Ajker Patrika

কৃত্রিম পর্যটন

সাজিদ মোহন
আপডেট : ১৭ মে ২০২২, ১৩: ০১
কৃত্রিম পর্যটন

সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সুন্দরবনের গাছপালা কেটে গড়ে তোলা হচ্ছে ইট-কংক্রিটের কথিত ‘ইকো ট্যুরিজম পার্ক’। বনের মধ্যে পর্যটকদের হাঁটার জন্য নির্মাণ করা হবে তিন কিলোমিটার আরসিসি রাস্তা, ৩০টি বেঞ্চ ও ১০টি ডাস্টবিন। এর সবই হবে কংক্রিটের। পর্যটনকেন্দ্রে কংক্রিটের খাঁচার মধ্যে রাখা হবে হরিণ ও কুমির।

আরেকটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, খাগড়াছড়ির আলুটিলা পর্যটনকেন্দ্রকে সাজানো হয়েছে নতুন রূপে। ইট-বালু-সিমেন্ট-রড দিয়ে তৈরি করা হয়েছে কথিত ‘নন্দনকানন’। সবুজ পাহাড়কে ঢেকে দেওয়া হয়েছে কংক্রিটের আস্তরণে। নির্মাণাধীন রয়েছে চারতলাবিশিষ্ট একটি রেস্টহাউসও।

ঠিক এভাবেই কংক্রিটের শক্ত-কঠিন চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল বান্দরবানের নীলাচল ও নীলগিরি পাহাড়, উপবন হ্রদ; চট্টগ্রামের ফয়’স লেক, পতেঙ্গা সি বিচ; মৌলভীবাজারের মাধবকুণ্ড ঝরনাসহ দেশের বিভিন্ন প্রাকৃতিক পর্যটনকেন্দ্র।

অবিকৃত অবস্থায় চট্টগ্রামের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ পাহাড় ও লেকের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ফয়’স লেকে যাওয়ার সুযোগ যাঁদের হয়েছিল, এখন গিয়ে দেখবেন রংচং দিয়ে সেখানে বানানো হয়েছে বীভৎস গেট। ভেতরে তথাকথিত পর্যটনসামগ্রী—বোট রাইড, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি। পুরো এলাকা বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যের দখলে, নানা স্থাপনা করে ঢেকে ফেলা হয়েছে প্রকৃতি। তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিম পার্ক। আগে লেক-পাহাড়ের যে অসাধারণ রূপ দেখা যেত, তা এখন খুঁজে পাওয়া কঠিন। বেসরকারি খাতে ইজারা দিয়ে অবরুদ্ধ করে ফেলা হয়েছে ফয়’স লেক। চট্টগ্রাম শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত যেসব জায়গা ছিল, উন্নয়ন আর আধুনিকায়নের নামে একে একে সেগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। কোনো কংক্রিটের স্থাপনা গড়ে উঠলে সমুদ্রসৈকতের সৌন্দর্য ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা সৈকতকে বাণিজ্যিকীকরণের জন্য ব্যবহার না করতে বিশেষজ্ঞ ও সুশীল সমাজের পরামর্শের পরও রক্ষণাবেক্ষণের অজুহাত দেখিয়ে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের একাংশকে প্রাইভেট জোন ঘোষণা করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়ার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। ঝাউবন উজাড় করে গড়ে উঠেছে ইট-পাথরের অসংখ্য স্থাপনা।

বনের পরিবেশ থাকবে বনের মতো। পাহাড় ও সমুদ্রের পরিবেশ হবে নিজস্ব। প্রকৃতির কাছে মানুষ যায় তার সৌন্দর্য উপভোগ করতে। প্রকৃতিতে স্থাপনা নির্মাণ কেন? বনের ভেতর চিড়িয়াখানার মতো হাস্যকর স্থাপনাও হচ্ছে। পর্যটকেরা ইট-পাথরের স্থাপনা নয়, দেখতে যান নিটোল প্রকৃতি। কংক্রিটের রাস্তার চেয়েও বন, পাহাড়, সাগরতীরের মাটি, বালু ও কাঠের তৈরি রাস্তাই তাঁদের বেশি টানে। এ জন্যই পর্যটকেরা কৃত্রিম পর্যটনকেন্দ্র ছেড়ে প্রকৃতির স্বাদ ও গন্ধ পেতে বারবার ছুটে যান চট্টগ্রামের খৈয়াছড়াসহ দুর্গম সব ঝরনায়; বান্দরবানের দেবতাখুম, নাফাখুম, আমিয়াখুম জলপ্রপাতে; সিলেটের রাতারগুল, বিছানকান্দি; সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরসহ দেশের আদি ও অকৃত্রিম সব প্রকৃতির অভয়ারণ্যে।

প্রকৃতির স্বাদ ও গন্ধ পেতে আধুনিক নগর স্থাপত্যশৈলীতেও স্থপতিরা নিয়ে এসেছেন প্রকৃতির ছোঁয়া ও সবুজের উপস্থিতি। স্থাপত্যে প্রকৃতির উপস্থিতি, সঙ্গে বাতাস চলাচলের সুব্যবস্থা, গাছপালা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক অনুষঙ্গের ছোঁয়া ভবনের ভেতরের পরিবেশকে করে তুলছে আরও প্রাণবন্ত। প্রকৃতির কোনো বৈশিষ্ট্য নকল করে অথবা প্রকৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন আরও প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহারের মাধ্যমে প্রকৃতির সঙ্গে সরাসরি সংযোগ গড়ে তোলাই ‘বায়োফিকিল আর্কিটেকচার’ নামের এই স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য। পরিবেশবান্ধব ভবনের নকশা করে একাধিক বাংলাদেশি স্থপতি পেয়েছেন একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার।

করোনা মহামারির পর বিশ্বব্যাপী প্রকৃতি রক্ষার আন্দোলন আরও বেগবান হয়েছে। শহুরে বসতিতেও চেষ্টা চলছে প্রকৃতির সম্মিলন ঘটানোর। মানুষ আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে প্রকৃতির গুরুত্ব। ইকো ট্যুরিজম তথা পরিবেশগত পর্যটনের মাধ্যমে একজন প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ প্রকৃতির ঐশ্বরিক সৌন্দর্য অধ্যয়ন ও উপভোগ করে। ইকো ট্যুরিজম প্রবর্তন ও প্রচারের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো স্থানীয় পরিবেশের সংরক্ষণ, অর্থনৈতিক-সামাজিক বিকাশ ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সংরক্ষণ।

আমরা হাঁটছি উল্টোপথে। ইকো ট্যুরিজমের ভুল দীক্ষা নিয়ে টিলা-পাহাড় কেটে, বৃক্ষনিধন ও বন্য প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস করে, কংক্রিটের অবকাঠামো বানিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থানগুলোতে তৈরি করছি কৃত্রিম পার্ক ও বিনোদনকেন্দ্র।

সাজিদ মোহন, শিশুসাহিত্যিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

অপারেশন সিন্দুর ঘিরে আলোচিত কে এই কর্নেল সোফিয়া কুরেশি

কাশ্মীরে বিধ্বস্ত বিমানের অংশবিশেষ ফরাসি কোম্পানির তৈরি, হতে পারে রাফাল

সীমান্তে সাদা পতাকা উড়িয়ে আত্মসমর্পণের ইঙ্গিত দিয়েছে ভারত: পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী

নিজ কার্যালয়ে র‍্যাব কর্মকর্তার গুলিবিদ্ধ লাশ, পাশে চিরকুট

আকাশ প্রতিরক্ষায় কে এগিয়ে, পাকিস্তান কি ভারতের আক্রমণ ঠেকাতে সক্ষম

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত