ড. মইনুল ইসলাম
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরুর লগ্নে বাংলাদেশ ছিল একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদ। এই ভয়াবহ সংকট মোকাবিলায় সরকারের কোষাগার ছিল শূন্য। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল—এই ২৪ বছরের সময়টাজুড়ে পশ্চিম পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হিসেবে শোষণ, লুণ্ঠন ও অবিশ্বাস্য রকম বঞ্চনার শিকার হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান।
মুক্তিযুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী আক্ষরিকভাবেই ‘পোড়ামাটি’ নীতি অবলম্বন করেছিল। (‘বেলুচিস্তান ও বাংলার কসাই’ সমরনায়ক টিক্কা খানের ঘোষণা ছিল, ‘মুঝে আদমি নেহি মিট্টি চাহিয়ে’)। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসার আগেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন সরকার সংকট মোকাবিলার কঠিন সংগ্রামে জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামিয়ে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ঘোষিত বাংলাদেশের প্রথম সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের তিনটি রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণ করেছিল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। বঙ্গবন্ধু এগুলোর সঙ্গে যোগ করলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদ।
এই চারটি রাষ্ট্রনীতির ভিত্তিতে দেশের সংবিধান রচিত হলো। বঙ্গবন্ধু দেশের শ্রেষ্ঠ চারজন অর্থনীতিবিদকে রাজি করালেন পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান এবং সদস্য হওয়ার জন্য। প্রফেসর নুরুল ইসলাম হলেন মন্ত্রীর পদমর্যাদায় ডেপুটি চেয়ারম্যান, আর প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় সদস্য হলেন প্রফেসর মোশাররফ হোসেন, প্রফেসর রেহমান সোবহান ও প্রফেসর আনিসুর রহমান। কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন প্রফেসর এ আর খান, প্রফেসর মুজাফফর আহমদ, ড. স্বদেশ রঞ্জন বোস ও প্রফেসর শামসুল ইসলামের মতো মেধাবী ব্যক্তিরা। অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী তাজউদ্দীন এবং পরিকল্পনা কমিশনের নেতৃত্বে শুরু হলো ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সরকারি বাজেট এবং প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ।
বঙ্গবন্ধু সরকারের ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের প্রথম বাজেটে শিক্ষা খাতে এ দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২১ দশমিক ১৬ শতাংশ সরকারি ব্যয় বরাদ্দ করা হয়েছিল। তখনকার যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির বাস্তবতায় শিক্ষা খাতে এত বেশি ব্যয় বরাদ্দ যে সরকারের জন্য কত বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, তা এখন চিন্তাও করা যাবে না। এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে জনগণকে দ্রুত শিক্ষিত করে গড়ে তোলাই যে উন্নয়নের মূল দর্শন হতে হবে, সে বিষয়টি বঙ্গবন্ধু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের শেষ ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরের বাজেটেও শিক্ষা খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। দুঃখজনক হলো, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ক্ষমতাসীন জিয়াউর রহমান ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা খাতের সরকারি ব্যয় বরাদ্দকে ১১ শতাংশের নিচে নামিয়ে এনেছিলেন। তখন থেকে পুরো জিয়া আমল এবং এরশাদ আমলে প্রতিরক্ষা খাতের সরকারি ব্যয় বরাদ্দ সরকারের প্রধান অগ্রাধিকারে পরিণত হয়েছিল। ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয় বরাদ্দ ছিল বাজেটের মাত্র ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০০১-০৬ মেয়াদের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় কয়েক বছর শিক্ষা খাতের সরকারি ব্যয়কে জিডিপির ২ শতাংশেরও নিচে নামিয়ে ফেলা হয়েছিল। ওই সময়ে শিক্ষা খাতের সরকারি ব্যয় জিডিপির অনুপাতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে ছিল সর্বনিম্ন। আরও দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির উত্তরসূরি দাবিদার বর্তমান সরকার নিজেদের শিক্ষাবান্ধব সরকার বলে গলাবাজি করলেও চলমান ২০২১-২২ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয় বরাদ্দ জিডিপির ২ দশমিক ৩ শতাংশেই আটকে রয়েছে। ১৩ বছর ধরে এই অনুপাত জিডিপির ২ দশমিক ২ থেকে ২ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। অথচ ইউনেসকো বলছে, জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত, বাংলাদেশও ওই অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষরকারী দেশ।
১৯৭২ সালের সংবিধানে শিক্ষা সম্পর্কে অঙ্গীকার বিধৃত হয়েছে ১৭ নম্বর ধারায়, যা নিম্নরূপ:
‘রাষ্ট্র (ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য,
(খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সংগতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য,
(গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’
ওপরে উল্লিখিত অঙ্গীকার মোতাবেক দেশের প্রাথমিক শিক্ষাকে ‘একক মানসম্পন্ন’ কারিকুলামে নিয়ে আসাই সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। এই সাংবিধানিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭২ সালেই পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক ঘোষণা করার পাশাপাশি দেশের সব প্রাথমিক স্কুলকে জাতীয়করণ করেছিল। ১৯৭৪ সালে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের যে প্রতিবেদনটি সরকার গ্রহণ করেছিল, তাতে ওই বাধ্যতামূলক, অবৈতনিক ও একক মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বর্ধিত করার প্রস্তাব ছিল। জাতির দুর্ভাগ্য, কুদরাত-এ-খুদা কমিশনের রিপোর্ট সরকার গ্রহণ করেছে মর্মে সরকারি গেজেট প্রকাশিত হওয়ার আগেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছিলেন।
ওই রিপোর্টের সুপারিশগুলো ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬—২১ বছরে কোনো সরকারেরই সুবিবেচনা পায়নি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের সরকার কর্তৃক গঠিত ‘শামসুল হক কমিটির’ রিপোর্টেও এ বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার কর্তৃক অধ্যাপক কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে এই সাংবিধানিক অঙ্গীকারটিকে বাস্তবায়নের সুস্পষ্ট সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং বর্তমানে তা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।
এ দেশে ১১ ধরনের প্রাথমিক শিক্ষা চালু রয়েছে। তালিকাটা দেখুন:
এক. সরকারি প্রাইমারি স্কুল
দুই. এক্সপেরিমেন্টাল প্রাইমারি স্কুল
তিন. রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাইমারি স্কুল
চার. নন-রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাইমারি স্কুল,
পাঁচ. প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট-সংযুক্ত প্রাইমারি স্কুল,
ছয়. কমিউনিটি স্কুল,
সাত. স্যাটেলাইট স্কুল,
আট. হাইস্কুলের সঙ্গে সংযুক্ত প্রাইমারি স্কুল,
নয়. এনজিও পরিচালিত স্কুল,
দশ. কিন্ডারগার্টেন ও
এগারো. ইবতেদায়ি মাদ্রাসা।
শিক্ষাজীবনের শুরুতেই শিশুকে এত ধরনের বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থার জালে আটকে ফেলার এহেন নৈরাজ্যকর ব্যবস্থা বিশ্বের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। মাদ্রাসা শিক্ষার অপর পিঠে দেশে ইংরেজি মাধ্যম কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা বৃদ্ধিকেও নাটকীয় বলা চলে। মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত পিতা-মাতা তাঁদের সন্তানদের জন্য এখন আর বাংলামাধ্যম প্রাইমারি স্কুলগুলোকে উপযুক্ত মানসম্পন্ন মনে করছেন না, কিন্ডারগার্টেনে পড়ানোটাই নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে গত সাড়ে চার দশকে। এগারো ধরনের প্রাথমিক শিক্ষা চালু থাকতে দেওয়া কি অসাংবিধানিক নয়?
শিক্ষা খাতে সবচেয়ে বিপজ্জনক দিকটি হলো হাজার হাজার কওমি মাদ্রাসার নাটকীয় বিস্তার। বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও এরশাদ মাদ্রাসা শিক্ষাকে রাজনৈতিক প্রয়োজনে বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ায় গত ৪৭ বছরে এ দেশে হাজার হাজার মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মাদ্রাসাগুলোতে যেহেতু একই সঙ্গে আবাসিক সুবিধা এবং আহারের ব্যবস্থা থাকে, তাই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জন্য এগুলোর আকর্ষণ ক্রমবর্ধমান। মাধ্যমিক শিক্ষায়ও চারটি ধারার সমান্তরাল অবস্থান—ইংরেজি মাধ্যমের নানান কিসিমের মহার্ঘ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মূল ধারার বাংলামাধ্যম সরকারি স্কুল, বাংলা মাধ্যম বেসরকারি স্কুল এবং কয়েক ধরনের মাদ্রাসা। আমরা এখন ভুলে গেছি যে বঙ্গবন্ধুর আমলে একটিও নতুন ক্যাডেট কলেজ স্থাপিত হয়নি; বরং কুদরাত-এ-খুদা কমিশন ধাপে ধাপে ক্যাডেট কলেজগুলোকে মূলধারার মাধ্যমিক শিক্ষার সঙ্গে একীভূত করার সুপারিশ করেছিল, অথচ এখন উল্টো সারা দেশে ও লেভেল/এ লেভেল চালু হচ্ছে যত্রতত্র। এই বিভাজিত ও বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে আমরা এক দেশের মধ্যে চারটি পৃথক জনগোষ্ঠী সৃষ্টি করে চলেছি!
বঙ্গবন্ধু দেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৯৭৩ সালে প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ জারি হয়েছিল এবং পরে রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে। এটা মোটেও কাকতালীয় নয় যে ওই চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পর গত ৪৭ বছরে এ দেশের আর কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়নি। ১৯৯২ সালে বিএনপি সরকার দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আইন চালু করার পর প্রাইভেট সেক্টরে উচ্চশিক্ষা এখন মহার্ঘ্য পণ্যে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার এহেন বাজারীকরণ কি অসাংবিধানিক নয়? বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী বর্তমান সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে ‘মুক্তবাজার অর্থনীতির’ পুঁজিবাদী দর্শন অব্যাহত রেখে শিক্ষা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর অঙ্গীকারকে কি উপহাস করছে না?
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরুর লগ্নে বাংলাদেশ ছিল একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদ। এই ভয়াবহ সংকট মোকাবিলায় সরকারের কোষাগার ছিল শূন্য। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল—এই ২৪ বছরের সময়টাজুড়ে পশ্চিম পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হিসেবে শোষণ, লুণ্ঠন ও অবিশ্বাস্য রকম বঞ্চনার শিকার হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান।
মুক্তিযুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী আক্ষরিকভাবেই ‘পোড়ামাটি’ নীতি অবলম্বন করেছিল। (‘বেলুচিস্তান ও বাংলার কসাই’ সমরনায়ক টিক্কা খানের ঘোষণা ছিল, ‘মুঝে আদমি নেহি মিট্টি চাহিয়ে’)। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসার আগেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন সরকার সংকট মোকাবিলার কঠিন সংগ্রামে জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামিয়ে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ঘোষিত বাংলাদেশের প্রথম সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের তিনটি রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণ করেছিল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। বঙ্গবন্ধু এগুলোর সঙ্গে যোগ করলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদ।
এই চারটি রাষ্ট্রনীতির ভিত্তিতে দেশের সংবিধান রচিত হলো। বঙ্গবন্ধু দেশের শ্রেষ্ঠ চারজন অর্থনীতিবিদকে রাজি করালেন পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান এবং সদস্য হওয়ার জন্য। প্রফেসর নুরুল ইসলাম হলেন মন্ত্রীর পদমর্যাদায় ডেপুটি চেয়ারম্যান, আর প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় সদস্য হলেন প্রফেসর মোশাররফ হোসেন, প্রফেসর রেহমান সোবহান ও প্রফেসর আনিসুর রহমান। কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন প্রফেসর এ আর খান, প্রফেসর মুজাফফর আহমদ, ড. স্বদেশ রঞ্জন বোস ও প্রফেসর শামসুল ইসলামের মতো মেধাবী ব্যক্তিরা। অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী তাজউদ্দীন এবং পরিকল্পনা কমিশনের নেতৃত্বে শুরু হলো ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সরকারি বাজেট এবং প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ।
বঙ্গবন্ধু সরকারের ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের প্রথম বাজেটে শিক্ষা খাতে এ দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২১ দশমিক ১৬ শতাংশ সরকারি ব্যয় বরাদ্দ করা হয়েছিল। তখনকার যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির বাস্তবতায় শিক্ষা খাতে এত বেশি ব্যয় বরাদ্দ যে সরকারের জন্য কত বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, তা এখন চিন্তাও করা যাবে না। এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে জনগণকে দ্রুত শিক্ষিত করে গড়ে তোলাই যে উন্নয়নের মূল দর্শন হতে হবে, সে বিষয়টি বঙ্গবন্ধু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের শেষ ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরের বাজেটেও শিক্ষা খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। দুঃখজনক হলো, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ক্ষমতাসীন জিয়াউর রহমান ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা খাতের সরকারি ব্যয় বরাদ্দকে ১১ শতাংশের নিচে নামিয়ে এনেছিলেন। তখন থেকে পুরো জিয়া আমল এবং এরশাদ আমলে প্রতিরক্ষা খাতের সরকারি ব্যয় বরাদ্দ সরকারের প্রধান অগ্রাধিকারে পরিণত হয়েছিল। ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয় বরাদ্দ ছিল বাজেটের মাত্র ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০০১-০৬ মেয়াদের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় কয়েক বছর শিক্ষা খাতের সরকারি ব্যয়কে জিডিপির ২ শতাংশেরও নিচে নামিয়ে ফেলা হয়েছিল। ওই সময়ে শিক্ষা খাতের সরকারি ব্যয় জিডিপির অনুপাতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে ছিল সর্বনিম্ন। আরও দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির উত্তরসূরি দাবিদার বর্তমান সরকার নিজেদের শিক্ষাবান্ধব সরকার বলে গলাবাজি করলেও চলমান ২০২১-২২ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয় বরাদ্দ জিডিপির ২ দশমিক ৩ শতাংশেই আটকে রয়েছে। ১৩ বছর ধরে এই অনুপাত জিডিপির ২ দশমিক ২ থেকে ২ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। অথচ ইউনেসকো বলছে, জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত, বাংলাদেশও ওই অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষরকারী দেশ।
১৯৭২ সালের সংবিধানে শিক্ষা সম্পর্কে অঙ্গীকার বিধৃত হয়েছে ১৭ নম্বর ধারায়, যা নিম্নরূপ:
‘রাষ্ট্র (ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য,
(খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সংগতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য,
(গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’
ওপরে উল্লিখিত অঙ্গীকার মোতাবেক দেশের প্রাথমিক শিক্ষাকে ‘একক মানসম্পন্ন’ কারিকুলামে নিয়ে আসাই সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। এই সাংবিধানিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭২ সালেই পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক ঘোষণা করার পাশাপাশি দেশের সব প্রাথমিক স্কুলকে জাতীয়করণ করেছিল। ১৯৭৪ সালে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের যে প্রতিবেদনটি সরকার গ্রহণ করেছিল, তাতে ওই বাধ্যতামূলক, অবৈতনিক ও একক মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বর্ধিত করার প্রস্তাব ছিল। জাতির দুর্ভাগ্য, কুদরাত-এ-খুদা কমিশনের রিপোর্ট সরকার গ্রহণ করেছে মর্মে সরকারি গেজেট প্রকাশিত হওয়ার আগেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছিলেন।
ওই রিপোর্টের সুপারিশগুলো ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬—২১ বছরে কোনো সরকারেরই সুবিবেচনা পায়নি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের সরকার কর্তৃক গঠিত ‘শামসুল হক কমিটির’ রিপোর্টেও এ বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার কর্তৃক অধ্যাপক কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে এই সাংবিধানিক অঙ্গীকারটিকে বাস্তবায়নের সুস্পষ্ট সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং বর্তমানে তা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।
এ দেশে ১১ ধরনের প্রাথমিক শিক্ষা চালু রয়েছে। তালিকাটা দেখুন:
এক. সরকারি প্রাইমারি স্কুল
দুই. এক্সপেরিমেন্টাল প্রাইমারি স্কুল
তিন. রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাইমারি স্কুল
চার. নন-রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাইমারি স্কুল,
পাঁচ. প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট-সংযুক্ত প্রাইমারি স্কুল,
ছয়. কমিউনিটি স্কুল,
সাত. স্যাটেলাইট স্কুল,
আট. হাইস্কুলের সঙ্গে সংযুক্ত প্রাইমারি স্কুল,
নয়. এনজিও পরিচালিত স্কুল,
দশ. কিন্ডারগার্টেন ও
এগারো. ইবতেদায়ি মাদ্রাসা।
শিক্ষাজীবনের শুরুতেই শিশুকে এত ধরনের বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থার জালে আটকে ফেলার এহেন নৈরাজ্যকর ব্যবস্থা বিশ্বের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। মাদ্রাসা শিক্ষার অপর পিঠে দেশে ইংরেজি মাধ্যম কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা বৃদ্ধিকেও নাটকীয় বলা চলে। মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত পিতা-মাতা তাঁদের সন্তানদের জন্য এখন আর বাংলামাধ্যম প্রাইমারি স্কুলগুলোকে উপযুক্ত মানসম্পন্ন মনে করছেন না, কিন্ডারগার্টেনে পড়ানোটাই নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে গত সাড়ে চার দশকে। এগারো ধরনের প্রাথমিক শিক্ষা চালু থাকতে দেওয়া কি অসাংবিধানিক নয়?
শিক্ষা খাতে সবচেয়ে বিপজ্জনক দিকটি হলো হাজার হাজার কওমি মাদ্রাসার নাটকীয় বিস্তার। বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও এরশাদ মাদ্রাসা শিক্ষাকে রাজনৈতিক প্রয়োজনে বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ায় গত ৪৭ বছরে এ দেশে হাজার হাজার মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মাদ্রাসাগুলোতে যেহেতু একই সঙ্গে আবাসিক সুবিধা এবং আহারের ব্যবস্থা থাকে, তাই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জন্য এগুলোর আকর্ষণ ক্রমবর্ধমান। মাধ্যমিক শিক্ষায়ও চারটি ধারার সমান্তরাল অবস্থান—ইংরেজি মাধ্যমের নানান কিসিমের মহার্ঘ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মূল ধারার বাংলামাধ্যম সরকারি স্কুল, বাংলা মাধ্যম বেসরকারি স্কুল এবং কয়েক ধরনের মাদ্রাসা। আমরা এখন ভুলে গেছি যে বঙ্গবন্ধুর আমলে একটিও নতুন ক্যাডেট কলেজ স্থাপিত হয়নি; বরং কুদরাত-এ-খুদা কমিশন ধাপে ধাপে ক্যাডেট কলেজগুলোকে মূলধারার মাধ্যমিক শিক্ষার সঙ্গে একীভূত করার সুপারিশ করেছিল, অথচ এখন উল্টো সারা দেশে ও লেভেল/এ লেভেল চালু হচ্ছে যত্রতত্র। এই বিভাজিত ও বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে আমরা এক দেশের মধ্যে চারটি পৃথক জনগোষ্ঠী সৃষ্টি করে চলেছি!
বঙ্গবন্ধু দেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৯৭৩ সালে প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ জারি হয়েছিল এবং পরে রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে। এটা মোটেও কাকতালীয় নয় যে ওই চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পর গত ৪৭ বছরে এ দেশের আর কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়নি। ১৯৯২ সালে বিএনপি সরকার দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আইন চালু করার পর প্রাইভেট সেক্টরে উচ্চশিক্ষা এখন মহার্ঘ্য পণ্যে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার এহেন বাজারীকরণ কি অসাংবিধানিক নয়? বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী বর্তমান সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে ‘মুক্তবাজার অর্থনীতির’ পুঁজিবাদী দর্শন অব্যাহত রেখে শিক্ষা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর অঙ্গীকারকে কি উপহাস করছে না?
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
‘দুই দিন আগেই বাড়ি থেকে পাথরঘাটায় চলে এসেছি। এখন পুরোনো জাল সেলাই করছি। এক সপ্তাহের বাজারও করে এনেছি। আজ বিকেলে সাগর মোহনায় যাব, গভীর রাত থেকে জাল ফেলব।’ কথাগুলো বলছিলেন বরগুনা সদরের বাইনচটকী এলাকার জেলে হোসেন আলী। গতকাল বুধবার সকালে বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে কথা হয় তাঁর...
১২ জুন ২০২৫ভারতের স্থলবন্দর নিষেধাজ্ঞার পর সীমান্তে আটকে থাকা তৈরি পোশাক, খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের ট্রাকগুলো ফেরত আনছেন রপ্তানিকারকেরা। তবে যেসব ট্রাক বন্দরে ঢুকে গিয়েছিল, সেগুলো ভারতে প্রবেশ করানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব ট্রাক ঢুকতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে।
১৯ মে ২০২৫আধুনিক যুগের সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলোর একটি হচ্ছে গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষের সঙ্গে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক রত্নসম্ভার। গতকাল বুধবার হংকংয়ে বিখ্যাত আর্ট নিলাম কোম্পানি সাদাবি’স-এর এক নিলামে এগুলো তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
০৮ মে ২০২৫পাকিস্তানে ভারতের হামলার সমালোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চীনও এই হামলাকে ‘দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করেছে। উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘও। উত্তেজনা যেন আরও না বাড়ে, সে জন্য দুই পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ। এদিকে ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করেছে...
০৮ মে ২০২৫