Ajker Patrika

বিসিএস উত্তীর্ণ সবার নিয়োগ হোক

শরিফুল হাসান
বিসিএস উত্তীর্ণ সবার নিয়োগ হোক

৪৩তম বিসিএসে আবেদন করেছিলেন ৪ লাখ ৩৫ হাজার ১৯০ জন প্রার্থী। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো এই বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করতে পারেনি সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। খুব শিগগিরই চূড়ান্ত ফল প্রকাশ হবে—এমন কথা বলা হচ্ছে। তবে এই বিসিএসে প্রথমবারের ক্যাডার পদের সঙ্গেই নন-ক্যাডার পদেরও ফলাফল প্রকাশ করা হবে—এমন তথ্যে আন্দোলনে নেমেছেন প্রার্থীরা। এমনটা হলে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ অধিকাংশ প্রার্থীকে শূন্য হাতে ফিরতে হবে বলে আশঙ্কা তাঁদের।

১ হাজার ৮১৪ জন ক্যাডার কর্মকর্তা নেওয়ার জন্য ২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর ৪৩তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল পিএসসি।২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়। উত্তীর্ণ হন ১৫ হাজার ২২৯ জন। ২০২২ সালের জুলাইয়ে লিখিত পরীক্ষা হয়। এই ফল প্রকাশ করতে এক বছরের বেশি সময় নেয় পিএসসি। চলতি বছরের ২০ আগস্ট লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলে উত্তীর্ণ হন ৯ হাজার ৮৪১ জন। মৌখিক পরীক্ষা শেষে তাঁরা এখন চূড়ান্ত ফলের অপেক্ষায়।

এর মধ্যেই ১৪ ডিসেম্বর ৪৩তম বিসিএসে নন-ক্যাডারের ১ হাজার ৩৪২টি শূন্য পদের কথা জানিয়ে মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়া আগ্রহী প্রার্থীদের আবেদন করতে বলেছে পিএসসি। এই বিজ্ঞপ্তিকে প্রহসনমূলক আখ্যা দিয়ে সংবাদ সম্মেলন, পিএসসির সামনে মানববন্ধন, কাফনের কাপড় পরিধান থেকে শুরু করে নানা কর্মসূচি পালন করছেন প্রার্থীরা। তাঁরা বলছেন, এই বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সময় বলা হয়নি যে ক্যাডার ও নন-ক্যাডারের ফল একসঙ্গে হবে; বরং ৩২ অনুচ্ছেদে আগের বিসিএসের মতোই নন-ক্যাডারে নিয়োগের কথা বলা হয়েছিল।

প্রার্থীদের অভিযোগ, আগের বিসিএসগুলোতে বিপুলসংখ্যক প্রার্থী নন-ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন। সবশেষ ৪১তম বিসিএস থেকে ৪ হাজার ৫৩ এবং ৪০তম বিসিএস থেকে ৪ হাজার ৪৭৮ জনকে নন-ক্যাডারে নিয়োগের জন্য পছন্দের তালিকা দেওয়া হয়েছিল। অথচ ৪৩তম বিসিএস থেকে নন-ক্যাডারে মাত্র ১ হাজার ৩৪২ পদের কথা বলা হচ্ছে। এর মধ্যে সাধারণ প্রার্থীদের জন্য নবম ও দশম গ্রেডের পদ আছে মাত্র ৭৫টি। বাকিগুলো বিশেষায়িত পদ। ফলে অধিকাংশই চাকরি পাবেন না।

তাঁরা বলছেন, ১ হাজার ৩৪২ পদের মধ্যে ৮৮৮টি পদই ৪১তম থেকে ফেরত আসা। যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় সেগুলো খালি ছিল। সেই হিসাবে নতুন পদ এসেছে মাত্র ৪৫৪টি। আর এবার নন-ক্যাডারে নবম শ্রেণির পদ মাত্র ১৯৬টি। এটি প্রহসন ও বৈষম্যমূলক।

আন্দোলনরতরা চারটি দাবি তুলে ধরেছেন। এগুলো হলো—ক্যাডার ও নন-ক্যাডার ফল পৃথক সময়ে প্রকাশ করা, নন-ক্যাডার থেকে অধিকসংখ্যক প্রার্থীকে সুপারিশ করা, আগের বিসিএস থেকে ইতিমধ্যে সুপারিশ করা প্রার্থীদের সমপদে ফের সুপারিশ না করা এবং ক্যাডার ও নন-ক্যাডার নিয়োগে প্যানেলের ব্যবস্থা করা।

মূলত ক্যাডার পদে নিয়োগের জন্যই বিসিএস পরীক্ষা নেওয়া হয়। বিসিএস থেকে নন-ক্যাডারে নিয়োগের বিষয়টা বুঝতে হলে ১৩ বছর আগে ফিরতে হবে। তখন একটা বিসিএসে দুই থেকে আড়াই লাখ প্রার্থী আবেদন করতেন এবং ছয় থেকে সাত হাজার প্রার্থী চূড়ান্ত উত্তীর্ণ হতেন। কিন্তু পদস্বল্পতার কারণে বেশির ভাগই চাকরিবঞ্চিত হতেন। এই প্রার্থীদের প্রথম শ্রেণির অন্যান্য শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্যই ২০১০ সালে নন-ক্যাডার নিয়োগে বিশেষ বিধিমালা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

নন-ক্যাডারের এই নিয়োগ বিধিমালা করার কারণ হিসেবে ওই সময়ের চেয়ারম্যান প্রয়াত সা’দত হুসাইন বলেছিলেন, একেকটি বিসিএসে ৮ থেকে ১০ হাজার প্রার্থী উত্তীর্ণ হলেও বেশির ভাগ চাকরি পান না। অন্যদিকে রাষ্ট্রের অনেক পদ শূন্য। বিসিএস উত্তীর্ণদের মধ্য থেকেই যদি প্রথম শ্রেণির বিভিন্ন পদে সুপারিশ করা যায়, তাহলে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর মেধাবী কর্মকর্তা পাবে। বিসিএস থেকে নিয়োগ দিলে নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতিও কমবে। ২০১৪ সালে বিধিমালা সংশোধন করে প্রথম শ্রেণির সঙ্গে দ্বিতীয় শ্রেণির পদেও বিসিএস থেকে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয় পিএসসি।

পিএসসি ও চাকরিপ্রার্থীদের নিয়ে দীর্ঘ দুই দশকের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতায় বলতেই হবে, বিসিএস উত্তীর্ণদের থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা (বর্তমানে ৯ম থেকে ১২ গ্রেড) নিয়োগের জন্য নন-ক্যাডার নিয়োগ বিধিমালার উদ্যোগটি দারুণ ছিল। বিধিমালা অনুযায়ী, প্রতিটি বিসিএসে চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর প্রার্থীদের কাছ থেকে নন-ক্যাডারে আবেদন নেওয়া হতো। পরের বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের আগপর্যন্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে যত চাহিদা আসত, সেই অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়া হতো। এভাবেই নন-ক্যাডারে বিপুলসংখ্যক ছেলেমেয়ে চাকরি পেয়েছেন।

তবে ২০২২ সালে পিএসসির বর্তমান কমিশন জানায়, এখন থেকে প্রতিটা বিসিএসে ক্যাডারের পাশাপাশি নন-ক্যাডারের পদ উল্লেখ করতে হবে। একটা বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগে যত চাহিদা আসবে ওই বিসিএসে ঠিক ততগুলো নন-ক্যাডারের পদই থাকবে।

৪০তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর দেখা গেল পিএসসি ৪০, ৪১, ৪৩ ও ৪৪ বিসিএসের বিজ্ঞপ্তির তারিখ অনুযায়ী শূন্য পদ আলাদা করার জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, যেহেতু ৪০তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর দেওয়া হয়েছে, কাজেই ওই তারিখের মধ্যে যেই পদের চাহিদা শুধু সেই পদই ৪০তম বিসিএসের নন-ক্যাডারের জন্য থাকার কথা।

৪০তম বিসিএস উত্তীর্ণ প্রার্থীরা তখন এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন শুরু করেন। তাঁদের বক্তব্য, পিএসসির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে ৪০, ৪১, ৪৩ ও ৪৪তম নন-ক্যাডার প্রার্থীদের ওপর বিপর্যয় নেমে আসবে। তবে আন্দোলনের মধ্যেই পিএসসি নন-ক্যাডার নিয়োগবিধিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। ফলে ৪০তম বিসিএসের নন-ক্যাডারের নিয়োগ আটকে ছিল প্রায় এক বছর। অবশেষে ২০২৩ সালের জুন মাসে নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ (বিশেষ) বিধিমালা সংশোধন করে গেজেট প্রকাশ করা হয়।

নতুন বিধিমালার ৪ ধারা অনুযায়ী, এখন থেকে বিসিএসের বিজ্ঞপ্তিতে ক্যাডার পদের পাশাপাশি নন-ক্যাডার পদের সংখ্যাও উল্লেখ থাকবে। তবে বিধিমালা প্রকাশের আগে যেসব সংখ্যা উল্লেখ ছিল না, সে ক্ষেত্রে বিসিএস অনুযায়ী নন-ক্যাডার পদের সংখ্যা নির্ধারণ ও পছন্দ আহ্বান করা হবে।

এই বিধিমালা অনুযায়ী কিন্তু বিসিএসের বিজ্ঞপ্তির সঙ্গেই নন-ক্যাডারের বিজ্ঞপ্তি যাওয়ার কথা। অথচ গত ৩০ নভেম্বর ৪৬তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলেও নন-ক্যাডারের সংখ্যা বলা হয়নি। এর দায় কার?

পিএসসি বলছে, বিধিমালা অনুযায়ী, ৪৩তম বিসিএসে নন-ক্যাডারের ১ হাজার ৩৪২ পদে আবেদন চাওয়া হয়েছে। ৪৩তম বিসিএসের কয়েক শ প্রার্থীর দাবি, তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। কারণ, প্রতিটি বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর পিএসসি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে শূন্য পদের চাহিদা চেয়ে চিঠি ও পরে তাগাদা দিত। পাশাপাশি প্রার্থীরাও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে গিয়ে খোঁজখবর করতেন এবং চাহিদা পাঠানোর অনুরোধ করতেন। ফলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর থেকে অনেক চাহিদা যেত। এখন ক্যাডারের সঙ্গেই নন-ক্যাডারের ফল প্রকাশ করা হলে নতুন চাহিদা আসবে না। ফলে অধিকাংশই চাকরি পাবেন না।

এখানে দীর্ঘসূত্রতাও আরেকটি সমস্যা। এখন একেকটা বিসিএস শেষ করতে তিন থেকে চার বছর লেগে যাচ্ছে। সেই হিসাবে ২০২৪ সালে যদি সরকারের কোনো দপ্তর নন-ক্যাডার পদে চাহিদা পাঠায় এবং তিন-চার বছর পর ওই দপ্তর কর্মকর্তা পায়, তাহলে ভবিষ্যতে নন-ক্যাডারে নিয়োগের আগ্রহ হারাবে, যার প্রভাব পড়বে ভবিষ্যতে।

একটা বিষয় স্বীকার করতেই হবে। বিসিএস থেকে নন-ক্যাডারের নিয়োগের ফলে অনেক অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ হয়েছে। যোগ্য ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন দপ্তরে যাচ্ছেন। কাজেই ৯ম থেকে ১২তম গ্রেড পর্যন্ত যত বেশিসংখ্যক পদ বিসিএস থেকে নিয়োগ দেওয়া যায়, ততই রাষ্ট্রের মঙ্গল। এখানে আইন বা বিধিমালা বেশি প্রার্থীর চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হওয়া উচিত নয়; বরং বেশি নিয়োগ দেওয়ার জন্য পিএসসির চেষ্টা করা উচিত। প্রতিটি বিসিএসের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। প্রয়োজনে বিসিএস উত্তীর্ণ সবাইকে চাকরি দেওয়া হোক।

এ বছরের জানুয়ারিতে সংসদে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এখনো সরকারের ৩ লাখ ৫৮ হাজার ১২৫টি পদ খালি। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণির শূন্য পদ ৪৩ হাজার ৩৩৬টি। দ্বিতীয় শ্রেণিতে খালি আছে ৪০ হাজার ৫৬১টি পদ। কাজেই প্রতি বিসিএসে উত্তীর্ণ বিপুলসংখ্যক প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব। এ ক্ষেত্রে পিএসসিকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে তাদের চাহিদা পাঠানো ও তাগাদা দিতে হবে। অতীতে পিএসসির চেয়ারম্যানরা কিন্তু সেটি করেছেন। পিএসসির প্রতি এক যুগে যে আস্থা তৈরি হয়েছে, সেটি ধরে রাখতে হবে।

আরেকটা কথা। যেহেতু ক্যাডার পদের জন্যই বিসিএস পরীক্ষা নেওয়া হয়, কাজেই ক্যাডারের সঙ্গে নন-ক্যাডারের ফল না দেওয়াই ভালো; বরং ক্যাডার পদের ফল প্রকাশের পর নন-ক্যাডারের আবেদন চাইলে প্রার্থীদের সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ। আর কয়েক মাস সময় পেলে নতুন করে চাহিদা আনার জন্যও চেষ্টা করতে পারেন প্রার্থীরা। পিএসসিও এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে।

পাশাপাশি নন-ক্যাডার নিয়োগে বেশিসংখ্যক প্রার্থীর চাকরি নিশ্চিত করতে সমপদে সুপারিশ করা বন্ধ করতে পারে পিএসসি। প্যানেলের ব্যবস্থাটাও ভালো। প্যানেল করে নিয়োগ দিলে পদ আর শূন্য থাকবে না। আসলে চার বছরের অপেক্ষার পর কেউ যেন শূন্য হাতে না ফেরেন।

আরেকটা বিষয়। বিসিএসের নিয়োগের দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে আনা খুব জরুরি। একটা বিসিএসের ফল প্রকাশ ও নিয়োগে এখন চার বছর লেগে যাচ্ছে। চার বছরে পৃথিবীর বহু দেশে এক সরকার ক্ষমতা শেষ করে আরেক মেয়াদ আসে। চার বছরে পৃথিবীর বহু দেশ তো বটেই, এমনকি বাংলাদেশেও যেকোনো বিষয়ে স্নাতক শেষ করা যায়। কিন্তু চার বছরেও একটা বিসিএসের নিয়োগ-প্রক্রিয়া শেষ হয় না বাংলাদেশে! ফলে একটা চাকরির আশায় তারুণ্যের চার-পাঁচ বছর সময় চলে যাচ্ছে জীবন থেকে। নিয়োগে স্বচ্ছতার পাশাপাশি বিসিএসের এই দীর্ঘসূত্রতা কমাতেই হবে।

লেখক: কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ইসরায়েলে ২০ লাখ রুশভাষীর বাস, রাশিয়াকে তাঁদের কথা ভাবতে হয়: পুতিন

ইরানের পতন হলে, এরপরই রাশিয়া—অভিমত রুশ বিশ্লেষকদের

হরমুজ প্রণালিতে প্রবেশ করে ইউটার্ন নিল দুটি জাহাজ

লাইভ-২ (২৩ জুন, ২০২৫) ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কাঁপল ইসরায়েল, তেহরানে ভয়াবহ বিস্ফোরণ

চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি থেকে বিদায় নিচ্ছে সাইফ পাওয়ারটেক

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত