Ajker Patrika

ঈদ কখন উৎসব হয়ে ওঠে?

জাহীদ রেজা নূর
ঈদ কখন উৎসব হয়ে ওঠে?

ঈদ তো উৎসব। প্রাণে প্রাণে মিলিত হওয়ার উৎসব। দুই বছর করোনার ভয়াবহতার পর এবার কিন্তু ঈদের আনন্দ উপভোগ করার জন্য সব অর্গল ভেঙে গেছে। নতুন পোশাকের জন্য বিভিন্ন মার্কেটে ছুটতে দেখা গেছে মানুষকে। প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনা হয়েছে। যে যার নিজের ভিটেয় ছুটছে আনন্দ-উৎসবে স্বজনদের পাশে থাকার জন্য। আবার কেউ কেউ দেশে বা বিদেশের আকর্ষণীয় স্থানে যাচ্ছেন ঈদের ছুটি কাটাতে।

ঈদের সুযোগ নিয়ে আমাদের দেশে সব সময়ই কিছু ঘটনা ঘটে। পত্রপত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সেগুলো প্রচারিত হয়, কিন্তু ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ সেটাকে আমলে নেন কি না, আমার জানা নেই। সে রকম কিছু ঘটনা নিয়েই কথা বলব আজ।

যাঁরা নিয়মিত বাসে চেপে ঢাকা থেকে নিজ গন্তব্যে যান, তাঁরা ঈদের সময়ও একই ভাড়ায় যেতে পারেন, এমন নজির কম। এ সময় অকারণেই যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া আদায় করা হয়। কেন করা হয়, সে প্রশ্নের উত্তর কি দিতে পারবে কেউ? সে সময় জ্বালানির দাম বাড়ে না, বাস-কর্মচারীদের বেতন বাড়ে না, পথের দূরত্ব বাড়ে না, শুধু টিকিটের দাম বাড়ে। পত্রপত্রিকায় বাসের টিকিট নিয়ে সিন্ডিকেট গড়ার অভিযোগ প্রকাশিত হয়। অনেকেই জানে, কারা আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে। কিন্তু তাদের ধরা হয় না। শুধু শোনা যায় কত কোটি টাকা গরিব যাত্রীদের কাছ থেকে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু তাতে কারও টনক নড়ে না। কেন নড়ে না?

ঈদের সময় ট্রেনের টিকিট থেকে কত টাকা আত্মসাৎ করছে একদল রেল কর্মচারী, সে কথা কি কারও অজানা? সাধারণ যাত্রীরা অনলাইনে কিংবা টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট পান না, কিন্তু টিকিট কাউন্টারের অদূরেই কালোবাজারিদের কাছ থেকে টিকিট কিনতে পারেন। কীভাবে তা সম্ভব হয়? এই কালোবাজারির হাতে কোত্থেকে টিকিট আসে? টিকিটগুলো তো রেল কর্মচারীদের মাধ্যমেই কালোবাজারিদের হাতে যায়। এই কালোবাজারিরা প্রকাশ্যেই টিকিট বিক্রি করছে চড়া দামে। এদের তো পুলিশ ধরে না। এবার অবশ্য একটু ব্যতিক্রম দেখা গেল। টিকিট নিয়ে যখন হাহাকার, তখনই রেলের টিকিট বিক্রির প্রতিষ্ঠান সহজ ডটকমের সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার মো. রেজাউল করিমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকার অভিযোগে। দেখা যাক এরপর রেলের টিকিট নিয়ে দুর্নীতির অবসান হয় কি না।

ঈদ একটি উৎসব। প্রত্যেকেই এ উৎসবে নিজেকে এবং স্বজনদের মন রাঙিয়ে দিতে চায়। এই উৎসবের জন্য শ্রমিক বা কর্মচারীদের সময়মতো যেসব প্রতিষ্ঠান বোনাস দেয় না, সেই প্রতিষ্ঠানগুলো কিন্তু ন্যুব্জ নয়। অঢেল ব্যাংকঋণ নিয়ে যাঁরা কারখানা চালান, ঋণখেলাপি হন তাঁরা কিন্তু স্বচ্ছন্দে নিজেদের জীবন উপভোগ করেন। সেই ঋণ কতটা শোধ করা হবে, কতটা হবে না, সেটা জানা যায় ঋণ তফসিল-পুনঃ তফসিল করা দেখে। এই ঋণের কতটা মন্দ ঋণে পরিণত হবে, সেটা কি আগে থেকে বলে দেওয়া যায়? কিন্তু মন্দ ঋণ তো হচ্ছেই। সমাজের বিচারে তাঁরা উপরিস্তরের মানুষ। আসলে তাঁরা কেমন মানুষ?

সংযমের কথা বলতে গেলে তো নিদারুণ কৌতুকের দেখা পাওয়া যাবে। প্রতিবারের মতো রমজানে হঠাৎ করেই সবজির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে গেল। ২০ টাকার শসা প্রথম রোজায় গিয়ে পৌঁছেছিল ৯০ টাকায়। এবার অবশ্য পেঁয়াজের রক্তচক্ষু দেখা যায়নি। পেঁয়াজের দাম ২৮ টাকায় নেমে আসার ক্ষেত্রে কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে আরও একটি অদ্ভুত ঘটনার দিকে চোখ যায়। সেটা হলো, যে কৃষক পেঁয়াজ ফলান, তিনি কীভাবে বেঁচে আছেন? যখন পেঁয়াজের কেজি ২০০ টাকা হয়, তখনই বা সেই কৃষকের ভাগ্যবদল হয় না কেন?

জাহীদ রেজা নূরমাত্র চারটি ক্ষেত্রে অসাধুতার যে বর্ণনা দিলাম, তাতে পরিষ্কার হয়, আমাদের দেশে যেকোনো দুর্নীতি করেই পার পাওয়ার সুযোগ থাকে। রমজানে যে সংযমের শিক্ষা দেওয়া হয়, সেই সংযম কি আমাদের জীবনাচরণে আছে? এ প্রশ্নগুলো করতে হবে। নইলে ধর্ম, সংস্কৃতি, পরিচয় সবকিছুর মধ্যেই কৃত্রিম গর্ব এসে 
ভিড় করবে। জীবনাচরণে যা নেই, সেটাই হয়ে যাবে কল্পিত আরামের জায়গা। মিথ্যাই হয়ে যাবে আত্মপরিচয়। 

দুই.
এই মিথ্যার ওপর ভর করে আমরা যখন সংযম কিংবা সর্বজনীন উৎসবের কথা বলি, তখন তা মেকি হয়ে যায়। তখনই আমাদের মনে পড়ে যায়, পৃথিবীতে কেবল একবারই এমন এক ঈদ এসেছিল, যখন ঈদের চাঁদকে ফিরে যেতে বলা হয়েছিল। হ্যাঁ, একাত্তরের ঈদুল ফিতরের কথাই বলছি। পাকিস্তানি বাহিনীর ধ্বংসলীলার ভয়াবহতার মধ্যে সেবার ঈদ এসেছিল। তারিখটা ছিল ২০ নভেম্বর। বাঙালি তথা এই অবরুদ্ধ ভূখণ্ডে বসবাসকারী মানুষ কিংবা উদ্বাস্তু হয়ে পাশের দেশে আশ্রয় নেওয়া মানুষ কিংবা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া মানুষ—কেউই ঈদকে সাদরে বরণ করে নিতে পারেননি। কারণ, সেই ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে ঈদের আনন্দ উপভোগ করার মতো কোনো অবস্থা ছিল না।
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে ঈদ উপলক্ষে যে গানটি রেকর্ড করা হয়েছিল, সেটি লিখেছিলেন শহীদুল ইসলাম। সুর করেছিলেন অজিত রায়। গানটির প্রথম পঙ্‌ক্তি ছিল, ‘চাঁদ তুমি ফিরে যাও, দেখ মানুষের খুনে খুনে রক্তিম বাংলা, রূপসী আঁচল কোথায় রাখব বলো...?’ স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে ঈদের সারা দিনই একটু পর পর বেজে ছিল গানটি।

সেদিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ নামাজ আদায় করেছিলেন। কিন্তু কোনো খাবার খাননি। তাঁর মন্ত্রণালয়েই কাটিয়েছেন সময়। যাঁরা ভেবেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর কর্মস্থলে কিংবা বাড়িতে ঈদ আয়োজন থাকবে, তাঁরা হতাশ হয়েছিলেন। বাড়িতে রান্না হয়েছিল আলুভর্তা, শাক, ডাল আর ভাত। ঈদের দিন তাজউদ্দীন আহমদ একবারের জন্যও বাড়িতে যাননি। সেদিন তিনি প্রথম খাবার খেয়েছিলেন মধ্যরাতে, কুষ্টিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বসে। 
ঈদ উপলক্ষে তিনি যে বাণী দেন, তাতে ছিল এ কথাগুলো, ‘আমাদের দেশে এবার ঈদ এসেছে অত্যন্ত মর্মান্তিক পরিবেশে। দখলীকৃত এলাকায় শত্রুসৈন্যের তাণ্ডব চলছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেকে বিচ্যুত হয়ে শরণার্থী হয়েছেন, মুক্ত এলাকায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি চলছে শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য, রক্তের বিনিময়ে মানুষ মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষা করার সংগ্রাম করছে। এবার ঈদে আনন্দ মুছে গেছে আমাদের জীবন থেকে, আছে শুধু স্বজন হারানোর শোক, দুর্জয় সংগ্রামের প্রতিজ্ঞা ও আত্মত্যাগের প্রবল সংকল্প।’ 
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘পবিত্র রমজান মাসেও হানাদার বাহিনীর বর্বরতায় বাংলাদেশের মুসলমান, হিন্দুনির্বিশেষে অসংখ্য নর-নারী নিহত হচ্ছে।...এবারও আমরা ইয়াহিয়ার সৈন্যদের বর্বরতায় নিহত ১০ লাখ ভাইবোনের বিয়োগবেদনা বুকে নিয়ে ঈদের জামাতে শামিল হয়েছি। কিন্তু দুঃখ-কষ্ট যা-ই হোক, ত্যাগের মন্ত্রে আমরা উদ্বুদ্ধ এবং যেকোনো ত্যাগের মূল্যে স্বাধীনতার ঘোষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে বদ্ধপরিকর।’ 

তিন.
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি মাত্র ঈদ এসেছিল আমাদের জীবনে। এরপর দেশ স্বাধীন হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়া মানে নিজের ভাগ্য নিজে গড়ে নেওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার সুযোগ আসা। কিন্তু সেই স্বপ্ন কি আমাদের পূরণ হয়েছে? লেখার শুরুতে যে উদাহরণগুলো দেওয়া হলো, সেগুলো তো স্বাধীন দেশের মানুষেরই অনাসৃষ্টি। তাতে বোঝা যায়, দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন খুব একটা হয়নি, কিছু মানুষ শুধু নিজের ভাগ্য গড়ে নিয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ঈদের চাঁদকে ফিরে যেতে বলা হয়েছিল। তার কারণ ছিল। এখনো চাঁদকে একই অনুরোধ করার মতো যথেষ্ট কারণ আছে, কিন্তু আমরা চাঁদকে ফিরে যেতে বলছি না। কারণ, মনে আমাদের প্রত্যয় নেই। ভবিষ্যতে প্রত্যয়ী প্রজন্ম এসে এই সব ভুল-চুক-অন্যায় ধুয়ে-মুছে সাফ করে দেবে, সেই প্রত্যাশায় থাকতে হবে আমাদের এবং আমরাও যেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে অন্যায়কারীদের শাস্তি দেওয়ার উপযোগী হয়ে উঠি, সেই প্রচেষ্টাও চালাতে হবে। আর থাকতে হবে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, অন্যকে ভালোবেসে জীবন পরিচালিত করা—ঈদ তখনই হয়ে উঠবে উৎসব।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ইরানের ‘দানবীয় ক্ষেপণাস্ত্রের’ সামনে উন্মুক্ত ইসরায়েলের ‘অ্যাকিলিস হিল’

মা-মেয়ের ত্রিভুজ প্রেম, বিয়ে ও একটি খুন

পাকিস্তানের পরমাণু প্রকল্প ধ্বংসে ভারত-ইসরায়েলের যৌথ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় যেভাবে

খামেনি কোথায়, কেমন আছেন—উৎকণ্ঠিত ইরানিদের প্রশ্নের বন্যা

এই বিজয় বাংলাদেশি আন্টিদের বিজয়: জোহরান মামদানি

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত