Ajker Patrika

জীবনদৃষ্টিতে সমৃদ্ধ সংস্কৃতিজন রণেশ দাশগুপ্ত

অমিত রঞ্জন দে
জীবনদৃষ্টিতে সমৃদ্ধ সংস্কৃতিজন রণেশ দাশগুপ্ত

রণেশ দাশগুপ্তের সব কাজই ছিল অত্যন্ত জীবনঘনিষ্ঠ। বিশেষ করে তাঁর সাহিত্যে বাস্তব সমাজ ও জীবনের প্রতিচ্ছবি উঠে এসেছে প্রখরভাবে। তিনি সব সময় শোষণমুক্তির আদর্শ লালন করেছেন।

রণেশ দাশগুপ্ত মানবকল্যাণে ব্রতী বিংশ শতাব্দীর এক অসাধারণ মানুষ ছিলেন। মহৎ লক্ষ্যে সমাজ রূপান্তরের সংগ্রামে আমৃত্যু নিবেদিত থেকে তিনি কখনো রাজনৈতিক কর্মী, কখনো সাহিত্যকর্মী হিসেবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নির্মোহভাবে কাজ করে গেছেন। রণেশ দাশগুপ্ত বুদ্ধিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের মাঝখানে যে দেয়াল রয়েছে, তা ভেঙে ফেলার চেষ্টা প্রতিনিয়ত করে গেছেন। তিনি নিজেকে একজন মেধাসম্পন্ন কলমজীবীতে পরিণত করেছিলেন। সামাজিক সব অসাম্য দূর করতে তিনি তাঁর হাতের কবজি আর আঙুলের সাহায্যে কলম চালিয়ে শিল্প ও সাহিত্যে জীবনের সামগ্রিক সত্যকে তুলে ধরেছেন। তিনি ১৯৩৯-৪০ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত প্রগতিশীল লেখকদের অন্যতম সংগঠন ‘প্রগতি লেখক সংঘ’ (১৯৩৯-৪০) গঠনে অনন্য ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪০ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম সম্মেলনে প্রগতি লেখক সংঘের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই সাহিত্য আন্দোলনের মূল সুর ছিল পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধবিরোধী। প্রগতি লেখক সংঘে ব্যাপকসংখ্যক লেখক-লেখিকা সংঘবদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁদের সংঘবদ্ধ করায় নেতৃস্থানীয় সদস্য রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন ও সোমেন চন্দের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন কাজী আব্দুল ওদুদ, সতীশ পাকড়াশী, অচ্যুত গোস্বামী, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, অমৃত কুমার দত্ত, সরলানন্দ, অজিত গুহ, সরদার ফজলুল করিম, মুনীর চৌধুরী, সৈয়দ নুরুদ্দিন, সানাউল হক প্রমুখ। কিরণশঙ্কর সেনগুপ্তের ভাষায়, রণেশ দাশগুপ্ত ছিলেন এই সাহিত্য আন্দোলনের ‘ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড’। কোনো কাজ সম্পন্ন করার আগে তাঁর পরামর্শ নেওয়া হতো।

রণেশ দাশগুপ্ত তাঁর গোটা জীবনকে একটা বিন্দু থেকে নানা রেখায় টেনে দিয়েছেন। তিনি ১৯৩৮ সালে ঢাকায় নলিনীকিশোর গুহ সম্পাদিত সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। সে বছরই পিতার মৃত্যু ঘটলে সংসারের অর্থাভাব মেটাতে তিনি একটি ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি গ্রহণ করেন। তাঁর সাংবাদিকতা, লেখালেখি, জীবনভাবনা—সবকিছুই রাজনীতির অংশ হয়ে পড়ে।

ফলে তাঁকে বারবার কারাবরণ করতে হয়। ১৯৫৫ সালে কারামুক্তির পর স্বল্প সময়ের জন্য তিনি ইত্তেফাকে যোগ দেন। এরপর ১৯৫৮ সাল থেকে বামপন্থীদের পরিচালিত দৈনিক সংবাদে যুক্ত হন। তিনি ১৯৫৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়ে তাঁতীবাজার এলাকা থেকে কমিশনার নির্বাচিত হন এবং সেখানেও দক্ষতার পরিচয় দেন। এ সময় তিনি ঢাকা সিটি করপোরেশনে রিকশার লাইসেন্স প্রদানের মতো শ্রমঘনিষ্ঠ কাজের দায়িত্ব পালন করেন।

রাজনৈতিক সম্পৃক্তির কারণে রণেশ দাশগুপ্তকে বহুবার কারা অন্তরালে যেতে হয়েছে। তিনি ৭৬ বছরের জীবনে প্রায় ১২ বছর কারাগারে অবরুদ্ধ থেকেছেন। কিন্তু কারাগারের অন্ধকার এই মহান বিপ্লবীর সাংস্কৃতিক কার্যক্রমকে অবরুদ্ধ করতে পারেনি। জেলে বসেই তিনি সাহিত্যের অনুশীলনসহ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। তাঁর বিশেষ অনুরোধে ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের প্রথম বার্ষিকীতে আরেক রাজবন্দী মুনীর চৌধুরী ‘কবর’ নাটকটি লিখেছিলেন, যা রণেশ দাশগুপ্তের প্রচেষ্টায় জেলখানাতেই অভিনীত হয়। তিনি জেলের ভেতরে রাজবন্দীদের বিভিন্ন বিষয়ে পাঠ দিতেন। সেখানে ভাষার ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস, তারপর ক্রিস্টোফার কডওয়েলের ‘ইলিউশন অ্যান্ড রিয়েলিটি’ ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতেন।

রণেশ দাশগুপ্ত ঢাকায় বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলা, ব্যাংক ও ইনস্যুরেন্স কর্মচারীদের সংগঠিত করা, ‘প্রগতি লেখক সংঘ’ গড়ে তোলা, ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের সংগঠিত করা, নিয়মিত লেখনী, বক্তৃতা, বেতার-কথিকা প্রভৃতির মধ্য দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা অংশগ্রহণ করেন, তাঁদের উজ্জীবিত-উদ্দীপ্ত করা, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত থাকা, শিশু-কিশোর আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘খেলাঘর’ প্রতিষ্ঠায় অনন্য ভূমিকা রাখেন। রণেশ দাশগুপ্তের সব কাজই ছিল অত্যন্ত জীবনঘনিষ্ঠ। বিশেষ করে তাঁর সাহিত্যে বাস্তব সমাজ ও জীবনের প্রতিচ্ছবি উঠে এসেছে প্রখরভাবে। তিনি সব সময় শোষণমুক্তির আদর্শ লালন করেছেন। চেতনায় লালন করেছেন অসাম্প্রদায়িকতা। মুক্ত মানবের মুক্ত সমাজ বিনির্মাণ এবং আধুনিক প্রগতিশীল ভাবনাকে অগ্রসর করে নেওয়ার জন্য তিনি হাজির হয়েছেন বিশ্বসাহিত্যের দরবারেও। তাঁর পাঠের পরিধি তাই এই মহাদেশ ছাড়িয়ে ইউরোপ, আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত। তিনি বিশ্বসাহিত্য থেকে রস আস্বাদন করে আত্মস্থ করেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন এবং তা থেকে যে আলোর সন্ধান পেয়েছেন, তা তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন মানবকল্যাণে। দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে সাহিত্য ছিল তাঁর জীবনসঙ্গী।

রণেশ দাশগুপ্ত তাঁর রচনার মধ্য দিয়ে যেমন লোকায়ত জীবন, লোকঐতিহ্য, লোকগাথা, লোকভাষা ও তার মাহাত্ম্য অনুসন্ধান করেছেন; তেমনিভাবে আন্তর্জাতিক মার্ক্সবাদী সাহিত্য ও রাজনীতির সঙ্গে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকসমাজকে পরিচয় ঘটানোয় ব্রতী থেকেছেন। তিনি শ্রেষ্ঠ মনীষীদের বক্তব্য ও চিন্তাধারা থেকেই প্রত্যক্ষ করেছেন আলোকিত ভবিষ্যৎ। তাঁর জ্ঞানের গভীরতা তাঁর জীবনদৃষ্টিকে করে তুলেছে আশাবাদের বড় ভিত্তি। তিনি দেশ-বিদেশের মহান শিল্পী-সাহিত্যিক-লেখকদের জ্বালিয়ে দেওয়া প্রদীপ থেকে আলো সিঞ্চন করে আমাদের আলোকিত করার চেষ্টা করেছেন, যা মানুষের সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রবহমানতা ধরে রাখতে রসদ জুগিয়ে চলেছে।

১৯৯৭ সালের ৪ নভেম্বর দুপুর ১২টার দিকে চির আশাবাদী মানুষটি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। তবে তাঁর মৃত্যু তাঁকে নিঃশেষ করে ফেলতে পারেনি। তিনি চির জাগরূক হয়ে আছেন বা থাকবেন তাঁর সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও রাজনৈতিক জীবনদর্শনের মধ্য দিয়ে।

বর্তমান সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে, দেশে দেশে খাদ্য ও জ্বালানিসংকট মানুষের জীবনকে বিপদাপন্ন করে তুলছে, শিল্পোন্নত দেশগুলোর অপরিণামদর্শিতায় জলবায়ুর পরিবর্তনে বিপন্ন হয়ে পড়ছে প্রাণ-প্রকৃতি। জাতীয়ভাবে সাংস্কৃতিক বন্ধ্যত্ব তৈরি হওয়া ও ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানে শঙ্কিত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সব মানুষ। এই সময়ে সংকট উত্তরণের পথ সন্ধানী মানুষের রণেশ দাশগুপ্তের জীবনদর্শন থেকে পাঠ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। 

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পাকিস্তানে কীভাবে হামলা চালাতে পারে ভারত, ইতিহাস যা বলছে

জনবল-সরঞ্জাম বেশি হলেও সমরশক্তিতে ভারত কি পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে

প্রবাসীর রেমিট্যান্সের অর্থ আত্মসাৎ, নারী ব্যাংক কর্মকর্তা কারাগারে

ইতিহাস গড়ে পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদে আইএসআইপ্রধান

ভারতের সঙ্গে সংঘাতে পাকিস্তানের ভাগ্যনিয়ন্তা সেনাপ্রধান জেনারেল মুনির

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত