Ajker Patrika

যৌন হয়রানি: উচ্চ আদালতের রায় ও বাস্তবতা

প্রতিনিধি, বাজিতপুর (কিশোরগঞ্জ)
আপডেট : ২১ মার্চ ২০২৪, ১৩: ৫৪
যৌন হয়রানি: উচ্চ আদালতের রায় ও বাস্তবতা

২০০৯ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ একটি যুগান্তকারী রায়ে কর্মক্ষেত্র এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারী ও মেয়েদের যৌন হয়রানি নিষিদ্ধ করে ১১ দফা নির্দেশনা প্রদান করেন। এই ১১ দফা নির্দেশনায় কর্মক্ষেত্র এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হয়রানির সম্ভাব্য সব উপাদান অন্তর্ভুক্ত করে যৌন হয়রানিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়। একই সঙ্গে কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে অভিযোগ কমিটি গঠন বাধ্যতামূলক করা হয়। নির্দেশনা অনুযায়ী গঠিত অভিযোগ কমিটিগুলো নারী ও মেয়েদের দায়ের করা যৌন হয়রানির অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত পরিচালনা এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

উচ্চ আদালতের ১১ দফা নির্দেশনা থাকার পরেও কর্মক্ষেত্র এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে অভিযোগ কমিটির কার্যকারিতার দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই; বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে প্রায়ই কার্যকর প্রতিকারব্যবস্থা স্থাপন করা হয় না। এর একটি দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ হলো, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার আত্মহননের সাম্প্রতিক ঘটনা। এই ঘটনা থেকে আমরা যা জানতে পেরেছি, তাতে কিছু বিষয় প্রতীয়মান হয়: যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটির গঠন ও কার্যকারিতা নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের অবগত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যর্থতা, যৌন হয়রানিবিষয়ক অভিযোগের প্রতিকারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দীর্ঘসূত্রতা ও যৌন হয়রানির ঘটনা ধামাচাপা দিতে ক্ষমতাশালী ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ।

উচ্চ আদালতের ১১ দফা নির্দেশনার ৯ বছর পর ২০১৮ সালে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, ৬৪ দশমিক ৫ শতাংশ পেশাজীবী এবং ৮৭ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাইকোর্টের ১১ দফা নির্দেশনা সম্পর্কে অবগত নন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসে যৌন হয়রানির শিকার হওয়া সত্ত্বেও এই বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করার সংখ্যা অপ্রতুল। হাইকোর্টের ১১ দফা নির্দেশনার পর এক যুগ অতিবাহিত হওয়ার পরও নারী ও মেয়েদের যৌন হয়রানির ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। যৌন হয়রানির ঘটনায় ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হলো অপরাধীদের দায়মুক্তি দেওয়া। এ ছাড়া উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী কার্যকরী অভিযোগ কমিটি গঠন না করা, সুনির্দিষ্ট করে নতুন আইন প্রণয়ন না করা এবং বিদ্যমান আইনি সুরক্ষার বিষয়ে জনসচেতনতা না থাকা। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) একটি গবেষণা পরিচালনা করে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে অভিযোগ কমিটি গঠন, কার্যকারিতা, কমিটিতে প্রাপ্ত যৌন হয়রানির অভিযোগের সংখ্যা, অভিযোগ নিষ্পত্তির সময়কাল ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাওয়া ছিল এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য।

এই গবেষণায় তথ্য সংগ্রহের জন্য সারা দেশের ৮টি বিভাগের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯-এর অধীনে তথ্য চেয়ে (আরটিআই) আবেদন করা হয়। ইউজিসি অনুমোদিত মোট ১৫৯ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৪৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আরটিআই আবেদন করা হয়, যা মোট বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৯ শতাংশ। আবেদন করা ৪৫ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২৮টি থেকে জবাব পাওয়া গেছে। বাকি ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আপিলের আবেদন করা হলেও তারা তথ্য দেয়নি।

তা ছাড়া তথ্য অধিকার আইনে নির্ধারিত ২০ কর্মদিবসের মধ্যে জবাব পাঠাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তথ্য চেয়ে আবেদনের জবাব পাঠাতে ন্যূনতম ২২ দিন ও সর্বোচ্চ ৬৩ দিন সময় নিয়েছে। নমুনায়নকৃত ৪৫টির মধ্যে ২৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য প্রদানকারী ইউনিট ও অভিযোগ কমিটির তথ্য সংশ্লিষ্ট সবার জন্য উন্মুক্ত নয়। ফলে তথ্য সেবা নিশ্চিতকরণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তথ্য ইউনিট ও অভিযোগ কমিটির তথ্যাদি উন্মুক্ত ও শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। নমুনায়নকৃত সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়েরই নিজস্ব ওয়েবসাইট রয়েছে। তবে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী তথ্য ইউনিটের নাম ও ঠিকানা তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেনি। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অভিযোগ কমিটি গঠনে এগিয়ে রয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় (৫৯ শতাংশ)। অন্যদিকে আরটিআই আবেদনের জবাব দেওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, যা মোট জবাব দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ৫৪ শতাংশ।

ইউজিসি থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিদ্যমান ১৫৯টির মধ্যে ২৮টি বিশ্ববিদ্যালয় অভিযোগ কমিটি গঠন করেছে। অভিযোগ কমিটি গঠনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চ আদালতের নির্দেশনার তারিখ থেকে ন্যূনতম ৩৬৪ দিন ও সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৫৪২ দিন ব্যয় করেছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় কমিটি গঠনের সময়সীমা উল্লেখ না থাকায়, অভিযোগ কমিটি গঠনে দীর্ঘসূত্রতা দেখা যায়।

অন্যদিকে ন্যূনতম ৫ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠনের নির্দেশনা থাকলেও তা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমানভাবে অনুসরণ করেনি। নমুনায়নকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, অভিযোগ কমিটি গঠনে সদস্যসংখ্যা ন্যূনতম ছিল ৩ জন এবং সর্বোচ্চ ১৩ জন। সভাপতিসহ অধিকাংশ সদস্য নারী থাকার নির্দেশনা থাকলেও কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় তা অনুসরণ করেনি।

এই গবেষণায় সামগ্রিকভাবে দেখা যায়, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কার্যক্রম ইউজিসি নিয়মিত নিরীক্ষণ করে না। অভিযোগ কমিটির দক্ষতা ও কার্যপ্রণালি বিধির শূন্যতা লক্ষ করা যায়। অভিযোগকারী এবং সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রস্তাবিত সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রয়োজন। তদুপরি যৌন হয়রানি প্রতিরোধমূলক একটি আইন ও তার কার্যকরী বাস্তবায়ন, যৌন হয়রানি কমাতে সহায়ক হতে পারে। গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন হয়রানির প্রতিকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে এবং এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে আইন, নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক অনুশীলনে প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য সুপারিশ প্রদান করা হয়েছে: (ক) বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন হয়রানি প্রতিরোধমূলক কমিটির গঠন, কার্যকারিতা ও অভিযোগ দাখিল প্রক্রিয়ার বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কর্তৃপক্ষের ব্যাপক উদ্যোগের প্রয়োজন; (খ) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি গঠন বাধ্যতামূলক করা; (গ) সিন্ডিকেট সভায় ক্ষমতাশালী ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করা; (ঘ) বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করে, দ্রুত সময়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা; (ঙ) প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয় টোল ফ্রি হটলাইন নম্বর ও অনলাইনে অভিযোগ দায়ের করার ব্যবস্থা চালু করা; (চ) উচ্চ আদালতের ১১-দফা নির্দেশনায় অভিযোগ কমিটি গঠনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারিত না থাকায় অভিযোগ কমিটি গঠনে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়, তাই কমিটি গঠনের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া প্রয়োজন।

তাহ্‌মিনা রহমান, বিশেষজ্ঞ, বাকস্বাধীনতা ও সদস্য, ট্রাস্টি বোর্ড, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

‘ভারতে ঢুকে’ পাকিস্তানি সেনাদের গুলি, সীমান্তে সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে

এনবিআর চেয়ারম্যানের কক্ষের সামনে কর্মকর্তাদের অবস্থান

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত