শাইখ সিরাজ
বাংলাদেশ, বঙ্গোপসাগর উত্থিত এই বদ্বীপে মূলত কৃষিনির্ভর সমাজের সূচনা হয়। হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত বাংলার জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতি কৃষিনির্ভর। এখানে জীবনের সব অনুষঙ্গই রচিত হয়েছে কৃষকের চিন্তা, শক্তি, প্রয়াস ও উদ্যোগ ঘিরে। কৃষক তথা মেহনতি মানুষই শাসন-শোষণের প্রচলিত বৃত্তগুলো ভেঙেছেন। মানুষের জন্য নতুন নতুন পথ তৈরি করেছেন। জীবনকাঠামো এগিয়ে নিয়েছেন।
ইতিহাসের একটু পেছন ফিরে তাকালেই দেখা যায়, সুবিধাভোগী উচ্চবিত্ত শ্রেণি প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো দিন আন্দোলনে নামেননি; বরং তাঁরা আপস করেছেন। আর সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন রচনা করেছেন একেবারে তৃণমূল জনগোষ্ঠী। তেভাগা কিংবা নীল চাষবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে এই বাংলার সব বিদ্রোহ-আন্দোলনের পেছনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন গ্রামীণ জনগোষ্ঠী;
বিশেষ করে কৃষক। কৃষকের স্বপ্নসাধের পথ ধরেই রচিত হয়েছে সমাজ বিনির্মাণের রূপরেখা। শোষকের বিরুদ্ধে সূচিত হয়েছে একেকটি আন্দোলন।
সেখানে সবচেয়ে বড় ত্যাগ স্বীকার করেছেন তৃণমূলের সাধারণ মানুষ—কৃষক। ব্রিটিশবিরোধী সিপাহি আন্দোলনে অধিকাংশ সুবিধাভোগী জমিদারই ব্রিটিশদের পক্ষাবলম্বন করেছেন। সুবিধাভোগীরা সংগ্রাম করে না, করে বঞ্চিতরা। আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নসাধও রচিত হয়েছে কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর শোষণ, বঞ্চনা, উপেক্ষার পটভূমি সামনে নিয়ে। আমি ২০০৭ সালে গিয়েছিলাম দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে।
সেখানে তালপুকুর নামে একটি জায়গা তেভাগা আন্দোলনের রণাঙ্গন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ওই যুদ্ধের স্থানীয় সংগঠকদের মধ্যে শরৎচন্দ্র মণ্ডল, বীরেন মণ্ডলের সঙ্গে আমার কথা হয়। তাঁরা এখন আর বেঁচে নেই। সেদিন তাঁরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন, তা কারও ব্যক্তিগত স্বার্থে ছিল না। তাঁরা চেয়েছিলেন গোটা বাংলার কৃষকের মুক্তি। নির্যাতিত-নিপীড়িত বহু বছরে পুঞ্জীভূত দাবি আদায়ের লক্ষ্যেই তাঁরা সেদিন নিজের জীবন বাজি রেখেছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ রাজত্ব শেষে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল এবং মোট রপ্তানি আয়ের বড় অংশটি আসত পূর্ব পাকিস্তানে উৎপাদিত পাট থেকে।
কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক সুবিধা আনুপাতিক ছিল না। বছরের পর বছর আঞ্চলিক ভিত্তিতে ক্রমাগত বৈষম্যের শিকার হতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। এ বৈষম্যমোচনের পথ হিসেবেই আসে স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্ন। এর চূড়ান্ত রূপরেখা হিসেবে আসে ঐতিহাসিক ছয় দফা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষকের বঞ্চনা বিশ্লেষণ করে ছয় দফা দাবি উত্থাপনের পর পাকিস্তানি শাসকদের টনক নড়ে যায়। যার পরতে পরতে ছিল কৃষকের বঞ্চনামুক্তির দাবি-দাওয়া। তাঁদের আশা-প্রত্যাশার কথা। পরে ১৯৬৯ সালে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ যে ১১ দফা প্রণয়ন করে, সেখানে আরও বেশ কিছু দাবি সংযোজিত হয়। এই ১১ দফায় পূর্ণতা পায় এ দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের দাবিগুলো। আমরা দেখি, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ দেশের ছাত্র আন্দোলনের ভূমিকা শুরু হয়। পরে বাষট্টি সালের হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তাঁদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সক্রিয়। অতঃপর আটষট্টি সালের ডিসেম্বর থেকে উনসত্তর সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছাত্ররা যে এক সুসংবদ্ধ ও সফল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তা ইতিহাসে বিরল, যা তাঁরা ঐতিহাসিক ১১ দফা দাবি পেশ করে এর সূচনা করেছিলেন। সে সময়ের ছাত্রনেতারা তখন আন্দোলনের শক্তি সঞ্চয়ের জন্য গ্রামে চলে যেতেন।
কৃষকের চাহিদা নিরূপণ করতেন। দেশের সংকটগুলো বিশ্লেষণ করতেন। দেশের সামগ্রিক চিত্র হৃদয়ে আঁকার জন্য তাঁদের বারবার গ্রামের কৃষিজীবী মেহনতি মানুষের সান্নিধ্য, তাঁদের ভাষা, তাঁদের জীবনীশক্তিকে গ্রহণ করতে হয়েছে।
ডাকসুর সাবেক ভিপি তোফায়েল আহমেদ, সে সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, একাত্তরে ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীসহ অনেকের সঙ্গেই আলোচনা করেছি। তাঁরা বলেছেন, একাত্তরের পটভূমি রচনার পেছনে বাংলার কৃষি ও কৃষকের নিবিড় এক প্রভাব রয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুও তাঁর প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্বদানের ক্ষেত্রে কৃষকের সেই ভূমিকাকে সবচেয়ে বেশি সামনে এনেছেন। এর পথ ধরেই আসে একাত্তরের মার্চ। সাতই মার্চের ভাষণে ঝাঁপিয়ে পড়া সমবেত লাখো মানুষের প্রায় সবাই ছিলেন কৃষক শ্রমিক সাধারণ মানুষ। বঙ্গবন্ধুর আত্মবিশ্বাসের জায়গাটিও ছিল কৃষক। আহ্বানও ছিল এই সাধারণ মেহনতি মানুষের উদ্দেশেই। এ ভাষণ পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অমর মহাকাব্য। ইউনেসকো স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এ ভাষণ ছিল একটি জাতির দিকনির্দেশনা ও আত্মপরিচয়ের প্রধান ক্ষেত্র। এটিই ছিল স্বাধীনতাসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার মূলমন্ত্র। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে তাঁরাই অংশ নিয়েছিলেন যাঁরা পাকিস্তানিদের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। এটি ছিল তাঁদের শোষণমুক্তির যুদ্ধ। স্বাধীন ভূমিতে ফসল ফলানোর চূড়ান্ত তাগিদ। পরাধীনতার গ্লানি ঘোচাতে, অর্থনৈতিক মুক্তি লাভ করতে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ছাড়া আর তাঁদের সামনে কোনো পথ খোলা ছিল না।
মুক্তিযুদ্ধে গ্রামবাংলার সাধারণ কৃষকের ভূমিকা প্রশ্নাতীত একটি বিষয়। তাঁদের বীরত্বগাথা ইতিহাসের এক সোনালি অধ্যায়। সুদীর্ঘ বঞ্চনার পথ পেরিয়ে এসে তাঁরা নিজের জীবনকে তুচ্ছ করেছেন। সবাই ভেবেছেন জীবনের বিনিময়ে একটি স্বাধীন দেশ পেলে তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হবে নিরাপদ এক আবাস ক্ষেত্র। তাই যে হাতে তাঁরা লাঙল ঠেলেছেন, ধান কেটেছেন, নৌকার দাঁড় টেনেছেন, জীবিকার জন্য প্রাণান্ত শ্রম দিয়েছেন, সেই হাত তাঁদের উদ্যত হয়েছিল শত্রুর মোকাবিলায়।
মুক্তিসংগ্রাম ধারণার মধ্যে দুটি উপাদান আছে। একটি হলো জাতীয় মুক্তি এবং অন্যটি অর্থনৈতিক, সামাজিক, শ্রেণিগত শোষণমুক্তি।আর এই মুক্তির মন্ত্রক ছিল আমাদের কৃষক সমাজ। আমরা দেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনের স্মৃতিক্ষেত্রে গিয়েছি। কুষ্টিয়ার দুর্বাচারা বংশীতলার এখনো জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের জবানিতে পাই মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনার কথা। তাঁরা অকপটে বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে যাঁরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তাঁদের শতভাগই ছিলেন গ্রামের মানুষ, তাঁদের মধ্যে ৯৮ ভাগই কৃষক। ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধারাও বলেন একই কথা। তখন কৃষকের ঘরের সন্তান টগবগে তরুণেরা কেবলই প্রবেশ করবেন সংসারজীবনে। কেউ যাবেন চাকরিতে। সবকিছু ফেলে তাঁরা আগে ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার সংগ্রামে। নারায়ণগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বন্দরের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গিয়েছিলাম অনেক দিন আগে। তাঁরাও শুনিয়েছেন একই চেতনার সুর।
সেদিনকার পূর্ব পাকিস্তানের ৫৫ হাজার বর্গমাইলের একটি গ্রাম। ১৬টি জেলা সদরের বাইরেই ছিল বিস্তীর্ণ কৃষিভূমি। গ্রামের ঘরবাড়ি, কয়েকটি চায়ের দোকান, দু-একটি আড়ত আর তরিতরকারি ও মুদিদোকানের বাইরে ছিল মেঠোপথ, কৃষিজমি, জলাভূমি, গাছের ছায়া।সেখানে শহুরে অট্টালিকা আর নাগরিক আভিজাত্যের স্থান ছিল না। কৃষক ছিলেন সবকিছুর মূলে। তাঁরাই ছিলেন ঐতিহ্যের বাহক।
এখনো যুদ্ধদিনের সবচেয়ে গভীর স্মৃতিচিহ্ন, কষ্ট, যন্ত্রণা, স্বজন হারানোর বেদনা গ্রামের সাধারণ কৃষকই বেশি বহন করে চলেছেন। আবার তাঁরাই দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করছেন। স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণে তাঁরা ঠিকই তাঁদের শপথ ধরে রেখেছেন। একচুলও সরে যাননি একাত্তরের সেই চেতনা থেকে। আমাদের জীবনধারার সব ক্ষেত্রে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছি বিশ্বায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে। বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা। কিন্তু তা বাস্তবায়নের পথ কতটা কৃষি ও কৃষককে কেন্দ্র করে, প্রশ্ন থেকেই যায়।
বিজয়ের এ মাসে আমরা আবারও মেহনতি মানুষের কথাই ভাবতে চাই। ভাবতে চাই গ্রামের সাধারণ মানুষের কথা। যাঁরা ছাড়া আমাদের আত্মপরিচয় থাকে না। একাত্তরের সব শহীদ, বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ দেশের আপামর কৃষিজীবী মানুষের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।
লেখক: পরিচালক ও বার্তা প্রধান, চ্যানেল আই
বাংলাদেশ, বঙ্গোপসাগর উত্থিত এই বদ্বীপে মূলত কৃষিনির্ভর সমাজের সূচনা হয়। হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত বাংলার জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতি কৃষিনির্ভর। এখানে জীবনের সব অনুষঙ্গই রচিত হয়েছে কৃষকের চিন্তা, শক্তি, প্রয়াস ও উদ্যোগ ঘিরে। কৃষক তথা মেহনতি মানুষই শাসন-শোষণের প্রচলিত বৃত্তগুলো ভেঙেছেন। মানুষের জন্য নতুন নতুন পথ তৈরি করেছেন। জীবনকাঠামো এগিয়ে নিয়েছেন।
ইতিহাসের একটু পেছন ফিরে তাকালেই দেখা যায়, সুবিধাভোগী উচ্চবিত্ত শ্রেণি প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো দিন আন্দোলনে নামেননি; বরং তাঁরা আপস করেছেন। আর সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন রচনা করেছেন একেবারে তৃণমূল জনগোষ্ঠী। তেভাগা কিংবা নীল চাষবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে এই বাংলার সব বিদ্রোহ-আন্দোলনের পেছনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন গ্রামীণ জনগোষ্ঠী;
বিশেষ করে কৃষক। কৃষকের স্বপ্নসাধের পথ ধরেই রচিত হয়েছে সমাজ বিনির্মাণের রূপরেখা। শোষকের বিরুদ্ধে সূচিত হয়েছে একেকটি আন্দোলন।
সেখানে সবচেয়ে বড় ত্যাগ স্বীকার করেছেন তৃণমূলের সাধারণ মানুষ—কৃষক। ব্রিটিশবিরোধী সিপাহি আন্দোলনে অধিকাংশ সুবিধাভোগী জমিদারই ব্রিটিশদের পক্ষাবলম্বন করেছেন। সুবিধাভোগীরা সংগ্রাম করে না, করে বঞ্চিতরা। আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নসাধও রচিত হয়েছে কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর শোষণ, বঞ্চনা, উপেক্ষার পটভূমি সামনে নিয়ে। আমি ২০০৭ সালে গিয়েছিলাম দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে।
সেখানে তালপুকুর নামে একটি জায়গা তেভাগা আন্দোলনের রণাঙ্গন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ওই যুদ্ধের স্থানীয় সংগঠকদের মধ্যে শরৎচন্দ্র মণ্ডল, বীরেন মণ্ডলের সঙ্গে আমার কথা হয়। তাঁরা এখন আর বেঁচে নেই। সেদিন তাঁরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন, তা কারও ব্যক্তিগত স্বার্থে ছিল না। তাঁরা চেয়েছিলেন গোটা বাংলার কৃষকের মুক্তি। নির্যাতিত-নিপীড়িত বহু বছরে পুঞ্জীভূত দাবি আদায়ের লক্ষ্যেই তাঁরা সেদিন নিজের জীবন বাজি রেখেছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ রাজত্ব শেষে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল এবং মোট রপ্তানি আয়ের বড় অংশটি আসত পূর্ব পাকিস্তানে উৎপাদিত পাট থেকে।
কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক সুবিধা আনুপাতিক ছিল না। বছরের পর বছর আঞ্চলিক ভিত্তিতে ক্রমাগত বৈষম্যের শিকার হতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। এ বৈষম্যমোচনের পথ হিসেবেই আসে স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্ন। এর চূড়ান্ত রূপরেখা হিসেবে আসে ঐতিহাসিক ছয় দফা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষকের বঞ্চনা বিশ্লেষণ করে ছয় দফা দাবি উত্থাপনের পর পাকিস্তানি শাসকদের টনক নড়ে যায়। যার পরতে পরতে ছিল কৃষকের বঞ্চনামুক্তির দাবি-দাওয়া। তাঁদের আশা-প্রত্যাশার কথা। পরে ১৯৬৯ সালে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ যে ১১ দফা প্রণয়ন করে, সেখানে আরও বেশ কিছু দাবি সংযোজিত হয়। এই ১১ দফায় পূর্ণতা পায় এ দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের দাবিগুলো। আমরা দেখি, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ দেশের ছাত্র আন্দোলনের ভূমিকা শুরু হয়। পরে বাষট্টি সালের হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তাঁদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সক্রিয়। অতঃপর আটষট্টি সালের ডিসেম্বর থেকে উনসত্তর সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছাত্ররা যে এক সুসংবদ্ধ ও সফল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তা ইতিহাসে বিরল, যা তাঁরা ঐতিহাসিক ১১ দফা দাবি পেশ করে এর সূচনা করেছিলেন। সে সময়ের ছাত্রনেতারা তখন আন্দোলনের শক্তি সঞ্চয়ের জন্য গ্রামে চলে যেতেন।
কৃষকের চাহিদা নিরূপণ করতেন। দেশের সংকটগুলো বিশ্লেষণ করতেন। দেশের সামগ্রিক চিত্র হৃদয়ে আঁকার জন্য তাঁদের বারবার গ্রামের কৃষিজীবী মেহনতি মানুষের সান্নিধ্য, তাঁদের ভাষা, তাঁদের জীবনীশক্তিকে গ্রহণ করতে হয়েছে।
ডাকসুর সাবেক ভিপি তোফায়েল আহমেদ, সে সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, একাত্তরে ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীসহ অনেকের সঙ্গেই আলোচনা করেছি। তাঁরা বলেছেন, একাত্তরের পটভূমি রচনার পেছনে বাংলার কৃষি ও কৃষকের নিবিড় এক প্রভাব রয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুও তাঁর প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্বদানের ক্ষেত্রে কৃষকের সেই ভূমিকাকে সবচেয়ে বেশি সামনে এনেছেন। এর পথ ধরেই আসে একাত্তরের মার্চ। সাতই মার্চের ভাষণে ঝাঁপিয়ে পড়া সমবেত লাখো মানুষের প্রায় সবাই ছিলেন কৃষক শ্রমিক সাধারণ মানুষ। বঙ্গবন্ধুর আত্মবিশ্বাসের জায়গাটিও ছিল কৃষক। আহ্বানও ছিল এই সাধারণ মেহনতি মানুষের উদ্দেশেই। এ ভাষণ পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অমর মহাকাব্য। ইউনেসকো স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এ ভাষণ ছিল একটি জাতির দিকনির্দেশনা ও আত্মপরিচয়ের প্রধান ক্ষেত্র। এটিই ছিল স্বাধীনতাসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার মূলমন্ত্র। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে তাঁরাই অংশ নিয়েছিলেন যাঁরা পাকিস্তানিদের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। এটি ছিল তাঁদের শোষণমুক্তির যুদ্ধ। স্বাধীন ভূমিতে ফসল ফলানোর চূড়ান্ত তাগিদ। পরাধীনতার গ্লানি ঘোচাতে, অর্থনৈতিক মুক্তি লাভ করতে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ছাড়া আর তাঁদের সামনে কোনো পথ খোলা ছিল না।
মুক্তিযুদ্ধে গ্রামবাংলার সাধারণ কৃষকের ভূমিকা প্রশ্নাতীত একটি বিষয়। তাঁদের বীরত্বগাথা ইতিহাসের এক সোনালি অধ্যায়। সুদীর্ঘ বঞ্চনার পথ পেরিয়ে এসে তাঁরা নিজের জীবনকে তুচ্ছ করেছেন। সবাই ভেবেছেন জীবনের বিনিময়ে একটি স্বাধীন দেশ পেলে তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হবে নিরাপদ এক আবাস ক্ষেত্র। তাই যে হাতে তাঁরা লাঙল ঠেলেছেন, ধান কেটেছেন, নৌকার দাঁড় টেনেছেন, জীবিকার জন্য প্রাণান্ত শ্রম দিয়েছেন, সেই হাত তাঁদের উদ্যত হয়েছিল শত্রুর মোকাবিলায়।
মুক্তিসংগ্রাম ধারণার মধ্যে দুটি উপাদান আছে। একটি হলো জাতীয় মুক্তি এবং অন্যটি অর্থনৈতিক, সামাজিক, শ্রেণিগত শোষণমুক্তি।আর এই মুক্তির মন্ত্রক ছিল আমাদের কৃষক সমাজ। আমরা দেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনের স্মৃতিক্ষেত্রে গিয়েছি। কুষ্টিয়ার দুর্বাচারা বংশীতলার এখনো জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের জবানিতে পাই মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনার কথা। তাঁরা অকপটে বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে যাঁরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তাঁদের শতভাগই ছিলেন গ্রামের মানুষ, তাঁদের মধ্যে ৯৮ ভাগই কৃষক। ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধারাও বলেন একই কথা। তখন কৃষকের ঘরের সন্তান টগবগে তরুণেরা কেবলই প্রবেশ করবেন সংসারজীবনে। কেউ যাবেন চাকরিতে। সবকিছু ফেলে তাঁরা আগে ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার সংগ্রামে। নারায়ণগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বন্দরের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গিয়েছিলাম অনেক দিন আগে। তাঁরাও শুনিয়েছেন একই চেতনার সুর।
সেদিনকার পূর্ব পাকিস্তানের ৫৫ হাজার বর্গমাইলের একটি গ্রাম। ১৬টি জেলা সদরের বাইরেই ছিল বিস্তীর্ণ কৃষিভূমি। গ্রামের ঘরবাড়ি, কয়েকটি চায়ের দোকান, দু-একটি আড়ত আর তরিতরকারি ও মুদিদোকানের বাইরে ছিল মেঠোপথ, কৃষিজমি, জলাভূমি, গাছের ছায়া।সেখানে শহুরে অট্টালিকা আর নাগরিক আভিজাত্যের স্থান ছিল না। কৃষক ছিলেন সবকিছুর মূলে। তাঁরাই ছিলেন ঐতিহ্যের বাহক।
এখনো যুদ্ধদিনের সবচেয়ে গভীর স্মৃতিচিহ্ন, কষ্ট, যন্ত্রণা, স্বজন হারানোর বেদনা গ্রামের সাধারণ কৃষকই বেশি বহন করে চলেছেন। আবার তাঁরাই দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করছেন। স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণে তাঁরা ঠিকই তাঁদের শপথ ধরে রেখেছেন। একচুলও সরে যাননি একাত্তরের সেই চেতনা থেকে। আমাদের জীবনধারার সব ক্ষেত্রে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছি বিশ্বায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে। বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা। কিন্তু তা বাস্তবায়নের পথ কতটা কৃষি ও কৃষককে কেন্দ্র করে, প্রশ্ন থেকেই যায়।
বিজয়ের এ মাসে আমরা আবারও মেহনতি মানুষের কথাই ভাবতে চাই। ভাবতে চাই গ্রামের সাধারণ মানুষের কথা। যাঁরা ছাড়া আমাদের আত্মপরিচয় থাকে না। একাত্তরের সব শহীদ, বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ দেশের আপামর কৃষিজীবী মানুষের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।
লেখক: পরিচালক ও বার্তা প্রধান, চ্যানেল আই
‘দুই দিন আগেই বাড়ি থেকে পাথরঘাটায় চলে এসেছি। এখন পুরোনো জাল সেলাই করছি। এক সপ্তাহের বাজারও করে এনেছি। আজ বিকেলে সাগর মোহনায় যাব, গভীর রাত থেকে জাল ফেলব।’ কথাগুলো বলছিলেন বরগুনা সদরের বাইনচটকী এলাকার জেলে হোসেন আলী। গতকাল বুধবার সকালে বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে কথা হয় তাঁর...
১২ জুন ২০২৫ভারতের স্থলবন্দর নিষেধাজ্ঞার পর সীমান্তে আটকে থাকা তৈরি পোশাক, খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের ট্রাকগুলো ফেরত আনছেন রপ্তানিকারকেরা। তবে যেসব ট্রাক বন্দরে ঢুকে গিয়েছিল, সেগুলো ভারতে প্রবেশ করানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব ট্রাক ঢুকতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে।
১৯ মে ২০২৫আধুনিক যুগের সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলোর একটি হচ্ছে গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষের সঙ্গে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক রত্নসম্ভার। গতকাল বুধবার হংকংয়ে বিখ্যাত আর্ট নিলাম কোম্পানি সাদাবি’স-এর এক নিলামে এগুলো তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
০৮ মে ২০২৫পাকিস্তানে ভারতের হামলার সমালোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চীনও এই হামলাকে ‘দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করেছে। উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘও। উত্তেজনা যেন আরও না বাড়ে, সে জন্য দুই পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ। এদিকে ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করেছে...
০৮ মে ২০২৫