Ajker Patrika

পদে পদে অনিয়ম, সব নিয়োগ অবৈধ

রাহুল শর্মা, ঢাকা
আপডেট : ২৭ নভেম্বর ২০২২, ১০: ৫০
পদে পদে অনিয়ম, সব নিয়োগ অবৈধ

নিয়োগের বিষয়ে নির্বাচনী বোর্ডের সুপারিশের মূল কপি নেই। ফটোকপি থাকলেও তা টেম্পারিং (ঘষামাজা) করা। পদের বিপরীতে যোগ্যতা নির্ধারণে সিন্ডিকেটের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। এমনকি প্রার্থী এক পদে আবেদন করে নিয়োগ পেয়েছেন অন্য পদে। বাদ দেওয়া হয়েছে মেধাক্রমে এগিয়ে থাকা প্রার্থীকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অনুমোদন লাগলেও নিয়মের তোয়াক্কা না করেই দেওয়া হয়েছে অস্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ। ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে এমন পদে পদে অনিয়মের সত্যতা পাওয়ায় সব ‘অবৈধ’ নিয়োগ বাতিলের সুপারিশ করেছে ইউজিসির তদন্ত কমিটি। দুর্নীতি ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় উপাচার্য আহসান উল্লাহকেও অপসারণ করার সুপারিশ করেছে ইউজিসি।

জানা যায়, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ১৮৬। এদের মধ্যে ২০ জন চুক্তিভিত্তিক, বাকিরা স্থায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত। আটজন শিক্ষকের মধ্যে ছয়জন স্থায়ী আর দুজন অস্থায়ী।

ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় অনিয়মের অভিযোগ পেয়ে ইউজিসি গত বছর প্রথম দফায় তদন্তে নামে। তদন্ত দলের নেতৃত্বে ছিলেন ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন। পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে দ্বিতীয় দফা তদন্ত হয়।

ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দের নেতৃত্বে তদন্ত দলে ছিলেন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব সৈয়দা নওয়ারা জাহানও। তদন্ত দল গত ৬ জুলাই প্রতিবেদন জমা দেয় মন্ত্রণালয়ে। বড় ধরনের অনিয়ম হওয়ায় সব নিয়োগ ‘শুরু হইতে বাতিল’ উল্লেখ করে নতুনভাবে নিয়োগ কার্যক্রম শুরু করার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকার মোহাম্মদপুরের বছিলায় অস্থায়ী ক্যাম্পাসে পরিচালিত হচ্ছে। এটি দেশে উচ্চশিক্ষা প্রদানকারী মাদ্রাসাগুলো অধিভুক্ত করার এখতিয়ারসম্পন্ন প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক আহসান উল্লাহকে ২০১৫ সালের ৪ জানুয়ারি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় দফায় নিয়োগ পান তিনি। 

উপাচার্যের অপসারণ চায় ইউজিসি
দ্বিতীয় দফায় তদন্তে নিয়োগে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অনৈতিক কার্যক্রমের সত্যতা পেয়ে উপাচার্য আহসান উল্লাহকে অপসারণের সুপারিশ করেছে ইউজিসি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. আহসান উল্লাহর বেআইনি ও অনৈতিক কার্যক্রম ও দুর্নীতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়সহ তার ভাবমূর্তি এতটাই ক্ষুণ্ন হয়েছে যে তাকে উপাচার্য পদে বহাল রেখে এ বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব না। তাই উপাচার্যের পদ থেকে তাকে অবিলম্বে অপসারণ করা সমীচীন। একই সঙ্গে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ বিশেষ বাহিনীর মাধ্যমে তদন্তের সুপারিশ করা হলো।’ এ বিষয়ে জানতে অধ্যাপক আহসান উল্লাহকে একাধিকবার ফোন করে এবং এসএমএস পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি। তাঁর কার্যালয়ে গিয়েও সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি। 

নিয়োগের সুপারিশ ‘টেম্পারিং’
তদন্তে নিয়োগ বোর্ডের সুপারিশের অনুলিপি টেম্পারিং বা ঘষামাজা করা এবং মূল কপি না থাকার প্রমাণ মিলেছে। এর জন্য দায়ী করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপরেজিস্ট্রার ড. মো. আবু হানিফাকে। এ অভিযোগে অবিলম্বে তাঁর অপসারণের সুপারিশ করেছে ইউজিসি।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ নির্বাচনী বোর্ডের সুপারিশ/কার্যবিবরণী বিবরণীর মূল কপি না থাকা এবং নিয়োগ নির্বাচনী বোর্ডের সুপারিশ/কার্যবিবরণীর যে ফটোকপি দেওয়া হয়েছে, তা টেম্পারিং করা বলে প্রতীয়মান।’

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘উপাচার্য আবু হানিফার নিকট সকল গোপনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ অফিশিয়াল কাগজপত্র সংরক্ষণ করতেন।তাই টেম্পারিংয়ের দায় তাঁর ওপরই বর্তায়। বেআইনিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত এরূপ অসৎ ব্যক্তিকে অবিলম্বে অপসারণের সুপারিশ করা হলো।’ 
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে আবু হানিফাকে ফোন করা হলে পরিচয় পেয়েই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে একাধিকবার চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। 

তৃতীয় বিভাগ পেয়েও সহকারী রেজিস্ট্রার
ইউজিসি সূত্রে জানা যায়, শিক্ষাজীবনে কোনো তৃতীয় বিভাগ থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী রেজিস্ট্রার পদে সরাসরি নিয়োগ পাওয়া যায় না। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পদে প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। কিন্তু কোনো শর্তই মানা হয়নি সহকারী রেজিস্ট্রার মো. জাকির হোসেনের নিয়োগে। এ জন্য তাঁর নিয়োগকে ‘অবৈধ’ আখ্যা দিয়ে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করেছে ইউজিসি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘উপাচার্য আইনের তোয়াক্কা না করেই ২০১৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি মো. জাকির হোসেনকে অস্থায়ী নিয়োগ দেন।পরে সিন্ডিকেটের দায়িত্বসংক্রান্ত বিধান লঙ্ঘন করে একক ক্ষমতাবলে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে ২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি তাকে স্থায়ী করা হয়। তার শিক্ষাজীবনে একটিতে তৃতীয় বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট পদে প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও স্থায়ী নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে, যা আইনত অবৈধ।’

এ ছাড়া সহকারী রেজিস্ট্রার ফাহাদ আহমদ মোমতাজী এবং পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. জিয়াউর রহমানের নিয়োগকেও অবৈধ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জাকির হোসেন অবশ্য বলেন, ‘যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিজ্ঞপ্তিতে শর্ত শিথিল উল্লেখ করে আমার নিয়োগ হয়েছে। এখানে নিয়মের কোনো ব্যত্যয় হয়নি।’ 

সব নিয়োগই বাতিল চায় ইউজিসি
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে পদের যোগ্যতা নির্ধারণের অনুমোদন নেওয়া হয়নি সিন্ডিকেট থেকে। মেধাক্রমে এগিয়ে থাকা প্রার্থীকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এসব অভিযোগে সেকশন অফিসার, সহকারী প্রোগ্রামার, অডিট অফিসার, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর, ডেটা এন্ট্রি অপারেটর, ফটোমেশিন অপারেটর, অফিস সহায়ক, নিরাপত্তা সহকারীসহ সব নিয়োগ বাতিল করার সুপারিশ করেছে ইউজিসি। এতে বলা হয়েছে, এসব নিয়োগ ‘শুরু হতেই বাতিল’।  ইউজিসি পুনরায় উন্মুক্ত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণ করে নিয়োগ কার্যক্রম শুরু করতে বলেছে। এ ক্ষেত্রে যাঁরা কর্মরত, তাঁদেরও যোগ্যতা সাপেক্ষে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে বলেছে তদন্ত দল। 

ব্যবস্থা নেওয়ার কাজ চলছে 
এ বিষয়ে ইউজিসির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনিয়মের বিষয়ে একাধিকবার তদন্ত হয়েছে। তদন্তে নিয়োগে দুর্নীতিসহ নানা বিষয় উঠে এসেছে। আমরা এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেছি। এখন তারাই ব্যবস্থা নেবে।’

তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে কবে নাগাদ ব্যবস্থা নেওয়া হবে, জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) মো. আবু ইউসুফ মিয়া বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে ব্যবস্থা নেওয়ার কাজ চলছে। এর বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়। 

দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায় টিআইবি
নিয়োগে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনিয়ম ও দুর্নীতি রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য অশনিসংকেত। তাই এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত