঝামেলা বাধিয়েছিলেন রিকশাচালক মুসা, খুলনার মুসা মিয়া।
গলির মুখেই তাঁকে পেয়ে গিয়েছিলাম। তরুণ বয়স। কিন্তু এক নিদারুণ বিষাদ ঘিরে আছে তাঁর তারুণ্যময় শরীরে। চোখ ঘোলাটে। স্বর নম্র হতে হতে মিনমিনে হয়ে গেছে। কেন যেন চোখ আটকে গেল মুসার শরীরে। গন্তব্যের কথা বলে জানতে চাইলাম, ‘যাবেন?’ জানালেন, ভাড়া ৫০ টাকা। মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেলেও কোনো এক অদ্ভুত কারণে ঠান্ডা রইলাম। বললাম, ‘চল্লিশ।’ ‘চলেন’, মুসা রাজি হয়ে গেলেন। না হলেই হয়তো ভালো হতো।
স্বাভাবিকের চেয়ে রিকশার গতি কম। ভেতরে-ভেতরে তেতে উঠছি। কিন্তু মুখে কিছু বলছি না। কেন যেন জানতে চাইলাম, মুসার বাড়ি কোথায়। এটা আমার পুরোনো অভ্যাস। এই এক প্রশ্নের কারণে একেবারে পাশের গ্রামের রিকশাচালককে পেয়ে গিয়েছিলাম ঢাকা শহরের জনারণ্যে। সেই আশাতেই হয়তো অবচেতনেই জানতে চেয়েছিলাম, মুসার দেশের কথা। জানালেন, খুলনা। তরুণদের মিনমিনে স্বর আমায় বিরক্ত করে। তাই খানিক বিরক্তি নিয়েই জিজ্ঞেস করলাম, কে কে আছে বাড়িতে। জানালেন, বাবা নেই। মা আছেন। ভাইবোন, তাঁরাও আছেন। তবে তাঁদের বিয়ে হয়ে গেছে, আলাদা থাকেন। মা আছেন। কিন্তু হাসপাতালে।
কেন? মুসা জানালেন, তাঁর মায়ের বুকের ডান দিকে একটা টিউমার হয়েছিল। সেটা বড় হয়ে ফেটে গেছে। খুলনার সরকারি হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চলছে। প্রতি সপ্তাহে ওষুধ কিনতে হয় হাজারখানেক টাকার। সেই টাকা জোগাড় করেন মুসা, ঢাকায় রিকশা চালিয়ে। ভাইবোনেরাও খানিক সহায়তা করেন। কিন্তু মূলত দায়িত্বটা মুসার।
আমার বাজারের ফর্দে লেখা একটি হাঁস, এক ডজন ডিম, কুঁচো চিংড়ি, লাউ, শাক আর পছন্দমতো অন্যান্য সবজি। পকেটে যে টাকা আছে, আমার অভ্যাসমতো এপাশ-ওপাশ না করলে তাতে হয়ে যাওয়ার কথা। এসব যখন ভাবছি, রিকশার সিটে বসে থাকা ছেলে জানতে চাইল, ‘ওর মার কী হয়েছে বাবা?’
আমি উত্তর দেওয়ার আগেই মিনমিন স্বরে মুসা বলতে শুরু করলেন, ‘অপারেশন আংকেল। বুকে অপারেশন। বাঁচবে না মনে হয়।’
বড় রাস্তায় হাতের ডান দিক দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া টহল যানের সাইরেন, অযথাই বাজানো বাইক আর গাড়ির হর্নে মুসার কথা ঠিক ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়। রিকশা চলে। মুসা তার গতি খানিক বাড়িয়ে দেন। আনমনে বলেন, ‘সপ্তাহে হাজার টাকার ঔষধ, স্যার! আপনাদের কাছে তাই কিছু বেশি টাকা চাইতেই হয়। কিছু মনে কইরেন না। সম্ভব হইলে দিয়েন। যে কয়দিন বাঁচে, টাকাটা আমাকে পাঠাতে হবে।’ বাজারের সামনে নেমে মুসার পিঠে হাত দিয়ে শুধু বললাম, ‘ভালো থাকবেন। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
মুসা কিছু বলেননি। শুধু আমার মুখের দিকে একমুহূর্ত তাকিয়ে নিজের মাথাটা বাম দিয়ে নামিয়ে নিয়েছিলেন মাটির দিকে। আর আমি সন্তর্পণে ছেলের হাত ধরে রাস্তা পেরিয়ে ফর্দ ধরে বাজার করতে ঢুকে গিয়েছিলাম—একটা হাঁস, চিংড়ি মাছ, লাউ...
কী মহান বৈপরীত্য জীবনের!
হ্যাঁ, ফর্দ ধরে বাজার করা হয়েছিল সেদিন। ছেলের পছন্দে টুকটাক আরও কিছু। বাজার করার আনন্দে মুসার কথা ভুলেও গিয়েছিলাম। কিন্তু এক সকালে ছেলের পাতে হাফ ডিম দেখে কারণ জানতে চাইলাম। স্ত্রী জানাল, মুদিদোকানে ডিমের ডজন ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা। তাই রেশন করা হচ্ছে।
মুসার কথা মনে পড়ে গেল। খুলনার মুসা মিয়া। রিকশা চালাতে চালাতে কথার একফাঁকে জানিয়েছিলেন, মায়ের চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে বহুদিন পুরো একটা ডিম খাওয়া হয়নি তাঁর! জীবন কখনো উপন্যাসের চেয়েও জটিল।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
‘দুই দিন আগেই বাড়ি থেকে পাথরঘাটায় চলে এসেছি। এখন পুরোনো জাল সেলাই করছি। এক সপ্তাহের বাজারও করে এনেছি। আজ বিকেলে সাগর মোহনায় যাব, গভীর রাত থেকে জাল ফেলব।’ কথাগুলো বলছিলেন বরগুনা সদরের বাইনচটকী এলাকার জেলে হোসেন আলী। গতকাল বুধবার সকালে বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে কথা হয় তাঁর...
১২ জুন ২০২৫ভারতের স্থলবন্দর নিষেধাজ্ঞার পর সীমান্তে আটকে থাকা তৈরি পোশাক, খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের ট্রাকগুলো ফেরত আনছেন রপ্তানিকারকেরা। তবে যেসব ট্রাক বন্দরে ঢুকে গিয়েছিল, সেগুলো ভারতে প্রবেশ করানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব ট্রাক ঢুকতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে।
১৯ মে ২০২৫আধুনিক যুগের সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলোর একটি হচ্ছে গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষের সঙ্গে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক রত্নসম্ভার। গতকাল বুধবার হংকংয়ে বিখ্যাত আর্ট নিলাম কোম্পানি সাদাবি’স-এর এক নিলামে এগুলো তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
০৮ মে ২০২৫পাকিস্তানে ভারতের হামলার সমালোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চীনও এই হামলাকে ‘দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করেছে। উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘও। উত্তেজনা যেন আরও না বাড়ে, সে জন্য দুই পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ। এদিকে ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করেছে...
০৮ মে ২০২৫