Ajker Patrika

সেই রাজাকার, এই রাজাকার!

মাসুদ উর রহমান
আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২২, ১৪: ১৭
সেই রাজাকার, এই রাজাকার!

১৯৭১ সাল, সাড়ে সাত কোটি মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জাদুকরী নেতৃত্বে এক দেহ-এক প্রাণ হয়ে উঠেছিল। আর সেই একটি দেহের একটি প্রাণের ভেতর থেকে একটিমাত্র চাওয়া প্রস্ফুট হচ্ছিল—স্বাধীনতা।

কিছু শয়তান ছাড়া প্রত্যেক মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার জন্য অবদান রেখেছিল। অসম লড়াই জেনেও কেবল প্রাণের আবেগকে শ্রেষ্ঠ অস্ত্র বানিয়ে আমাদের মুক্তিবাহিনী গেরিলা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে পরম পরাক্রমশালী পাকিস্তানি হানাদারদের পরাভূত করার সব আয়োজন সম্পন্ন করে চলেছিল।

একাত্তরের অক্টোবরের কোনো এক ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা অপারেশন শেষে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত অবস্থায় এক বাড়িতে আশ্রয় চাইলেন। বাড়িওয়ালা অতি আন্তরিকতায় তাঁদের জলপান করিয়ে নিজের অপারগতার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বিদায় জানালেন। শুধু জলপানেই তিনি যে আন্তরিকতা দেখালেন, তাতেই মুক্তিযোদ্ধারা অভিভূত হয়ে বাড়ি থেকে দ্রুত প্রস্থান করলেন।

এদিকে ভোরের আলোও ফুটতে শুরু করেছে…দুটো বাড়ি পার হতেই পাশের বাড়ির এক নারী এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করে তিনি তাঁর বাড়িতে তাঁদের আশ্রয় দিলেন। হঠাৎই দেখা গেল, পাকিস্তানি সেনারা সেই বাড়ির দিকেই আসছে। মুক্তিযোদ্ধারা অপ্রস্তুত এবং হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন। এখন তো পজিশন নেওয়ারও সময় নেই।

ইতস্তত বিচলিত যোদ্ধাদের বাঁচাতে বাড়ির তরুণী গৃহবধূ তখন ঘরের দরজায় জায়নামাজ পেতে কোরআন শরিফ পড়তে লাগলেন। পাকিস্তানি সেনারা দেখল, ফজরের আজান পড়ে গেছে। নামাজ শেষে নিরীহ গৃহিণী কোরআন শরিফ পাঠ করছেন। খুবই স্বাভাবিক দৃশ্য। তারা এই বাড়িতে আর ঢুকল না। পাশ কাটিয়ে চলে গেল।

মিলিটারি চলে যাওয়ার পর বুদ্ধি ফিরে পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে চলে গেলেন। অংশ নিলেন তাঁদের পূর্বপরিকল্পিত অভিযানে…।

দীর্ঘ ৫০ বছর পর দৃশ্যপটে আবারও সেই পানি খাওয়ানো বাড়িওয়ালা। স্থানীয় উপজেলা পরিষদ চত্বরে বর্তমান প্রজন্ম কোনো এক রাজাকারের ফাঁসির আদেশে আনন্দ মিছিল করছে; একে-অপরকে মিষ্টমুখ করাচ্ছে।

একাত্তরের সেই ভোরের মুক্তিযোদ্ধাদেরই একজন যুদ্ধাহত ঘটনাক্রমে আজ এই জনপদে উপস্থিত। হঠাৎ যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা একজন বয়োবৃদ্ধ মুরব্বিকে চিনতে পেরে ফিসফিসিয়ে সেই নারী আর বাড়িওয়ালার খোঁজ করতেই মুরব্বি তাঁর ভাষ্যে, ‘ভাইরে, সেদিন তোমরা চলে যাওয়ার পর মিলিটারিরা খবর পায় যে তোমরা ওই নারীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলে। তাই ফেরার পথে তারা ওই নারীর বাড়ি ব্রাশফায়ার করে উড়িয়ে দেয়। শহীদ হন তাঁর ঘুমন্ত স্বামী। আর দুধের বাচ্চাটা।

‘আর সেই বাড়ির বাড়িওয়ালা ছিল সুবিধাবাদী। মুখে ছিল তার জয় বাংলা আর অন্তরে পাকিস্তান। তোমরা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে সেদিন সে যেমন ঝুঁকি নিতে চাইল না, পাশাপাশি দেশ স্বাধীন হলেও যাতে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরাগভাজন হতে না হয়, সে জন্য অতি আন্তরিকতা আর সাবধানতার সঙ্গে সে তোমাদের পানি পান করিয়েছিল। আর এই দুকূল রক্ষা করার অংশ হিসেবে সেই পাকিস্তানি হানাদারদের তোমাদের ওই নারীর বাড়িতে আশ্রয়ের কথা জানিয়ে দিয়েছিল। যুদ্ধের পরপর সে পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর ফিরে এসে অনেক রাজত্ব করেছে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। ওই যে দেখছ, জনতা হইহুল্লোড় করছে… তার ফাঁসির আদেশ শুনেই।’

মুরব্বির কথা শুনে প্রায় বাকরুদ্ধ যুদ্ধাহতের লোচন নিংড়ে বেরিয়ে আসছে কষ্টের নোনা জল আর কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে-

নিমেষে নিমেষে নয়নে বচনে সকল

কর্মে সকল মননে,

সকল হৃদয়তন্ত্রে যেন মঙ্গল বাজে

আজি প্রণমি তোমারে.....

হ্যাঁ, আমাদেরও সশ্রদ্ধ প্রণাম সেই মাসহ সব শহীদের প্রতি।

নয় মাসের যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে আমরা এ রকম লাখো মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাই একটি স্বাধীন দেশ, একটি নতুন পতাকা।

দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই পুরোনো শুকুন আর তাদের প্রেতাত্মারা যে এখনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত…আসুন, মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে আমরা সব ষড়যন্ত্রকারীকে রুখে দিতে ঐক্যবদ্ধ হই এবং সবাই মিলে গাই ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি…’।

মাসুদ উর রহমান, কলেজশিক্ষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত