Ajker Patrika

তৃতীয় লিঙ্গের শক্তি কাজে লাগুক

আব্দুর রাজ্জাক
তৃতীয় লিঙ্গের শক্তি কাজে লাগুক

কয়েক মাস আগে, আরিচা ঘাট থেকে পার হওয়ার জন্য ফেরির ওপরে বাসের মধ্যে বসে আছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই শাড়ি পরা দুজন বাসের মধ্যে বাসের সামনে দাঁড়িয়ে দুই হাতে তালি দিয়ে সবার উদ্দেশে বলল, ‘কারও সঙ্গে যেন খারাপ ব্যবহার করতে না হয়। সবাই দশ টাকা, বিশ টাকা বের করে রাখেন। যাত্রাপথে কাউকে টানাহ্যাঁচড়া করতে চাই না।’ এ কথার মধ্যে যতটা না সহানুভূতির সুর, তার হাজার গুণ ধমক ও চোখ রাঙানোর সুর। বাসের মধ্যে সাধারণ যাত্রীরা কেউ কোনো উত্তর দিল না। সবাই দশ টাকা, বিশ টাকা করে দিয়ে দিল। 
কিন্তু ঝামেলা বাধাল বাসের পেছন দিকে বসা একটি দরিদ্র পরিবার। একটি বাচ্চার বয়স হবে চার বছর। আরেকটি বাচ্চা খুবই ছোট, হয়তো বয়স হবে দেড় থেকে দুই মাস। সেই পরিবারের কাছে গিয়ে পাঁচ শ টাকা দাবি করল, যেহেতু তাদের কাছে নতুন বাচ্চা আছে। এ রকম কিছুক্ষণ কথা-কাটাকাটির পরে এক শ টাকায় রফা হলো। আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন কাদের কথা বলছি? তারা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ।

পরিবারটি এক শ টাকা দেওয়ার পরে মনে খুবই কষ্ট পেয়েছিল। সেটা তাদের আহাজারিতে বুঝতে পেরেছিল বাসের যাত্রীরা। কারও কিছু করার ছিল না। ওরা চলে যাওয়ার পরে সবাই বলাবলি করতে আরম্ভ করল, বর্তমানে তারা রীতিমতো অত্যাচার শুরু করেছে সাধারণ মানুষের ওপর। তাদের চাহিদামতো টাকা না দিলে রীতিমতো অপমান করে, গালাগাল করে। এমনকি শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। মানুষ মানসম্মানের ভয়ে তাদের সঙ্গে বেশি কথা বাড়ায় না বা কোনো রকম তর্ক বা হাতাহাতিতে লিপ্ত হয় না। 

২. কাকরাইল মোড়ে রিকশা দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল দুই পাশ থেকে দুজন। বলতে গেলে দুই পাশ থেকে হাত ধরে জবরদস্তি করে মানিব্যাগ বের করতে বলল। পঞ্চাশ টাকা নিয়ে নিল। সবাইকে এ রকম করেই ধরে। তাদের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া বড়ই কঠিন। ফুটপাতের দোকান থেকে জবরদস্তি করে তারা প্রতিনিয়ত চাঁদাবাজি করে। এসব এখন অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে।

৩. যশোর শহরতলিতে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে দল বেঁধে তারা চারজন চলে এল। বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে। বিয়ে পড়ানো হবে। বরযাত্রী চলে এসেছে, সেই সময় তাদের আক্রমণ। বর যেখানে বসবে, সেখানে এসে নানান অঙ্গভঙ্গিতে হাততালি ও ব্যঙ্গাত্মক গান শুরু হয় তাদের। দশ হাজার টাকা দাবি, বিভিন্ন দর-কষাকষি ও নানান দেনদরবারের পরে তিন হাজার টাকা দিয়ে রক্ষা পাওয়া গেল। টাকা দিয়ে রক্ষা পাওয়া গেল অবশ্য, কিন্তু সবারই বিয়েবাড়ির আনন্দের মধ্যে প্রায় আধা ঘণ্টা অত্যন্ত বিরক্তি ও যন্ত্রণার মধ্যে কাটল। এ রকম সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান তাদের কারণে বিঘ্ন ঘটে। সবার মনে বিরক্তির উদ্রেক হয়। এমনকি অনেক সময় ভয়ভীতি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।

ফুটপাত দিয়ে একা একা হাঁটলেও তাদের খপ্পর থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো উপায় নেই। হয়তো হাসপাতালে যাচ্ছেন বা জরুরি কোনো পারিবারিক প্রয়োজনে বের হয়েছেন, তাদের পাল্লায় পড়লে আপনার যাত্রাটি ভঙ্গ হবে। খুবই বিরক্তি আর ভগ্ন মন নিয়ে পথে চলাচল করবেন। বলতে গেলে সারাটা দিন আপনার মাটি হয়ে যাবে।

৪. কয়েক দিন আগে এক পরিচিত ব্যক্তি বললেন, তিনি নিজে গাড়ি চালিয়ে বাসায় ফিরছিলেন, সেই সময় তাঁকে পেয়ে বসে এই দল। গাড়িতে এসি ছিল না। এ অবস্থায় চারজন তাঁর গাড়িটিকে ঘিরে ধরে। তিনি মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করতে যাবেন, এমন সময় কেমন করে যেন হাতাহাতি করে বিভিন্ন কথা বলে হাতে তালি দিয়ে মোবাইল দুটি নিয়ে গেল! গাড়ি চালিয়ে মোড় পার করার পরে টের পেলেন তাঁর মোবাইল পকেটে নেই।

আব্দুর রাজ্জাকএ রকম হাজারো গল্প হাজার লোকের মাধ্যমে শুনতে পাবেন প্রতিদিন। আমাদের সমাজে হয়তো এমন কোনো ব্যক্তি নেই যে তাদের ওপরে বিরক্ত নন। সমাজের সর্বস্তরের মানুষই তাদের দ্বারা কোনো না কোনোভাবে কমবেশি অপমানিত।কোনো বাড়িতে যদি শিশুর জন্ম হয়, কোনো বাড়িতে সুন্নতে খাতনার অনুষ্ঠান হয়, সেখানে তাদের হামলা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে। এসব বাড়িতে গিয়ে বা অনুষ্ঠানে গিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে বসে। তারা কোনো কিছুর তোয়াক্কা করে না। মানসম্মান, লোকলজ্জা—কোনো কিছুকে পাত্তা দেয় না। এমনকি তারা সব সময় মারামারি ও হাতাহাতি করার জন্য প্রস্তুত থাকে।

তারা এক জায়গায় দল বেঁধে কয়েকজন একত্রে চলাফেরা করে। অর্থাৎ, এরা শক্তি প্রদর্শন করে। ভাবখানা এ রকম যে তাদের দাবিমতো টাকাপয়সা দিতে বাধ্য না হলে তারা জোরজবরদস্তি করে টাকা আদায় করবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ কেউ কিছু তাদের বিপক্ষে বলবে না। সেদিন সোনারগাঁও হোটেলের সামনে থেকে আমরা তিন বন্ধু উবারে করে বাসায় ফিরছি। সেই সময় চারজন আমাদের গাড়ির কাছে এল। ঘিরে ধরে আমাদের কাছে টাকা চাইল। যাহোক, পঞ্চাশ টাকা দিয়ে রক্ষা। আমরা তিন বন্ধু বিরক্ত। উবারচালক আমাদের বললেন, ‘স্যার, এদের গায়ে অনেক শক্তি। এদের সঙ্গে কোনো মানুষ মান-ইজ্জতের ভয়ে তর্কাতর্কিতে যায় না।’ 

৫. উবারচালক একটা প্রস্তাব দিলেন। বললেন, ‘এদের কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে একটি ইউনিট করে নিয়োগ দেওয়া হোক। এদের এই শক্তিকে কাজে লাগানো হোক। আনসার বাহিনী বা পুলিশ বাহিনীতে ছোট ছোট ইউনিট করে বর্তমানে যেভাবে সিকিউরিটি গার্ড বিভিন্ন কোম্পানিতে নিয়োগ দেওয়া হয়, সে রকম এদের সরকারি তত্ত্বাবধানে সরকারিভাবে নিয়োগ দিয়ে বিভিন্ন কোম্পানিতে মিল-কারখানায়, রাস্তায় যানজট নিরসনে যোগ্যতা অনুসারে বিশেষভাবে ট্রেনিং দিয়ে নিয়োগ দিলে এরা কাজ করতে পারবে নিঃস্বার্থভাবে।’ 
তাদের কোনো পিছুটান নেই, সংসার গড়ার কোনো অভিপ্রায় নেই। সংসারের বাড়তি চিন্তা তাদের বহন করতে হবে না। সঙ্গে যদি নিশ্চয়তা পায় অবসর ভাতা পাওয়ার, তাহলে তারা সমাজের বোঝা নয়, জাতি গঠনে সহায়ক শক্তি হবে। তাদের যদি মানসিকভাবে মোটিভেট করা যায়, তাহলে তারা সৎ জীবনযাপন করবে। তারা কোনো দুর্নীতির আশ্রয় নেবে না বলেই মনে হয়। কেননা, তাদের পিছুটান থাকবে না।

রাষ্ট্রের উচিত এই শক্তি কাজে লাগানো। সাধারণ মানুষ অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি পাক। সমাজ একধাপ এগিয়ে যাক তাদের হাত ধরেও।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘ভারতে ঢুকে’ পাকিস্তানি সেনাদের গুলি, সীমান্তে সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে

বন্ধুকে ছাত্রলীগ সাজিয়ে পুলিশে দিয়ে তাঁর প্রেমিকাকে ধর্ষণ করলেন ছাত্রদল নেতা

বিবাহিতদের পুলিশ ক্যাডারে না নেওয়ার প্রস্তাব র‍্যাব ডিজির

পেহেলগাম হামলা: ধরা খেয়ে গেল মোদির কাশ্মীর ন্যারেটিভ

পরিপাকতন্ত্রের ওষুধের পেছনেই মানুষের ব্যয় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত