Ajker Patrika

অভ্যস্ততা

সম্পাদকীয়
অভ্যস্ততা

মেহরান করিমি নাসেরি মারা গেছেন। নামটি আদৌ খুব পরিচিত নয়। কিন্তু যখন জানা যায় যে কাগজপত্রের জটিলতায় তিনি দীর্ঘ ১৮ বছর বাস করেছিলেন ফ্রান্সের প্যারিসের একটি বিমানবন্দরে, তখন সত্যিই তাঁকে নিয়ে কৌতূহলী হয়ে উঠতে পারে মানুষ। আর তখনই মনে পড়ে যেতে পারে, ২০০৪ সালে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ ‘টার্মিনাল’ নামে একটি সিনেমা তৈরি করেছিলেন। সেই সিনেমা ছিল মূলত মেহরান করিমির জীবন নিয়েই। একজন মানুষ ১৯৮৮ সালে ইরান থেকে ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য।

কিন্তু সে আশ্রয় মেলেনি। সে কথা মেহরান জানতে পারেন প্যারিসের শার্ল দ্য গল বিমানবন্দরে। তখনই তিনি নিজেকে রাষ্ট্রহীন ঘোষণা করে সেখানেই বসবাস করতে শুরু করেন। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তাঁকে বহুবার সেখান থেকে বের করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সে চেষ্টা প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে। ২০০৬ সালে একবার তিনি বাইরে বের হলেও অসুস্থ হয়ে পড়ায় আবার ফিরেছিলেন টার্মিনালে। এর মধ্যে উদ্বাস্তু হিসেবে তাঁর জন্য কাগজপত্র তৈরি হয়। মৃত্যুর কিছুদিন আগে আবার তিনি ফিরে এসেছিলেন টার্মিনালে। সেখানেই মারা যান।

স্টিভেন স্পিলবার্গের সিনেমার মূল যে চরিত্র ভিক্তর নভরোস্কি, তাঁকে গড়ে তোলা হয়েছে মেহরানের আদলে। সে চরিত্রে টম হ্যাঙ্কসও করেছেন দুর্দান্ত অভিনয়। সঙ্গে ক্যাটেরিনা জেটা জোন্স থাকায় ছবিটি একমুহূর্তের জন্যও মনোযোগের বাইরে থাকেনি। ছবির প্রয়োজনেই কাহিনির হেরফের করতে হয়েছিল। বাবার স্মৃতি ধরে রাখার একটি অনন্য কাহিনিও যোগ করা হয়েছিল তাতে।

‘টার্মিনাল’ সিনেমায় ভিক্তর নভরোস্কি অবশেষে ঢুকতে পারেন নিউইয়র্কে। যেতে পারেন আরাধ্য গন্তব্যে। তা নিয়েই খুশি ছিল দর্শক। কিন্তু সত্যিকারের ‘নভরোস্কি’, অর্থাৎ মেহরান যে এতকাল ধরে বেঁচে ছিলেন, সে খবরই আর কেউ রাখত না।

বাস্তব সত্য হচ্ছে, কাগজপত্র ঠিক না থাকায় একজন মানুষ যখন বিমানবন্দরে দীর্ঘদিন কাটাতে বাধ্য হন, তখন তাঁর জীবনটাও সেই অস্বাভাবিক জীবনযাত্রার সঙ্গে ধীরে ধীরে খাপ খাইয়ে নিতে থাকে। সেটা এমনও হয়, কখনো কখনো নিজ বাড়ির চেয়ে এ বিমানবন্দরটিই জীবনের জন্য হয়ে উঠতে পারে অনেক বেশি আপন। যেমন দীর্ঘদিন কারাগারে থাকতে থাকতে যখন বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন কেউ কেউ ভাবতেই পারেন কারাগারেই শেষ হোক জীবন। এটা শুধু কথার কথা নয়, পাকিস্তান আমলে কোনো কোনো বামপন্থী নেতা জেলজীবনে অনেকটা সময় কাটানোর পর বাইরের জগৎ তাঁদের কাছে একেবারেই অচেনা হয়ে যেত। কেউ কেউ জেলারের কাছে এমন অনুরোধও করেছেন, যেন তাঁদের মুক্তি দেওয়া না হয়। জীবনের শেষ দিনটি কেটে যাক কারাবন্দী অবস্থায়। সে এক কাল ছিল আমাদের দেশে।

ফ্রান্সে সদ্য জীবন শেষ করা মেহরানের ক্ষেত্রে অবশ্য পরে কঠোরতা উঠে গিয়েছিল। তিনি চাইলে ফ্রান্সের যেকোনো শহরেই আবাস গড়ে তুলতে পারতেন। কিন্তু ওই যে অভ্যস্ততা—তা থেকে মুক্তি মিলবে কী করে?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত