Ajker Patrika

এগিয়ে যাক বাংলাদেশ

সাকীব মৃধা
আপডেট : ২৮ মার্চ ২০২২, ১২: ৪৮
এগিয়ে যাক বাংলাদেশ

ব্যক্তিগত কাজে কদিন ধরে আজিমপুর-আশুলিয়া রাস্তাটা নিজের ঘরবাড়ির মতো হয়ে গেছে। সেদিন সাভার পেরোতেই বাসে হুড়মুড় করে জীর্ণ কাপড়ে কাঁদতে কাঁদতে ৩৩-৩৪ বছরের এক যুবক উঠে পড়ল। পেছনে সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের দুই ছাত্র, তার পেছনে স্কুলের আরও ৮-৯ জন ছাত্র উঠল। কান্নারত যুবক খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাসের শেষের দিকে চলে আসেন। রাস্তার ধুলোবালির ময়লা চেহারায় কান্নার পানির দাগ স্পষ্ট।

আমি অভ্যাসবশত বাসের শেষ দিকের জানালার পাশের আসনে বসা। হালকা পেছনে তাকাতে খেয়াল করলাম ওই যুবক শেষের আসনের সামনের পা রাখার জায়গাটায় বসে পড়তেই এক ছাত্র এসে বকতে শুরু করল। খেয়াল করলাম ছাত্রটির হাতে একটা ১০০ টাকার নোট, একটা ৫০, দু-একটা ২০, বেশ কয়েকটা ১০, আর কিছু খুচরা নোট। ছেলেটা টাকাগুলো ওই যুবককে সাধছে, কিন্তু সে অনবরত কেঁদেই যাচ্ছে।

ছেঁড়া কাপড়ে যুবকটি ছাত্রটিকে বলছে, ‘না, আমি মইরা যামু, আমারে ছাড়েন, আমি মইরা যামু, ছাড়েন আমারে!’ আমি তাজ্জব বনে গেলাম, একটা জলজ্যান্ত মানুষ মরে যেতে চাইছে কেন?

আশপাশের উৎসুক যাত্রীরা জানতে চাইল কী হয়েছে। ছাত্রটি জানায়, ওই যুবক শারীরিক প্রতিবন্ধী, (ছদ্ম) নাম আমীন, ভিক্ষা করে খায়। ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের সামনে এক ছিনতাইকারী ধরে। পকেটে চার শর মতো টাকা ছিল, পুরোটা নিয়ে গেছে। তাই সে আত্মহত্যা করার জন্য রাস্তায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। ছাত্ররা ধরে রাস্তার পাশে নিয়ে আসে। এরপর আরও দুইবার সে রাস্তায় শুয়ে পড়ে। এবারে বাসে তুলে এনেছে, আমীনকে বাড়ি পৌঁছে দেবে।

যাত্রীরা আমীনকে ‘এই তুমি মইরা গেলে তোমার সংসার চালাবে কে? বাঁইচা থাকলে তো আরও টাকা কামাইতে পারবা।’ এসব বলে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। এই কথা, সেই কথা হতে বাইপাইল পৌঁছে গেছি, বাস পাল্টাব। আশুলিয়া যাওয়ার বাসে উঠে দেখি আমীনকে নিয়ে ছাত্রটা ওই বাসেই উঠেছে। আমি তাদের পেছনের সিটে গিয়ে বসলাম।

ছাত্রটা আমীনকে তখনো শাসাচ্ছে। বলছে, ‘এই, তোমার বউটা অন্ধ, বাসায় তোমার তিন বছরের একটা বাচ্চা আছে, তুমি যে আত্মহত্যা করতে চাইলা, বাসার মানুষগুলার কী অবস্থাটা হইত, কও!’ আমীন কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠল, ‘যেয় আমার টাকাডা মাইরা দিল, অয় তো কাজ কইরাও খাইতে পারে, আমার দুইডা পা ব্যাকা, দুইডা হাত ব্যাকা, ভিক্ষা কইরা দুইডা ভাত খাই, অয় আমার ট্যাকাডা লয়া গেল গা ক্যা, কন?’

সদুত্তর খুঁজে না পেয়ে ছাত্রটি বলল, ‘তোমারে মিয়া এই যে তিন শর কাছাকাছি টাকা তুলে দিলাম, এ দিয়া হয়ে যাবে, এত চিন্তা করো কেন?’ আমীন টাকার অঙ্ক শুনে যেন সংবিৎ ফিরে পান। ছাত্রটি আমীনকে আত্মহত্যা না করার জন্য আরও বোঝায়। আমীন হেসে বলে, ‘না ভাই, মইরা গেলে আমার বউ-বাচ্চারে দেখব কেডা? বাড়িওয়ালায় ভালা মানুষ, সবাইর থেইকা ১ হাজার লয়, আমার থেইকা লয় ৭০০। আমার অন্ধ বউটা তো ওই টাকাও দিতে পারব না।’

এর মধ্যেই জামগড়া পার হয়ে বাস নরসিংহপুরে পৌঁছে যায়, ওরা নেমে যাবে, আমিও। ছাত্রটাকে ডেকে ওর হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বললাম, ‘ওনার জন্য কিছু চাল, ডাল, আর লবণ কিনে দিও প্লিজ।’ মাস্ক পরা ছেলেটার চোখ দুটোই শুধু দেখা যাচ্ছিল, হঠাৎ করে যেন জ্বলে উঠল। আমাকে ধন্যবাদ দেওয়ার পর জেনে নিলাম ছেলেটা ক্লাস টেনে পড়ে। তারা বাস থেকে নেমে বাজারের দিকে রওনা দিয়েছে। আমি নেমে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘নাম কী তোমার?’ উচ্চ স্বরে শুধু একটা শব্দ এল, ‘সিয়াম’। না, ছদ্ম নাম নয়, ওর আসল নামই।

পথে-ঘাটে এমন সিয়ামদের দেখা অনেক সময়ই পাই। যদিও সংখ্যাটা কম। তবু ভাবতে ভালো লাগে যে এখনো এ দেশে সিয়ামরা বাস করে, যারা অন্যের বিপদে এগিয়ে আসে। সিয়ামদের সংখ্যা বাড়ুক, তাদের কাঁধে ভর দিয়েই এগিয়ে যাক বাংলাদেশ! এতটুকু আশা করাটা কি খুব বেশি কিছু?

সাকীব মৃধা, কৃষি উদ্যোক্তা; কমিউনিকেশন প্রফেশনাল 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত