Ajker Patrika

মোহাম্মদ ফরহাদ বাম রাজনীতির উজ্জ্বল নক্ষত্র

আহমেদ শমসের
আপডেট : ১১ অক্টোবর ২০২২, ২০: ৩৩
মোহাম্মদ ফরহাদ বাম রাজনীতির উজ্জ্বল নক্ষত্র

৯ অক্টোবর বাংলাদেশের রাজনীতির এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ ফরহাদের ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮৭ সালে মস্কোতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

গত শতকের ষাটের দশক থেকে শুরু করে আশির দশকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। জীবিতকালে যিনি দেশের রাজনীতিতে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছিলেন, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের নেতায় পরিণত হয়েছিলেন, মৃত্যুর পর সাড়ে তিন দশক সময়ের মধ্যেই তিনি রাজনীতিকদের কাছেও যেন এক অপরিচিত নাম।

তিনি ছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক। কমিউনিস্ট হয়েও একজন জাতীয় নেতা হয়ে উঠেছিলেন তিনি। গত শতকের ষাটের দশকে পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলনের ‘মস্তিষ্ক’ বলে পরিচিত মোহাম্মদ ফরহাদ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যেমন সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশে সমাজ প্রগতি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামেও পালন করেছেন অগ্রসৈনিকের ভূমিকা।

বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম রূপকার মোহাম্মদ ফরহাদ হুলিয়া মাথায় নিয়ে আত্মগোপনে থাকতে বাধ্য হন। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরেই কেবল তিনি আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে আসেন। কমিউনিস্ট পার্টিও বৈধ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পাকিস্তান আমলে মোহাম্মদ ফরহাদ ছিলেন নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম সংগঠক এবং সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে তিনি দলটির সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু এ পদে দায়িত্ব পালন করেন।

মোহাম্মদ ফরহাদ ছিলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনে দুই প্রজন্মের– চল্লিশ দশকের পথিকৃৎ কমিউনিস্ট বিপ্লবী মণি সিংহ, বারীণ দত্ত, খোকা রায়, অনিল মুখার্জি ও জ্ঞান চক্রবর্তীদের প্রজন্ম এবং সত্তর ও আশির দশকের তরুণ কমিউনিস্ট প্রজন্মের মধ্যে সেতুবন্ধস্বরূপ। দুই প্রজন্মের মধ্যেই তিনি ছিলেন সমানভাবে সমাদৃত। এ দেশে একটি শোষণ-বঞ্চনা-ভেদবৈষম্যহীন সাম্যের সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন দেখতেন তিনি।

১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি পঞ্চগড়-২, অর্থাৎ বোদা-দেবীগঞ্জ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। খুব বেশি সময় না পেলেও তৃতীয় জাতীয় সংসদে ব্যতিক্রমী ভূমিকা, যুক্তিপূর্ণ ও বুদ্ধিদীপ্ত বাগ্মিতার কারণে একজন প্রতিশ্রুতিশীল পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবেও তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছিলেন।

জাতীয় রাজনীতি, ছাত্র, শ্রমিক, নারী আন্দোলন, যুব, ক্ষেতমজুর, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নানা কর্মকাণ্ড এবং সুশীল সমাজের তৎপরতার পেছনেও ছিল মোহাম্মদ ফরহাদের অবদান। ঐক্যবদ্ধ জাতীয় ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার আন্দোলনে এবং সংগঠন গড়ে তোলার পেছনেও তিনি অনুঘটকের নেপথ্য ভূমিকা পালন করেছেন। অনেকের কাছেই তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই পথপ্রদর্শক। তাঁর অকাল প্রয়াণ সত্যি সত্যি বাংলাদেশের বাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যে শূন্যতার সৃষ্টি করে, তা আজও পূরণ হয়নি।

তিনি রাজনৈতিক বিষয়ে লেখালেখি করেছেন প্রচুর। দেশের প্রথম সারির রাজনীতিবিদেরা সাধারণত লেখালেখি করেন না। মোহাম্মদ ফরহাদ ছিলেন ব্যতিক্রম। পার্টির মুখপত্র, তাত্ত্বিক পত্রিকা ও কোনো কোনো সময় জাতীয় দৈনিকেও তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে প্রচুর প্রবন্ধ লিখেছেন। মোহাম্মদ ফরহাদ ষাটের দশকে কিছু সময়ের জন্য দৈনিক সংবাদের সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কমিউনিস্ট পার্টির সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘একতা’র সম্পাদকীয় বোর্ডের সদস্য ছিলেন আমৃত্যু।

তাত্ত্বিকভাবে তিনি খুব পরিচিত ছিলেন না হয়তো, কিন্তু রাজনৈতিক কৌশলে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। এরশাদের আমলে নির্বাচনের আগে আন্দোলনের অংশ হিসেবে শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে ১৫০ : ১৫০ আসনে লড়ার প্রস্তাব দিয়ে এরশাদের ঘুম হারাম করে দিয়েছিলেন। এরশাদ তড়িঘড়ি করে সংবিধান সংশোধন করে একজন প্রার্থী ৫টির বেশি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পারার বিধান সংযুক্ত করেন। কমিউনিস্ট হয়েও তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের আস্থাভাজন হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাও তাঁর মতামত বিবেচনায় নিতেন ভরসার সঙ্গেই। তাঁর সব রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই হয়তো নির্ভুল ছিল না, সেটা কখনো হয়ও না। জিয়াউর রহমানের হ্যাঁ-না ভোট এবং খাল কাটা কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার পক্ষে অবস্থান নিলেও জিয়া কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হাতে হাতকড়া পরাতে ভুল করেননি।

মোহাম্মদ ফরহাদের হাতকড়া পরা একটি ছবি একসময় মানুষের মনে সাড়া ফেলেছিল।

মোহাম্মদ ফরহাদের মৃত্যু বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে নিঃস্ব করেছে। তাঁর চলে যাওয়ার পর কমিউনিস্ট পার্টি আজ উত্থানরহিত। গণতান্ত্রিক শক্তিও পথহারা। ধর্মান্ধতা রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নিতে উঠেপড়ে লেগেছে। প্রতিক্রিয়ার শক্তিরা উল্লসিত। এ অবস্থায় মোহাম্মদ ফরহাদের কথা বেশি করে মনে পড়ে। তিনি যদি আরও কিছু সময় পেতেন, তাহলে হয়তো দেশের রাজনীতি এতটা আদর্শহীনতার পথে ধাবিত হতো না।

ব্যক্তির ভূমিকা গৌণ করে দেখাই রীতি। কোনো একক ব্যক্তি নয়, সম্মিলিত ও ঐক্যবদ্ধ মানুষের শক্তিই ইতিহাসের স্রষ্টা। কিন্তু সত্যিই কি ইতিহাস নির্মাণে ব্যক্তির কোনো ভূমিকা নেই? বিশেষ কোনো ব্যক্তির উপস্থিতি কিংবা অনুপস্থিতি কি ইতিহাসের গতিধারার অদলবদল ঘটায় না? ঐক্যবদ্ধ মানুষের সম্মিলন ঘটাতেও কি ব্যক্তিবিশেষের ভূমিকা প্রভাব বিস্তার করে না? যে যা-ই বলুন, যেভাবেই বলুন, মোহাম্মদ ফরহাদের ব্যক্তিগত ভূমিকা বাংলাদেশের বাম-প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক রাজনীতির এক নির্ভরযোগ্য ও নিয়ামক শক্তি ছিল।

মোহাম্মদ ফরহাদের মতো আত্মত্যাগী নেতাদের কথা আমাদের যত বেশি মনে পড়বে, ততই দেশের রাজনীতির জন্য মঙ্গল। মৃত্যুদিবসে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।

লেখক:  সাংবাদিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পাকিস্তানে কীভাবে হামলা চালাতে পারে ভারত, ইতিহাস যা বলছে

জনবল-সরঞ্জাম বেশি হলেও সমরশক্তিতে ভারত কি পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে

প্রবাসীর রেমিট্যান্সের অর্থ আত্মসাৎ, নারী ব্যাংক কর্মকর্তা কারাগারে

ইতিহাস গড়ে পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদে আইএসআইপ্রধান

ভারতের সঙ্গে সংঘাতে পাকিস্তানের ভাগ্যনিয়ন্তা সেনাপ্রধান জেনারেল মুনির

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত