Ajker Patrika

যে নজরুলকে আমরা চাই

জাহীদ রেজা নূর
যে নজরুলকে আমরা চাই

কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে কথা বলার বিপদ আছে। কোনো একটা নির্দিষ্ট দর্শনে তাঁকে বাঁধা যায় না। যে কেউ তাঁকে ‘আমাদের’ লোক বলতে পারে, আবার যে কেউ তাঁকে ‘অন্যের লোক’ বলে পরিত্যাগ করতে পারে। এর কারণ কিন্তু আর কিছু নয়, তিনি ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ভেদাভেদকে থোড়াই কেয়ার করেছেন। যত দিন সজ্ঞানে বেঁচেছেন, তত দিন জীবনটাকে উপভোগ করেছেন। দুঃখের মধ্যেও আনন্দকে হাতছাড়া হতে দেননি।

সব অর্থেই দারুণ রকম বেহিসেবি তিনি। কোনো বাঁধনেই তাঁকে বাঁধা যায় না। প্রবল আবেগে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছেন আশপাশের সবাইকে, আবার প্রবল বেদনায় জারিতও করেছেন মানুষের মন। তাই নজরুলকে চিনে নেওয়ায় ফাঁক থাকতেই পারে।

কিন্তু এরই মধ্যে যে কথাগুলো নিয়ে দ্বিমত নেই কারও তা হলো, নজরুলের মতো অসাম্প্রদায়িক মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। তাঁর সাংস্কৃতিক জীবন কোনো  নির্দিষ্ট ধর্মের অনুশাসনে গড়া নয়। একই সঙ্গে হামদ-নাত-শ্যামাসংগীত লিখে চলেছেন তিনি। তারও আগে, রুশ বিপ্লবের একটা প্রবল ঝড়ে মানুষই যখন হয়ে উঠল আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু, তখন তিনি শৈল্পিকভাবে মানুষের জয়গান গেয়েছেন। ছয়মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত ‘মানুষ,’ ‘কুলী-মজুর’, ‘নারী’সহ কবিতাগুলো কী দৃঢ়তার সঙ্গে সাম্যের কথা বলে!

নজরুলকে সব সময়ই বিতর্কিত করে রাখার চেষ্টা হয়েছে; বিশেষ করে পাকিস্তান আমলে সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের সন্ধানে ব্যাপৃত মানুষ যখন নিজেকে চিনে নেওয়ার চেষ্টা করছিল, তখন রবীন্দ্রনাথ-নজরুলকে নিয়ে নানা ধরনের তামাশার সৃষ্টি করেছিল সরকার ও সরকারের তাঁবেদারেরা।

সেই ইতিহাস না জানলে নজরুলকে নিয়ে বর্তমান মৌলবাদী আচরণের পরিচয় পাওয়া যাবে না; বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলামের তুলনার মাধ্যমে সাহিত্যক্ষেত্রে একটা অস্থিরতার সৃষ্টি করা হয়েছিল। সেইটুকু রবীন্দ্রনাথকে নেওয়া হয়েছিল, যা দিয়ে প্রমাণ করা যায়, বাঙালি মুসলমানের জীবনে রবীন্দ্রনাথের কোনো প্রভাব নেই, সেইটুকু নজরুলকে নেওয়া হয়েছিল, যা দিয়ে প্রমাণ করা যায়, নজরুলের মতো সাচ্চা মুসলমান আর কেউ নেই। অন্যদিকে আরেক দল মানুষ ছিল, যারা নজরুলের মানবতাবাদ এবং অসাম্প্রদায়িকতার প্রতি ছিল সমালোচনামুখর। খণ্ড খণ্ড নজরুল ব্যবহৃত হয়েছিল খণ্ড খণ্ড গোষ্ঠীর মধ্যে।

সাম্প্রদায়িকতার বিষ রবীন্দ্র-নজরুল ঘিরে কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তার একটি উদাহরণ তো নোবেল পুরস্কার। ঘটা করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথের চেয়ে নজরুল বড় লেখক বলে নজরুলই অবধারিতভাবে নোবেল পুরস্কার পেতেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ষড়যন্ত্র করে নজরুলকে একজন হিন্দুর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে অথবা বিষ খাইয়ে মানসিক প্রতিবন্ধী বানিয়ে নিজের পথ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। এই ষড়যন্ত্রকারীদের কারও মনেই প্রশ্ন জাগেনি, ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন নোবেল পুরস্কার পান, তখন নজরুল ১৪ বছরের কিশোরমাত্র। যাঁরা এসব মেনে নিয়েছেন, তাঁরা কোনো যুক্তির কাছে যাননি। অন্ধবিশ্বাসে তা গ্রহণ করেছেন।

আরও একটা বিষয়ে নজরুলকে দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে ছোট করার চেষ্টা হয়েছিল। মুক্তক ছন্দের প্রবর্তক হিসেবে নজরুলকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ যে নজরুলের কাছ থেকে মুক্তক ছন্দ নিয়েছিলেন, তা স্বীকার করা হয় না বলে আক্ষেপ ছিল। অথচ এটাও ছিল তাঁদেরই কীর্তি, যাঁদের উত্তরপুরুষেরা এই একবিংশ শতাব্দীতেও মানবাধিকারবিরোধী ষড়যন্ত্রের অন্যতম হোতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে চাঁদে দেখেছেন বলে দাবি করেন। ‘বিদ্রোহী’ মুক্তক ছন্দে লেখা কবিতা বটে, কিন্তু তা ছাপা হয়েছিল ১৯২২ সালে। রবীন্দ্রনাথের বলাকা কাব্যগ্রন্থ ছাপা হয়েছিল ১৯১৬ সালে, সেই কাব্যগ্রন্থেই তো আমরা বিদ্রোহী রচিত হওয়ার বহু আগে মুক্তক ছন্দের দেখা পাই।

তাহলে রবীন্দ্রনাথ কী করে নজরুলের কাছ থেকে এই ছন্দ আত্মসাৎ করেন?

আসলে এভাবেই সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

আজ আমাদের জাতীয় কবির মৃত্যুদিনে কেন এ প্রসঙ্গটি তুলে আনতে হলো? এর কারণ, আবারও আমরা ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার মধ্যে পড়েছি। আবারও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে অন্ধবিশ্বাস। এ রকম সংকটকালে নজরুল হয়ে উঠতে পারেন অসাম্প্রদায়িকতার প্রতিভূ। তাঁর রচনা দিতে পারে দিকনির্দেশনা।


লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পাকিস্তানে কীভাবে হামলা চালাতে পারে ভারত, ইতিহাস যা বলছে

জনবল-সরঞ্জাম বেশি হলেও সমরশক্তিতে ভারত কি পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে

প্রবাসীর রেমিট্যান্সের অর্থ আত্মসাৎ, নারী ব্যাংক কর্মকর্তা কারাগারে

ইতিহাস গড়ে পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদে আইএসআইপ্রধান

ভারতের সঙ্গে সংঘাতে পাকিস্তানের ভাগ্যনিয়ন্তা সেনাপ্রধান জেনারেল মুনির

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত