Ajker Patrika

উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে

ড. এম লুৎফর রহমান
আপডেট : ১৬ মার্চ ২০২২, ১২: ০১
উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে

‘উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সঙ্গে, তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে’-পঙ্‌ক্তিদ্বয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল স্কুলজীবনে, ভাবসম্প্রসারণের অনুশীলনী হিসেবে। পরে জেনেছি লাইন দুটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কণিকা কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া। ভাবসম্প্রসারণে কী লিখতাম এখন আর মনে নেই, নিশ্চয়ই একটা কিছু হতো, না হলে এত দূর এলাম কী করে! বিষয়টির প্রকৃষ্ট উদাহরণ ও তাৎপর্য উপলব্ধি করলাম মরহুম অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর।

জামাল নজরুল ইসলামের শিক্ষাজীবন (তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের লরেন্স কলেজ থেকে সিনিয়র কেমব্রিজ ও হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজ, কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএসসি অনার্স, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজ থেকে প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে ট্রাইপস, পিএইচডি এবং পরবর্তী সময়ে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসসিডি) এবং পৃথিবীর বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর কর্মজীবন (জ্যোতির্বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়; ইউনিভার্সিটি অব ম্যারিল্যান্ড, কলেজ পার্ক; ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন; ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি; সিটি ইউনিভার্সিটি, লন্ডন; কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়; প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় ও সবশেষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) সম্পর্কে অনেকেরই জানা আছে, তাই আমার বেশি কিছু বলার নেই। তাঁর মেধা ও কাজের মূল্যায়নের যোগ্যতা আমার নেই, তাই সে ধৃষ্টতাও দেখাব না। উন্নত বিশ্বের আড়ম্বরপূর্ণ ও নিশ্চিত জীবন পরিত্যাগ করে যে কজন স্বল্পসংখ্যক মনীষী নিজ দেশের অনাড়ম্বর ও অনিশ্চিত জীবন বেছে নিয়েছেন, তিনি শুধু তাঁদের মধ্যে অন্যতমই নন বোধ হয় শ্রেষ্ঠতম। অনেক গুণে গুণান্বিত জামাল নজরুল ইসলামের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর বিস্তারিত বিশ্লেষণ এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু তাঁর চরিত্রের একটি গুণের ওপর আলোকপাত করতে চাই। এর আগে তাঁর সঙ্গে কীভাবে পরিচয় ঘটেছিল, সে বিষয়ে দু-চারটি কথা নিবেদন করব।

সময়টা গত শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষার্ধ। জামাল নজরুল ইসলাম তখনো কেমব্রিজে ডক্টরেট-উত্তর গবেষণায় ব্যস্ত। সংগীতানুরাগী জ ন ইসলাম তাঁর বাসায় একটি ছোট্ট সংগীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। অনুষ্ঠানের প্রধান শিল্পী কলকাতা থেকে আসা সেতারবাদক ড. কল্যাণ মুখার্জি, যিনি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন চার্চিল কলেজের বিবাহিত ব্যক্তিদের জন্য নির্ধারিত বাসায়। একই এলাকায় সপরিবারে বাস করতেন বাংলাদেশের স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ স্বদেশ বোস। আমি থাকতাম কলেজের মূল ভবনে। স্বদেশ বোসের পরিবারে আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। এর অন্যতম কারণ বাঙালি খাবারের প্রতি লোভ। চার্চিল কলেজে ব্যক্তিগত রান্নাবান্নার বিশেষ সুবিধা ছিল না। তা ছাড়া, আমার অলস স্বভাব ও অনভিজ্ঞতার কারণে মোটেও রান্নাবান্না করতাম না। এদিকে জীবন বাঁচানোর তাগিদ ছাড়া চার্চিল কলেজের খাবারের প্রতি আমার কোনো আকর্ষণ ছিল না। যা-ই হোক, তাঁদের সঙ্গেই বোধ হয় সংগীতানুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলাম। আমার এখনো মনে আছে জ ন ইসলাম ভারতীয় সংগীতের বিভিন্ন রাগ ব্যাখ্যা করেছিলেন। কেমব্রিজে জ ন ইসলামের সঙ্গে সেই আমার প্রথম ও শেষ সাক্ষাৎ।

ইতিমধ্যে পৃথিবী অনেকবার তার বার্ষিক গতি সম্পন্ন করেছে। জ ন ইসলাম সাহেবও বহুবার আটলান্টিকের এপার-ওপার করেছেন। আমিও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসেছি। ১৯৮৪ সালে অধ্যাপক ইসলাম বাংলাদেশে ফিরে এসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে যোগ দেন এবং গড়ে তোলেন উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণার আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান ‘গাণিতিক ও ভৌতবিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্র’। আমার ধারণা, এই গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পেছনে পাকিস্তানি-ব্রিটিশ নোবেল লরিয়েট বিজ্ঞানী অধ্যাপক আবদুস সালামের উৎসাহ ও সহযোগিতা ছিল। অধ্যাপক ইসলামের মতো অধ্যাপক সালামও কেমব্রিজের গাণিতিক বিজ্ঞানে ট্রাইপস ও পিএইচডি ছিলেন। ইতালির ট্রিয়েস্টে তিনি তৃতীয়-বিশ্ব বিজ্ঞান একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সালাম সাহেব নজরুল সাহেবকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তৃতীয়-বিশ্ব বিজ্ঞান একাডেমি ও স্থানীয় কিছু ধনী লোকের সহায়তায় অধ্যাপক নজরুল নিয়মিতভাবে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করতেন। গাণিতিক বিজ্ঞান ছাড়াও ক্রমে ক্রমে অন্যান্য বিষয়ও সম্মেলনে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।

রসায়ন বিষয়ের এমনই একটা সম্মেলনে আমার যোগ দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। আমার ছোট্ট প্রবন্ধটি উপস্থাপনের সময় তিনি স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন এবং তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুলি একত্র করে উৎসাহমূলক সংকেত দিয়েছিলেন। কয়েক মাস পর তাঁর সঙ্গে আবার দেখা রাজশাহীতে। জিজ্ঞেস করলাম, আমার কথা তিনি স্মরণ করতে পারেন কি না। তাঁর সহাস্য উত্তর ছিল, ‘অবশ্যই।’ এর পর থেকে আমাদের ঘনিষ্ঠতা শুরু। রাজশাহীর বিজ্ঞান অনুষদের পক্ষ থেকে মহাবিশ্ব সম্পর্কে একটি জনপ্রিয় বক্তৃতা দেওয়ার জন্য তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এমন গুরুগম্ভীর বিজ্ঞান বিষয়ের ওপর বক্তৃতায় যে এত লোকের সমাগম হবে, আমরা ধারণাই করতে পারিনি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনের আসনসংখ্যা আগত অতিথির তুলনায় কম হওয়ায় অনেককেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। পিনপতন নীরবতার মধ্য দিয়ে বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর প্রশ্নোত্তর পালা শুরু হয়, যা এত দীর্ঘক্ষণ ধরে চলতে থাকে যে অনুষ্ঠানের পরিচালক থামিয়ে দিতে বাধ্য হন।

এর পর থেকে আমাদের ঘনিষ্ঠতা আরও বৃদ্ধি পায় এবং আমি বেশ কয়েকবার চট্টগ্রামে যাতায়াত করি। তখনই কেবল এ লেখাটির শিরোনামের যথার্থতা উপলব্ধি করি। বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে অনেক বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ ছড়িয়ে আছেন; তাঁদের মাথায় নতুন নতুন ধারণা আসে। সেগুলো ঠিক না বেঠিক, তা নিরূপণের জন্য অধ্যাপক নজরুলের শরণাপন্ন হন। এই ধারণাগুলোর অধিকাংশই হয়তো বেঠিক। আমার মতো সাধারণ লোকেরা এগুলোকে যাচ্ছেতাই বলে উড়িয়ে দিয়ে লোকগুলোকে ভাগিয়ে দিত। কিন্তু জামাল নজরুল ইসলাম তো অসাধারণ। তিনি তাঁদের সঙ্গে বসতেন, পরম ধৈর্যসহকারে আলোচনা করতেন, সর্বোপরি উৎসাহ দিতেন। কারও কাজকেই তিনি ছোট মনে করতেন না।

তাঁর সঙ্গে একসঙ্গে বসে গবেষণা-প্রবন্ধ শোনার সৌভাগ্য হয়েছে, সবার কাজই তাঁর পছন্দ। তিনি মনে করতেন আমাদের দেশে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের কোনো প্রয়োজন নেই, আমরা নিজেরাই সব সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম। অন্যের দোষগুলো তাঁর চোখে পড়ত না, কেবল গুণগুলোরই মর্যাদা দিয়ে তিনি সবাইকে উৎসাহিত করতেন। সবচেয়ে বড় কথা, এর মধ্যে কোনো কপটতা ছিল না, প্রকৃতভাবেই এটি তিনি উপলব্ধি করতেন। আস্তিক-নাস্তিক, ডানপন্থী-বামপন্থী, জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার সঙ্গে তিনি সমভাবে মিশতে পারতেন। সবাই তাঁকে পরমাত্মীয় বলে মনে করতেন। বাঙালি সমাজে এটি একটি অতি বিরল গুণ।

বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন (৪৭ পৃষ্ঠা), বাঙালির রক্তের মধ্যে রয়েছে পরশ্রীকাতরতা—এমন একটি শব্দ যা বোধ হয় পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষায় নেই। ব্যক্তিগত জীবনে দেখেছি আড্ডাপ্রিয় বাঙালির পছন্দের বিষয় হচ্ছে পরনিন্দা করা। আমাদের সমাজের অনেক অশান্তির জন্য এটি দায়ী। একপেশে দৃষ্টি দিয়ে মানুষের দোষই শুধু দেখি, গুণ চোখে পড়ে না; ফলে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জন্মে না। আমাদের পারিবারিক, শিক্ষা বা কর্মজীবনে ধমক প্রদানকারীর তুলনায় প্রশংসাকারীর সংখ্যা নগণ্য। এটি কাম্য নয়। উত্তমরাই কেবল আরও উত্তম তৈরি করতে পারেন। তাই আমাদের সমাজে আরও অনেক জামাল নজরুল ইসলামের প্রয়োজন। আমাদের সমাজবিজ্ঞানী, মনস্তত্ত্ববিদ, শিক্ষাবিদ, সুশীল সমাজ—সবাইকে ভেবে দেখতে হবে এবং উপায় উদ্ভাবন করতে হবে কীভাবে আরও উত্তম তৈরি করা যায়। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে আমরা অনেক উন্নতি করেছি, করছি এবং ভবিষ্যতেও করব; কৃষ্টির দিক দিয়েই-বা পিছিয়ে থাকব কেন?

আজ থেকে ৯ বছর আগে ৭৪ বছর বয়সে উত্তম নজরুল আমাদের মতো অধমদের ছেড়ে স্বর্গলোকে গমন করেছেন। তাঁর মাপের লোকের বাংলাদেশে বড় প্রয়োজন। নতুন প্রজন্মের মধ্য থেকে অনেক জামাল নজরুল ইসলাম বেরিয়ে আসুক—সেই কামনা করি।

ড. এম লুৎফর রহমান
সাবেক উপাচার্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাকা দিয়ে নারীর চাবুকের ঘা খাচ্ছিলেন পুরুষ, দুজন গ্রেপ্তার

ভারতের সঙ্গে সংঘাতে পাকিস্তানের ভাগ্যনিয়ন্তা সেনাপ্রধান জেনারেল মুনির

প্রবাসীর রেমিট্যান্সের অর্থ আত্মসাৎ, নারী ব্যাংক কর্মকর্তা কারাগারে

পাকিস্তানে কীভাবে হামলা চালাতে পারে ভারত, ইতিহাস যা বলছে

কোটি টাকা ‘ভর্তুকি’র জিম্বাবুয়ে সিরিজে বাংলাদেশ যা পেল

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত