Ajker Patrika

মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে হেলাফেলা

আব্দুর রাজ্জাক 
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রায় সব মানুষই বর্তমানের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। প্রতিটা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষাপদ্ধতি চালু আছে, তাতে ছাত্র-ছাত্রীরা মানসম্পন্ন সুশিক্ষা পাচ্ছে, এমন কথা অনেক গুণীজন বিশ্বাস করেন না। 

আমাদের দেশে সবকিছু নিয়ে আন্দোলন হয়—সরকার পরিবর্তন, সরকারের অব্যবস্থাপনা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। উল্লিখিত পরিবর্তনের জন্য সব সময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আমাদের ছাত্রসমাজ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ছিল একটি যৌক্তিক আন্দোলন। তদানীন্তন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আমাদের পূর্ব বাংলার মাতৃভাষাকে অবমাননা করেছিল। সেই সময় ছাত্রসমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল এই অবমাননাকর অন্যায্য সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। 

পরবর্তী সময়ে ধারাবাহিকভাবে বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন, ছেষট্টির ৬ দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের অগ্রণী ভূমিকা অনস্বীকার্য। এইসব আন্দোলন হয়েছিল বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে। তারপর নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান ও পরবর্তীকালে বিভিন্ন জাতীয় আন্দোলনে ছাত্রদের ইতিবাচক ভূমিকা আমরা দেখেছি আমাদের এই স্বাধীন দেশে। সবশেষ সব ধরনের ছাত্র-ছাত্রীদের অংশগ্রহণে আমরা একটা সরকার পরিবর্তন দেখলাম। প্রতিটি আন্দোলনেই ছাত্র-ছাত্রীদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। যার ফলে এইসব আন্দোলন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এককথায় বলতে চাইছি, ছাত্ররা যেসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে, এইসব আন্দোলন সফল হয়েছে। 

আমাদের এই মাতৃভূমির বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের শিরোনামগুলো উল্লেখ করলাম এই কারণে যে আমাদের সচেতন ছাত্রসমাজ কোনটা অন্যায় তা বোঝে, কোনটা ন্যায় তা-ও বোঝে, শোষণ বোঝে, বঞ্চনা বোঝে, নিপীড়ন বোঝে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনও করে। অথচ আমরা দেখতে পাচ্ছি না মানসম্পন্ন শিক্ষা, বিজ্ঞানভিত্তিক আদর্শ শিক্ষার জন্য তারা কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম করে। গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য কোনো দিন এই সমাজে বলিষ্ঠ কোনো দাবি উঠেছে বা আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে—এমন দৃষ্টান্ত খুবই কম। 

আমাদের সমাজে কয়েক শ্রেণির শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে। এগুলোর ব্যাখ্যায় গেলাম না। কিন্তু প্রশ্ন—এইসব শিক্ষায় যে ধরনের কারিকুলাম চালু আছে সেটা কি মানসম্পন্ন কারিকুলাম? সেখান থেকে কি বাস্তবভিত্তিক সঠিক শিক্ষা আমাদের সন্তানেরা পাচ্ছে? বর্তমানে মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থার কারিকুলাম প্রণয়নের ও তদারকের জন্য আমাদের দেশে কিন্তু তেমন কোনো সংস্থা বা কমিশন নেই। 

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যখন বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তখন আমাদের দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এক হাজারের মধ্যে স্থান পায় না। একটু বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব ছেলেমেয়ে ভর্তি হয় তারা স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে যে ধরনের শিক্ষা পায় সেই শিক্ষা নিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় খুব একটা যে ভালো করছে, সে কথা বলা যাবে না। কিছু কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় মাতৃভাষাসহ আন্তর্জাতিক একটি কি দুটি ভাষা, আমাদের ইতিহাস, আমাদের সমাজব্যবস্থা, সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানের যেসব বিষয়ে পড়া উচিত সেই ব্যাপারে তেমন একটা আগ্রহ দেখা যায় না। আর এই ব্যাপারটিতে ছাত্রসমাজ কোনো দিন কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম করছে বলে আমার জানা নেই। 

বর্তমান সময়ে ছাত্ররা অনেক কাজ করছে—বিভিন্ন সংস্থাকে তারা সঠিক পথে পরিচালনা করার জন্য দাবিদাওয়া নিয়ে, সেইসব সংস্থা বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে গিয়ে সংস্কারের কথা বলে, বিভিন্ন পদস্থ কর্মকর্তার অপসারণ করছে, তাঁদের পরিবর্তে নতুনদের নিয়োগ দিচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই ছাত্ররা জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছে। বলতে গেলে জাতীয় পর্যায়ের সবকিছুতেই আমাদের ছাত্রসমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এসব বিষয়ে তারা বোঝে অথবা যেসব বিষয়ে তারা এখনো এই বয়সে বোঝার কথা না, সেসব বিষয়ের ওপরেও তাদের মতামত দিয়ে যাচ্ছে, পরিবর্তনের আহ্বান জানাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তন করতেও পারছে; শুধু শিক্ষাব্যবস্থা ও উচ্চমানের শিক্ষাপদ্ধতির আন্দোলন ছাড়া। 

বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অর্থাৎ সঠিক মানসম্পন্ন শিক্ষা, সঠিক কারিকুলামের ব্যাপারে কেন বর্তমান সময়ের সচেতন শিক্ষার্থীরা কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম বা দাবি জানাচ্ছে না? তারা কেন দেখতে পাচ্ছে না যে আমাদের স্কুল-কলেজগুলো ঠুনকো অজুহাতে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে? ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ায় তেমন মন নেই। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট সিলেবাস শেষ করতে পারছে না। সেশনজট তৈরি হচ্ছে, কাঙ্ক্ষিত ভালো ফলাফল হচ্ছে না। শিক্ষার ব্যাপারে আমরা বহির্বিশ্ব থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি। সচেতন মানুষের মনে হতেই পারে, শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে শিক্ষার বিস্তার নিয়ে, মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা প্রসারের জন্য যদি ছাত্ররা দাবি করত, তাহলে ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটত। 
এখন দেখতে পাচ্ছি কিছু ছাত্র ঠুনকো জিনিস নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করে যাচ্ছে। দুই মাস আগে দেখলাম ছাত্ররা অটোপাসের জন্য আন্দোলন করল। সচিবালয় ঘেরাও করে শিক্ষা উপদেষ্টা, শিক্ষাসচিবসহ সবাইকে জিম্মি করে মোটামুটি অর্ধেক পরীক্ষার পাসের ওপর নির্ভর করে অটোপাস করার ব্যবস্থা করে এল। আবার কয়েক দিন আগে দেখলাম অর্ধেক পরীক্ষা দিয়েও যারা পাস করতে পারেনি, তারা সম্পূর্ণ অটোপাসের ভিত্তিতে সবাইকে পাস করিয়ে দেওয়ার জন্য দাবি করছে। এ ব্যাপারেও সচিবালয় ও শিক্ষা বোর্ড ঘেরাও করেছে। আরেক দিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিকৃত ৭ কলেজের শিক্ষার্থীরা নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তীব্র আন্দোলন করছে। কিন্তু শিক্ষার বিজ্ঞানভিত্তিক কারিকুলাম ও মানসম্পন্ন শিক্ষার ব্যাপারে কোনো দাবি-দাওয়া নেই। 

সবকিছু বিবেচনা করলে মনে হতে পারে, আমাদের ছাত্রসমাজ বুঝে ফেলেছে এ দেশে ভালো শিক্ষার দাম নেই, মানসম্পন্ন শিক্ষা লাভ করে খুব একটা কিছু করা যাবে বলে মনে হয় না। তারা দেখছে শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষার মান যা-ই হোক না কেন, আন্দোলন-সংগ্রাম করলে, পেশিশক্তি প্রদর্শন করলে অনেক বড় পদে চলে যাওয়া যায়! বর্তমান সময়ে এ রকম একটি ধারণা ছাত্র-ছাত্রীদের মনে কেন যেন দানা বেঁধেছে। এইরকম ভাবনা যদি তাদের মনে প্রোথিত হয়ে থাকে যে মানসম্পন্ন শিক্ষার চেয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম, দাবি-দাওয়া নিয়ে, বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে ভালো কিছু পাওয়া যায়, তাহলে জাতি হিসেবে আমরা কোথায় যাচ্ছি সেই কথাটি ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ করছি সুধী সমাজের কাছে। এখন শুধু চাকরি পাওয়ার জন্য, চাকরির জন্য বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা পার হওয়ার জন্য কিছু পুঁথিগত মুখস্থবিদ্যা চলছে। 

আমরা যদি এই সময় ছাত্রদের আপাতত রাজনৈতিক সাফল্য দেখে তাদের বাহবা দিই, আন্দোলন-সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করি, তাহলে কিন্তু মানসম্পন্ন শিক্ষা পাওয়া ভবিষ্যৎ জন্মের জন্য খুবই কঠিন হয়ে পড়বে। আমরা সবাই সাবধান হই, আমাদের সন্তানদের যেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানমুখী করি। তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা, শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনা করার জন্য প্রশাসন, শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিরা মিলে বিজ্ঞানভিত্তিক মানসম্পন্ন কারিকুলাম প্রণয়ন করে সেগুলো বিস্তারের জন্য প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলকভাবে চালু করতে হবে। 

বর্তমানের অবস্থা দেখলে মনে হয় শিক্ষাই যে জাতির মেরুদণ্ড, এই কথাটি আমরা সবাই ভুলে গেছি। তাই এই বাস্তব কথাগুলো শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে বলতে হবে—তোমরা মানসম্পন্ন শিক্ষা অর্জন কোরো, তাহলে অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাবে, বাস্তবজীবনে প্রতিষ্ঠা পাবে, এই সমাজ-দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।

লেখক: প্রকৌশলী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

‘ভারতে ঢুকে’ পাকিস্তানি সেনাদের গুলি, সীমান্তে সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে

এনবিআর চেয়ারম্যানের কক্ষের সামনে কর্মকর্তাদের অবস্থান

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

বন্ধুকে ছাত্রলীগ সাজিয়ে পুলিশে দিয়ে তাঁর প্রেমিকাকে ধর্ষণ করলেন ছাত্রদল নেতা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত