Ajker Patrika

মাথার পিছে যে আয় মিছে

অর্ণব সান্যাল
আপডেট : ১৩ মে ২০২২, ১১: ৫৫
মাথার পিছে যে আয় মিছে

এ দেশে আয় নানা ধরনের হয়। এসবের মধ্যে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য আয়েই নজর থাকে অনেকের, হয়তো দুর্নীতির চিত্রে আমাদের তথৈবচ অবস্থার কারণে। ইদানীং বেশি চর্চা হচ্ছে মাথাপিছু আয় নিয়ে। সেই আয় আমরা চোখে দেখি না, তবে ‘অনেক গল্প’ শুনে যাই তারস্বরে!

মাথাপিছু আয় নিয়ে সম্প্রতি আবার চায়ের টেবিলে ঝড় উঠেছে। কারণ, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানিয়েছেন, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের সাময়িক হিসাব অনুসারে দেশের মানুষের জাতীয় মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার। গত অর্থবছর শেষে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৫৯১ ডলার। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ২৩৩ ডলার।

এ নিয়ে সাধারণ নাগরিকদের এক পক্ষ এখন প্রশ্ন তুলছে—তারা ধনী হলো কখন? এর জবাবে কেউ কেউ অর্থনীতির ক্লাস নিচ্ছেন। জানিয়ে দিচ্ছেন, ‘আরে বোকা, মাথাপিছু আয় কোনো একক ব্যক্তির আয় নয়। দেশের মোট জাতীয় আয়কে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে মাথাপিছু এ আয়ের হিসাব করা হয়!’ এসব বলে প্রশ্ন তোলা নাগরিকদের ‘অজ্ঞতা’ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশও চলে। সত্যিই তো, এভাবে তাত্ত্বিক জ্ঞান ছাড়া আবোলতাবোল বকলে হবে?

কিন্তু যে জিনিস আমারই নয়, তা নিয়ে তবে এত হাপিত্যেশ কেন হয়?

এবার একটি ঘটনা শুনুন। তেলের অনিঃশেষ হাহাকারের মধ্যে চূড়ান্ত বাধ্য হয়ে এই অধম অল্প কিছু সয়াবিন তেল পেয়েছিল। উচ্চমূল্যের বিনিময়ে সংগ্রহের পর সত্যি বলছি, রাস্তায় হেঁটে বাসায় যাওয়ার সময় একটা আলাদা ‘ফিল’ পেয়েছি, ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলারের ‘ফিল’। বেশ কয়েকজন তখন শুধিয়েছিল, ‘কত পড়ল?’ বলার পর সবচেয়ে বেশি শুনেছি—‘ও আল্লাহ্’ বলে আর্তনাদ! তেলের মতো সৌভাগ্য (!) এ দেশে পেঁয়াজ বা বেগুনেরও হয়েছিল একদা!

অর্ণব সান্যালমাথাপিছু আয়ের পাশাপাশি জিডিপির ক্রমবর্ধমান আকারের তথ্য পেতে পেতে মানুষ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তাদের ‘আনন্দ নিয়ে বাজার করার’ খবর পান। পেয়ে আর নিজের গলদঘর্ম অবস্থার সঙ্গে মেলাতে পারেন না। আর ঠিক তখনই ঝামেলাটা বাধে। যে দেশে নিত্যপণ্য কেনার ক্ষেত্রে নিদারুণ হিমশিম পরিস্থিতি বিরাজমান, সে দেশে যখন তুমুল গতিতে ‘উন্নয়ন’ এবং তার প্রকৃত উদাহরণ হিসেবে মাথাপিছু আয়ের রকেট গতিতে ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার কথা ফলাও করে প্রচার হয়, তখন কি ‘বোকা’ নাগরিকদের মাথাপিছু আয় নিয়ে যেনতেন প্রকারে মাথা ঘামানো দোষের? আয়ে যেকোনো ধরনের পদোন্নতি তাদের সাদরে গ্রহণ করাই তো স্বাভাবিক, নাকি? আশা তাদের একমাত্র ভেলা কিনা!

ফলে সেই আশায় অযথাই মানুষ বেলুনের মতো ফুলে ওঠে ক্ষণিকের জন্য। এর পরপরই আসে রাজ্যের হতাশা ও কয়েক চিমটি ক্ষোভ। কারণ, বৈষম্য তুমুল আকার নিচ্ছে, অনেকটা জিডিপির বৃহদাকারের মতোই। গত বছরের ডিসেম্বরের শুরুতে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তিন দিনব্যাপী বার্ষিক সম্মেলনে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বলেছিলেন, দেশে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এখন বড় রাজনৈতিক সমস্যা। গত ৫০ বছরে দেশে সার্বিকভাবে দারিদ্র্য ব্যাপকভাবে কমেছে। তবে মানুষের মধ্যে বৈষম্যও বেড়েছে। আর বৈষম্য বাড়লে কর ফাঁকি এবং বিদেশে অর্থ পাচার বেড়ে যায়।

অথচ এই বৈষম্য নিয়ে আমাদের শাসকযন্ত্রে উচ্চবাচ্য সবচেয়ে কম, অর্থ পাচার তো অগ্রাধিকারের তালিকায় আরও নিচে। কখনো কি আমাদের সরকারি পক্ষ থেকে বৈষম্যের কোনো স্পষ্ট চিত্র মাথাপিছু আয়ের মতো করে ঢাকঢোল পিটিয়ে জানানো হয়েছে? হয়নি। অথচ এ সমাজে থাকা বৈষম্যের প্রকট রূপ আমরা করোনা মহামারির প্রচণ্ড সময়ে দেখেছি। আমরা দেখেছি, কীভাবে ঘটিবাটি নিয়ে মানুষ অনন্যোপায় হয়ে শহর থেকে গ্রামে চলে যায়। দেখেছি অসংখ্য বাড়িয়ে দেওয়া রিক্ত হাত বা বাধ্য হয়ে রাস্তায় নামা পা। সেই সঙ্গে ছিল সাধারণের জীবনের আরও কত সাদাকালো বিমর্ষ গাথা!

কিন্তু জেলিফিশের মেমোরি নিয়ে বেড়ে ওঠা কর্তৃপক্ষ তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। বৈষম্যের বিষয়ে এবারও মন্ত্রীরা বলেছেন, ‘বৈষম্য সব সময় খারাপ নয়। যখন পুরো উন্নয়ন হয়ে যাবে, তখন বৈষম্য কমে যাবে।’

তা, পুরো উন্নয়নটা কবে হবে? তত দিনে এই শ্বাসটুকু বইবে তো? সময়সীমা জানাটা বড্ড দরকার। কারণ, মাথাপিছু আয়ের সত্যিকার অঙ্কে পৌঁছানোর আকাঙ্ক্ষা যে সবারই আছে মনে মনে। নইলে যে এই ‘আনন্দবাজারে’ টিকে থাকাটাই দায়!

অর্ণব সান্যাল, সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত