Ajker Patrika

রমজান: কারও মধুমাস কারও সর্বনাশ

মামুনুর রশীদ
আপডেট : ২৮ এপ্রিল ২০২২, ০৯: ৫০
রমজান: কারও মধুমাস কারও সর্বনাশ

‘কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ’। এ প্রবাদটি বর্তমানে পরিবর্তন করার সময় এসেছে। এখন বলতে হবে, ‘হায়রে রমজান মাস, কারও মধু মাস, কারও সর্বনাশ’। পুরো একটি মাস রোজা রাখার সময় সৎ নাগরিকেরা এক ভয়ংকর যুদ্ধের মধ্যে দিন কাটান। তাঁদের দিনযাপনের বাজেট একের পর এক ধসে যেতে থাকে। সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় তিনি দিনের পর দিন অসহায় হতে থাকেন। আর এরই মধ্যে বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হন খাদ্যদ্রব্য ও জামাকাপড়ের ব্যবসায়ীরা। অদ্ভুত সব ছুতো দাঁড় করান। যেমন এবারের ছুতো তেলের দাম বেড়ে গেছে। যেহেতু যুদ্ধ চলছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে, তেলের সরবরাহে একটু ঘাটতি দেখা দিয়েছে ঠিক। দেশে অকটেনের দাম তেমন বাড়েনি, তবু চাল ব্যবসায়ী থেকে ভোজ্যতেল এবং দেশের শাকসবজির দাম বাড়িয়ে ব্যবসায়ীরা চিৎকার করে বলছেন, তেলের দাম বেড়ে গেছে, সেই জন্য চালের দামও বাড়ছে।

পরিবহন মালিকদের তো কথাই নেই। আবার কাঁচা তরিতরকারির দামও বাড়ছে। যুদ্ধ হচ্ছে সেই সুদূর রাশিয়ায় আর তরকারির দাম বেড়ে গেল শেরপুরে। চাঁদপুরে দাম বেড়ে গেল ইলিশ মাছের। কাপড়চোপড়ের দাম বেড়ে গেল নবাবপুরে। ১৯৪২ সালেও তা-ই হয়েছিল। যুদ্ধ শুরু হলো। বাংলায় প্রচুর ফসল ফলল, কিন্তু দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে গেল। ব্যবসায়ীদের গুদাম ভরা চাল-ডাল অথচ দেখা গেল মানুষ অনাহারে থাকছে, লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। দিন শেষে রিক্ত হাতে ফিরে আসছে।

এ রকম ঘটনা আরও ঘটেছিল; ১৭৭৬ সালের মন্বন্তর লাখ লাখ মানুষকে অনাহারে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিল। সেই সময় অবশ্য ব্যবসায়ী বলতে ছিল সদ্য স্বাধীন নবাবকে হত্যা করে দখল করা ব্রিটিশ বেনিয়ারা। জোর করে এই ব্রিটিশ বেনিয়ারা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের বঞ্চিত করে অল্প মূল্যে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলোকে কিনে নিয়ে পাচার করে দিত। বৈপরীত্যটা দেখুন। কিছুদিন আগেও যেখানে টাকায় তিন মণ চাল পাওয়া যেত, পাচার হওয়া শুরু হলে সেই টাকায় মিলত ছয় সের চাল। ব্রিটিশের সেই শিক্ষা এখনো বিদ্যমান আছে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে।

ব্যবসায়ীরা আমাদের দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেননি বটে, কিন্তু দখল করে বসে আছেন আমাদের সংসদ, যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এই রমজান মাসেই যেন তাঁদের লোভ-লালসা স্ফীত হতে থাকে। কয়েক দশক ধরে ইফতার পার্টি উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের মাঝে একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। ইফতার পার্টির জন্য বুফে খাবারও তাঁদের এক নয়া সংস্কৃতি। বুফেতে ৭৫০ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত প্লেটপ্রতি ইফতার একটা নিত্যদিনের ব্যাপার। এই রমজানের মুনাফা দিয়েই তাঁরা হজব্রত পালন করতে যান, ব্যবসার সম্প্রসারণ করেন, সপরিবারে বিদেশ ভ্রমণের আনন্দ ভোগ করেন। কিন্তু ধর্ম পালনে তাঁদের জুড়ি নেই, নিজেরা রোজা রেখে ফকির-মিসকিন খাইয়ে নিজেদের মুনাফা বৃদ্ধি করতে একটা বড় ধরনের বাতাবরণ তৈরি করেন।

মামুনুর রশীদএ কথা অনেকবার বলা হয়েছে এবং আমরা সবাই জানি যে পৃথিবীর সব দেশে উৎসবের সময় জিনিসপত্রের দাম কমে যায়। রমজান মাসে এই সব ব্যবসায়ীর কাছে পবিত্র স্থান সৌদি আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে জিনিসপত্রের দাম প্রায় অর্ধেকে চলে আসে। ক্রিসমাসে পশ্চিমা দেশে একই অবস্থা হয়। ভারতে পূজার সময় জিনিসপত্রের দাম ততটা না কমলেও বাজারে প্রচুর পণ্যের সরবরাহ থাকে। চীনে বা ইরানে নববর্ষে মানুষ একই সুযোগ-সুবিধা পায়। কিন্তু বাংলাদেশে জিনিসপাতির দাম তো বাড়বেই এবং এই যে দাম বাড়া পরবর্তীকালে তা আর কমবে না।

চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ, ঢাকার চকবাজারে তাঁরা জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার অছিলায় সব জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে বসে থাকেন। আবার এই রমজানেই অবৈধ অর্থের ব্যাপক লেনদেন হয়। অফিসে বসে নামাজ পড়ার আগে ও পরে ঘুষ লেনদেন করে বিপুল অর্থের মালিক হন সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তারা। ঈদের খরচ তোলার এটা এক মোক্ষম সময়। তাঁদের কাছে দ্রব্যমূল্য বাড়লে কিছুই যায়-আসে না। কারণ এমনিতেই বেতন দ্বিগুণ হয়েছে, বোনাসও পাবেন, সেই সঙ্গে প্রচুর অবৈধ অর্থের লেনদেন।

পঁয়তাল্লিশ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ হবে। পরীক্ষা শুরু হয়েছে। তার আগে থেকেই লাখ লাখ টাকার লেনদেন চূড়ান্ত প্রায় এবং এই টাকার বণ্টন একেবারে তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাবে। হাজার হাজার দালাল অত্যন্ত সক্রিয়। দ্রব্যমূল্য বাড়াতে এরা বড় ভূমিকা পালন করে। যে জামাটির দাম সর্বোচ্চ ২০০ টাকা হওয়ার কথা তা অবলীলায় ৫০০ টাকায় কিনে নিয়ে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, এই সময়ে অত্যন্ত সৎ কর্মকর্তারাও ভেট গ্রহণ করে থাকেন। এই ভেটের মধ্যে আছে দামি শাড়ি, পাঞ্জাবি, বাহারি জামা ইত্যাদি। পোলাওর চাল, গরু, খাসি, মুরগির গোশত—এসবও মণকে মণ ক্ষমতাসীনদের বাড়িতে আসতে শুরু করে।

অবৈধ অর্থের দ্বারা একটা ভোক্তা সমাজ বহুদিন ধরে আমাদের বাজারমূল্যকে স্ফীত করে রাখছে। আগে দুর্নীতির ক্ষেত্র ছিল সরকারি অফিস-আদালত। এখন তা সম্প্রসারিত হয়েছে বেসরকারি এমনকি প্রাইভেট কোম্পানি পর্যন্ত। আমরা অসাধু কর্মচারীদের ঢেউ গুনে পয়সা নেওয়ার গল্প শুনেছি। সেই গল্প এত বাস্তবে রূপ নিয়েছে যে তাকে আর গল্প বলা যায় না, তা এখন কঠোর বাস্তব। এই বাস্তবতার বা রমজানের এই যে লুটপাটের কাহিনি, তার সুবিধা ভোগ করছে আঠারো কোটির লোকের মধ্যে মাত্র কয়েক লাখ। বাকিরা দ্রব্যমূল্যে, পরিবহন খরচ, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছে। সারা দেশের দোকানপাটে এই লাখ লোকের দাপট ঈদের আগের দিন রাত পর্যন্ত চলবে।

কিন্তু সরকারের মন্ত্রী, আমলা, তাঁরা কিন্তু সমস্বরে বলেই যাচ্ছেন দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিকই আছে। এই সময়ে যদি দুদকের প্রামাণ্যচিত্রে বা বিজ্ঞাপনে দেখানো বাহিনী সন্দেহভাজনদের বাড়ি রেইড করে তাহলে লাখ থেকে কোটি টাকার সন্ধান পাবে। কিন্তু দুদক এ ব্যাপারেও প্রাণপণে উদাসীন। বাজারে এত টাকা কোথা থেকে আসে? অন্য কোনো গ্রহ থেকে টাকা এসে কি সয়লাব করে দিয়ে যায়? এতগুলো ব্যাংক, এই ব্যাংকের মালিকগুলো কারা, তারাও কি ভিন্ন গ্রহের মানুষ? এ নিয়ে তেমন বড় কোনো গবেষণার প্রয়োজন নেই। এই যে পাতালরেলের নিরীক্ষা করার জন্য জনগণের ৩২১ কোটি টাকা জলে গেল, সেই টাকা কি সবটাই বিদেশিরা খেয়ে গেল? এটা তো এক ছোটখাটো ঘটনা। কিন্তু প্রতিদিন এই যে লাখ-কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে, এই সব অসাধু অর্থের ব্যাপারে ধর্মে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। এই সব অসাধু লোকেরা নামাজ, রোজা, তারাবি সবই পালন করেন। কিন্তু পাপকার্য থেকে মোটেই বিরত হন না। তার মানে সত্যিকার অর্থে আল্লাহর প্রতি ভয় বা পবিত্র কোরআন-হাদিসের প্রতি তাঁদের আনুগত্য একেবারেই নেই। তাঁরা কেমন করে যেন বুঝে ফেলেছেন এসব করা জায়েজ এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল, একসময় তিনি ক্ষমা করে দেবেন এবং কোনো একসময় একটা মাদ্রাসা বা মসজিদ করে দিলেই পাপমুক্তি হয়ে যাবে। আজকাল অনেক অবৈধ অর্থ উপার্জনকারী ব্যবসায়ী-আমলা নির্বাচন করার আগে গ্রামে একটি মসজিদ কিংবা মাদ্রাসা করে ফেলেন। ঈদে বা কোনো ধর্মীয় উৎসবে জামা-কাপড় বিলি-বণ্টন করে তাতেই তাঁদের পাপ স্খলন হয়ে যায় এবং নির্বাচনে জয়যুক্ত হয়ে যান। যে কারণে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার-চেয়ারম্যান কোটি টাকা খরচ করে নির্বাচনে অংশ নেন। হারলেও অসুবিধা নেই। এই টাকার জন্য ইনকাম ট্যাক্সের ধার ধারতে হয় না, কালোটাকা সাদা হয়ে যায়।

তার মানে শুধু রমজান মাস নয়, বছরব্যাপী এ দেশের কোটি কোটি মানুষ এই চক্রের হাতে বন্দী হয়ে এক মানবেতর জীবনযাপন করছে। ধর্মহীন, মানবতাহীন, এই সব মানুষের একটা যোগ্য আস্তানা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ, যেখানে আইন আছে, কিন্তু আইনের শাসন নেই। বিশাল বিশাল প্রতিষ্ঠান নজরদারিতে থাকার কথা। নজরদারি তো দূরের কথা, এই লোকেরা সব সময় সালাম দিয়ে দিয়ে অভ্যস্ত।

আরেকটি বিষয়, সেটি হচ্ছে সব জায়গায় এই বুদ্ধিমানেরা জনগণের জন্য সুযোগগুলো সংকুচিত করে রাখে। ট্রেনের অগ্রিম টিকিট দেওয়া হবে, প্রতিদিন খবরের কাগজে ছবি ছাপা হচ্ছে। হাজার হাজার লোক টিকিটের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছে অথচ টিকিট পাচ্ছে না। প্রতিদিন কালোবাজারিও ধরা পড়ছে। পাশের দেশ ভারতে ট্রেন যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। তারা উৎসবে যাতায়াতের জন্য একটা ব্যবস্থা করে রেখেছে। চীন-জাপানেও এ রকম ব্যবস্থা আছে। শত শত আমলা সরকারি কর্মকর্তা বিদেশে ট্রেনিং নিতে যান। বোঝা যায় তাঁরা মাথায় কিছু নেন না, হাতে-কাঁধে প্রচুর শপিং ব্যাগ নিয়ে দেশে ফেরেন। তবে এ শুধু শুকনো সাবধান বার্তা নয়, ইতিহাসে দেখা গেছে এই ব্যবস্থার মধ্য থেকে একটা প্রবল পরিবর্তন আসে। সেই পরিবর্তনের মুখে নিজেদের অবৈধ সম্পদ রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

চাকরির নামে মিরপুর-শেওড়াপাড়ায় বাসায় ডেকে নারীর সঙ্গে ভিডিও ধারণের পর টাকা হাতিয়ে নিত ‘হানি ট্র্যাপ’ চক্র

দনবাস চান পুতিন—ন্যাটো তো নয়ই, পশ্চিমা সেনাও থাকবে না ইউক্রেনে

তথ্য যাচাইয়ের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করবেন—ইউটিউব চ্যানেলে সিইসির বার্তা

দুস্থদের ৩৪ লাখ টাকা নিয়ে লাপাত্তা মোহনগঞ্জ সমাজসেবা কর্মকর্তা

ফরিদপুরে চিকিৎসকের ওপর হামলার প্রতিবাদে সেবা বন্ধের ঘোষণা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত