Ajker Patrika

এ বছর শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হলো জাতির সঙ্গে প্রতারণা

এ বছর শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হলো জাতির সঙ্গে প্রতারণা

ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। তিনি লন্ডনের ব্রুনেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওআরএস স্কলারশিপ নিয়ে পিএইচডি করেন। জার্মানির বিখ্যাত হামবোল্ট ফেলোশিপ নিয়ে পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টরাল গবেষক হিসেবে কাজ করেন। এ বছরের বাজেটে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা

আজকের পত্রিকা: জিডিপি অনুযায়ী, শিক্ষা খাতে গত বছরের তুলনায় বরাদ্দ কমেছে। সরকারের শিক্ষার প্রতি বিরূপতার কারণ কী?
কামরুল হাসান মামুন: প্রথম কথা হলো, শিক্ষাকে সরকার কীভাবে দেখে? বাজেটকে তিন ভাগে ব্যাখ্যা করা যায়। প্রথমত, মোট বাজেটের কত শতাংশ? দ্বিতীয়ত, টাকার পরিমাণ কত? তৃতীয়ত, জিডিপির কত শতাংশ? আমরা হাত বা গজ দিয়ে শাড়ি মাপি। শিক্ষাটা কোন স্কেলে মাপব? সারা বিশ্বে এবং ইউনেসকোর পরামর্শমতে, শিক্ষা খাতে বরাদ্দ মাপতে হবে জিডিপি দিয়ে। এবার বাজেটে শিক্ষা খাতে টাকার অঙ্কে বরাদ্দ বেড়েছে। কিন্তু টাকার মানও কমেছে। আমার বেতন ২০১৫ সালের হিসাব মতে, এখন ডলারে হিসাব করলে ৩০০ ডলার কমে গেছে; অর্থাৎ টাকার অঙ্কে বাড়লেও বাজারের ঊর্ধ্বমুখী কারণে টাকার মান কমে গেছে।

গত বছর ১ ডলার ছিল ৮৩ টাকা আর এখন ১২০ টাকা। তাহলে টাকার অঙ্কে বাড়লেও লাভ নেই। এখন যদি বলি টাকার অঙ্কে বেড়েছে মানে বরাদ্দ বেড়েছে, তাহলে কথাটা সঠিক নয়।আবার মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য শিক্ষাকে প্রযুক্তি খাতের সঙ্গে মিলিয়ে বলা হয়।

প্রযুক্তি হলো সম্পূর্ণ স্বাধীন মন্ত্রণালয়। চার বছর আগে ২ দশমিক ১৮ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল। সেটা ক্রমান্বয়ে কমতে কমতে এবার ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ হয়েছে। গতবার ছিল ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। তারপরও দেখা গেছে, গতবার মন্ত্রণালয় সব টাকা খরচ করেনি। এ রকম ঘটনায় আমার সন্দেহ হয়েছিল, এটা জাস্টিফাই করার জন্য যে এত টাকা এ খাতে দরকার নেই।

বরাদ্দের অধিকাংশ টাকা কাঠামোগত উন্নয়ন ও বেতনে চলে যায়। আর আমাদের দেশে শিক্ষকদের সবচেয়ে কম বেতন দেওয়া হয়।কয়েক দিন আগে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন সর্বনিম্ন। যদি বলি আমরা নেপাল, ভুটান ও পাকিস্তান থেকে উন্নত। এটাই কি তার নমুনা? সুতরাং এ বছর শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হলো জাতির সঙ্গে প্রতারণা।

একটা দেশ উন্নত হয় শিক্ষা দিয়ে। আমরা যদি ভালো প্রযুক্তিবিদ, বিজ্ঞানী, ডাক্তার ও জ্ঞানী তৈরি করতে পারি, তাহলে দেশের অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে যাবে। আমরা যদি মানুষ তৈরি না করে শুধু অবকাঠামো উন্নয়নের দিকে নজর দিই, সেটা কোনো সঠিক কাজ হবে না। আমরা আমাদের মূল জায়গাটাতেই হাত দিইনি। যখন অবকাঠামো উন্নয়নের দিকে নজর দিই, সেটা থেকে বোঝা যায় সরকার সত্যিকার শিক্ষার প্রতি আগ্রহী নয়। তা যদি না হয়, তাহলে সরকার কেন শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ায় না? 

আজকের পত্রিকা: ইউনেসকোর পরামর্শ, একটি দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত। কিন্তু সরকার এ বরাদ্দ দেয় না কেন?
কামরুল হাসান মামুন: শিক্ষার মান উন্নয়নের প্রধান চাবিকাঠি কী? যদি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসা হয় আর বিপরীতভাবে এখানকার শিক্ষককে ওখানে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন কিন্তু ঢাকায় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে যাবে। তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মান অনেক ওপরে চলে যাবে। এ কথা দিয়ে বোঝাতে চাইছি, যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান আসলে শিক্ষকদের মান দিয়ে বাড়ে। আর শিক্ষকদের মান আমরা কীভাবে বাড়াতে পারি? এ জন্য শিক্ষকতা পেশাকে উন্নত করতে হবে। বাংলাদেশের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের পদ হলো রাষ্ট্রের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর পর্যায়ে। আর তাঁরা এ পর্যায়ের কর্মচারীর মতো বেতন পান; অর্থাৎ যাঁরা অফিস-আদালতে কেরানির কাজ করেন, সেই লেভেলে শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হয়। তাহলে ওই লেভেলে বেতন দিলে এ রকম বাজেটেই যথেষ্ট।

এ রাষ্ট্র তো চায় না শিক্ষকতা পেশাটা আরও উন্নত হোক। কারণ, এ পেশা যত উন্নত হবে, তত ভালো কারিগর পাব এবং ভালো কারিগর পেলে আমরা ভালো মানুষ তৈরি করতে পারব। যখন শিক্ষিত ও সচেতন মানুষ তৈরি হবে, তখন বড় দলগুলো তাদের পার্টির সমাবেশ করার জন্য ট্রাকে করে মানুষ আনতে পারবে না। আসলে সরকার চায় এ দেশের মানুষ প্রকৃত শিক্ষায় মানুষ না হোক। এ কারণে এত কম পরিমাণ বরাদ্দ দেয়। তার মানে কম বেতনে কোনোমতে চালিয়ে নেওয়া।

ভিয়েতনামে যেভাবে বৈদেশিক মুদ্রা বাড়ছে, সেভাবে তো আমাদের দেশে বাড়ছে না। ১২ বছর আগে সে দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ে এক হাজারের মধ্যে ছিল না। কিন্তু এখন সেটা পাঁচ শর মধ্যে চলে এসেছে। কারণ, তারা ১০ বছর ধরে জিডিপির ৪ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি বরাদ্দ দিয়েছে এখাতে।

এ জন্য আমরা র‍্যাঙ্কিংয়ে ও শিক্ষায় ভালো করতে পারছি না। আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে জাতীয় প্রতারণা করছি। যেখানে অনার্স ও মাস্টার্স পড়ানোর জন্য ভালো শিক্ষক নেই, সেখানে আমরা এসব পড়াচ্ছি। কোনোরকমে এক-দুজন শিক্ষক দিয়ে চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। তাই সত্যিকারের শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হলে এই বরাদ্দ দিয়ে হবে না। আমাদের জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করার একটা উপায় হলো শিক্ষা।

আজকের পত্রিকা: শিক্ষা বাজেটের বরাদ্দ কোন খাতে ব্যয় হলে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন হবে?
কামরুল হাসান মামুন: এটা হলো লিডারশিপের বিষয়; সরকার যখন ফিলোসফিক্যালি ভাববে, আমরা শিক্ষাব্যবস্থাকে ঠিক করতে চাই। প্রথম অগ্রাধিকার পাবে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো। দ্বিতীয় অগ্রাধিকার পাবে, শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেল দেওয়া। আর বরাদ্দের বড় অংশ যাবে বেতনে। এমন বেতন দিতে হবে, যাতে শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়াতে না হয়। ফলে শিক্ষকেরা পুরো মনোযোগ দিয়ে ক্লাসে পড়াতে পারবেন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শিক্ষকতা পেশাটাকে আকর্ষণীয় করতে হবে। বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে কোনো শিক্ষার্থী যখন শিক্ষা ক্যাডার পান, তখন তাঁকে অনেকেই অভিনন্দন জানায় না। আর তিনি ও তাঁর মা-বাবাও খুশি হন না। পরেরবার আবার পরীক্ষা দেন প্রশাসন, পুলিশ বা ট্যাক্স ক্যাডার পাওয়ার জন্য। যাঁরা ভালো ছাত্র, তাঁরা এ পেশায় আসতে চান না।

এ জন্য আকর্ষণীয় বেতন স্কেল দিতে হবে। আমাদের দেশের হাজার হাজার ছেলেমেয়ে বিদেশে যায়, কিন্তু ভালো বেতন দিলে তারা সেখান থেকে চলে আসতে উৎসাহিত হবে। তারা কিন্তু বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। বিশ্বের অনেক দেশের সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিদেশে পিএইচডি করানোর জন্য পাঠায়। আর আমাদের ছেলেমেয়েরা বৃত্তি নিয়ে বিদেশে পড়তে যায়। আমরা যদি এ পেশা উন্নত করি, তাহলে তারা চলে আসবে। আর আমরা বাড়তি টাকা খরচ না করে রেডিমেড মানুষ পাব। বিদেশে পড়া ছেলেমেয়েরা যখন দেশে চলে আসবে, সেটাকে ‘ব্রেইন গেইন’ বলা হয়। আমাদের এখন ব্রেইন ড্রেন হচ্ছে। এটাকে রিভার্স করতে হবে। আমরা যদি ব্রেইন গেইন করতে পারি, তাহলে মাত্র পাঁচ বছর লাগবে এ দেশের চেহারা পরিবর্তন করতে।

আজকের পত্রিকা: নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ জরুরি। শিক্ষক প্রশিক্ষণের প্রতি এত অবহেলা কেন?
কামরুল হাসান মামুন: আমাদের শিক্ষাক্রমে ইংরেজি মাধ্যমে যে সিলেবাস আছে, সেটা মোটামুটি ইংল্যান্ডের সমপর্যায়ের। আমাদের ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট ও কোচিংয়ে পড়তে হয়। ইংল্যান্ডে কিন্তু এসব করতে হয় না। কারণ, সেখানে সেই মানের শিক্ষক থাকার ফলে ক্লাসেই সব পড়া হয়ে যায়। আর আমাদের দেশে ভালো মানের বেতন না দেওয়ার কারণে ভালো মানের শিক্ষক নেই। সে কারণে ক্লাসে পড়াশোনা ঠিকমতো হয় না। শিক্ষকেরা ফাঁকিবাজি করেন।

শিক্ষাক্রম হলো একটা আবরণ। মোড়ক পরিবর্তন করলে ভেতরের পণ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। সে কারণে শুধু শিক্ষাক্রম করলে হবে না। আগে ভালো মানের শিক্ষকের ব্যবস্থা করতে হবে। তারপর আসে প্রশিক্ষণের ব্যাপার। যেমন আমি যদি একটা রিকশাওয়ালাকে যতই ভালো মানের প্রশিক্ষণ দিই না কেন, তাঁর দ্বারা ভালো মানের শিক্ষা পাওয়া সম্ভব হবে না।

প্রথম কথা হলো, শুরুতেই মেধাবীদের এ পেশায় আনতে হবে। তারপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশিক্ষণ হলো সেকেন্ডারি ব্যাপার। আমাদের দেশে এখন যা করা হচ্ছে, তারা বুঝতেই পারে না শিক্ষাকে কীভাবে সত্যিকার লাইনে আনতে হবে। তারা মনে করে, কারিকুলাম পরিবর্তন করলেই শিক্ষার উন্নয়ন হবে। কারিকুলাম পরিবর্তন হলো প্রজেক্টের মতো। এখানে অনেক লোক যুক্ত থাকবেন, কোটি কোটি টাকার লেনদেন হবে। গত ১০-২০ বছরে বাংলা মাধ্যমে কারিকুলাম ও পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলো এবং শিক্ষার্থীদের যেভাবে গিনিপিক বানানো হলো, এটা একটা নজিরবিহীন ঘটনা। যেহেতু এটাতে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রভাব পড়ে, এ জন্য পৃথিবীর কোনো দেশে কারিকুলাম ও পরীক্ষা পদ্ধতি সহজে পরিবর্তন করতে চায় না। সর্বোচ্চ ৫ থেকে ১০ শতাংশ করা হয়।

পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই যেখানে শতভাগ পরিবর্তন হয়েছে। কারণ এই পরিবর্তনের ফলে শিক্ষার্থীর কী ধরনের ক্ষতি হবে, আমরা সেটা জানি না। পরিবর্তন করতে হয় অল্প অল্প করে; যাতে ক্ষতিটা পুষিয়ে নেওয়া যায়। কার মাথা থেকে এ ধরনের অদ্ভুত ভাবনা এল যে পুরো কারিকুলাম ও পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে! পৃথিবীর কোনো দেশে এ রকম উদাহরণ নেই। 

আজকের পত্রিকা: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
কামরুল হাসান মামুন: আপনাকেও ধন্যবাদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মালয়েশিয়ায় স্থায়ী বসবাসের সুযোগ, আবেদন ফি মাত্র ১৪ হাজার টাকা

বিএসএফের হাতে আটক বাংলাদেশি পুলিশ কর্মকর্তার পরিচয় মিলেছে

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কাইরান কাজীর বিষয়ে ইলন মাস্কের মন্তব্যে বিস্ময়

অমীমাংসিত বিষয় সমাধানে পাকিস্তানের দাবি নাকচ করল সরকার

১৫ বছর যাদের জন্য লড়াই করলাম, তারা এখন আমাকে ধাক্কা দেয়: রুমিন ফারহানা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত