Ajker Patrika

বাংলাদেশ না হলে হয়তো সার্কই হতো না

সাহিদুল ইসলাম চৌধুরীর
আপডেট : ১২ জুন ২০২২, ১৪: ১৩
বাংলাদেশ না হলে হয়তো সার্কই হতো না

প্রশ্ন: দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে পুরোনো আঞ্চলিক জোট। এই অঞ্চলের রাজনৈতিক আবহ বিবেচনায় সার্কের কী কোনো ভবিষ্যৎ আছে? 
মহাসচিব: সার্ক একটি আন্তরাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া, যেখানে আমরা সদস্যদেশ-গুলোর পক্ষে কাজ করে থাকি। এই প্রক্রিয়ায় সার্ক সচিবালয় নিজে আসলে খুব বেশি কিছু করতে পারে না। কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে দেশগুলো যেভাবে চায়, সচিবালয়কে সেভাবেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হয়। মহাসচিব হিসেবে আমি নিজের মতো করে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। এ কারণে সার্কের বিভিন্ন বিষয়ে কী প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে, সে ব্যাপারে নির্দেশনা পেতে মহাসচিব হিসেবে আমাকে সার্ক দেশগুলোর শীর্ষ নেতা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিবদের কাছে বিভিন্ন রাজধানীতে যেতে হয়। এর অংশ হিসেবেই আমার ঢাকায় আসা। তবে ঠিক কবে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন হবে, এ প্রশ্ন করলে আমার কাছে কোনো জবাব নেই।

প্রশ্ন: সার্কের আওতায় ৪টি বিশেষায়িত সংস্থা ও ৫টি আঞ্চলিক কেন্দ্র আছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সাধারণ মানুষ কি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে লাভবান হয়ে থাকে? 
মহাসচিব: সার্কের মোট ৯টি প্রতিষ্ঠানের দুটি বাংলাদেশে আছে–সার্ক কৃষিকেন্দ্র (সার্ক এগ্রিকালচারাল সেন্টার) ও দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক মান সংস্থা (সারসো)। ৯টি প্রতিষ্ঠানই যার যার ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে গবেষণা হয়ে থাকে। গবেষণাপত্র, বিভিন্ন ধরনের জার্নালসহ তাদের আন্তর্জাতিক মানের প্রকাশনা আছে। কিছু প্রতিষ্ঠানে পিএইচডি করার সুযোগ আছে সার্ক দেশগুলোর তরুণ বিজ্ঞানী ও গবেষকদের জন্য।

সদস্যদেশগুলো থেকে আমরা যে বার্তা পাচ্ছি, তাতে করোনায় স্বাস্থ্য খাতে সংকটের পর সবাই এখন অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। শ্রীলঙ্কাসহ কিছু সদস্যদেশ গভীর সমস্যায় আছে। সার্ক ফুড ব্যাংক, সার্ক কৃষিকেন্দ্র ও সার্ক বীজ ব্যাংক থেকেও তারা সহায়তা নিতে পারে। এভাবে সার্কের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মানুষের উপকারে আসে, ভবিষ্যতেও আসবে। 
প্রশ্ন: এসব সংস্থার সেবার মান বাড়াতে কি কোনো সংস্কার দরকার বলে আপনার মনে হয়? 
মহাসচিব: ৯টি সার্ক সংস্থার সবগুলোর বৈশিষ্ট্য আলাদা। এ কারণে প্রতিটি সংস্থা যার যার নিজস্ব পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়। তাদের পরিচালনা পর্ষদও আলাদা। পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারপারসন সার্ক দেশগুলো থেকে দুই বছর পরপর পর্যায়ক্রমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরিবর্তিত হন। তাঁরা প্রয়োজন মনে করলে উদ্যোগ নিতেই পারেন। সার্ক সচিবালয়ের এসব ক্ষেত্রে করার কিছু নেই।

প্রশ্ন: ইউক্রেন যুদ্ধ ও অন্যান্য অঞ্চলে সরবরাহ সমস্যার জন্য অনেক দেশে খাদ্যাভাব দেখা দিতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। আসন্ন সংকটে সদস্যদেশগুলোর কি প্রয়োজনে সার্ক খাদ্যভান্ডার (সার্ক ফুড ব্যাংক) থেকে নাগরিকদের জন্য খাবার নেওয়ার সুযোগ আছে?
মহাসচিব: নিশ্চয়ই। সার্ক ফুড ব্যাংক এরই মধ্যে চালু হয়েছে। করোনার সময় ২০২০ সালে ফুড ব্যাংক ব্যবস্থার আওতায় ভারত থেকে ২ হাজার টন চাল নিয়েছে ভুটান। 

প্রশ্ন: সার্ক ফুড ব্যাংকের বর্তমান মজুত কত? কোন দেশে কী পরিমাণ খাদ্য মজুত আছে?
মহাসচিব: ফুড ব্যাংক ব্যবস্থার আওতায় প্রতিটি সদস্যদেশ নিজের প্রতিশ্রুত খাদ্য নিজ নিজ দেশে সংরক্ষণ করে থাকে। প্রতিটি সদস্যদেশে এ জন্য একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা থাকেন। তাঁর মাধ্যমে কোনো সদস্যদেশ খাদ্য চাইলে সচিবালয় অন্য দেশের ফুড ব্যাংক থেকে সরবরাহের ব্যবস্থা করে থাকে।

বর্তমানে ৮ সদস্যদেশে সার্ক ফুড ব্যাংকের আওতায় মোট ৪ লাখ ৮৬ হাজার টন খাদ্য মজুত আছে। এর মধ্যে আফগানিস্তানে ২ হাজার ৮৪০ টন, বাংলাদেশে ৮০ হাজার টন, ভুটানে ৩৬০ টন, ভারতে ৩ লাখ ৬ হাজার ৪০০ টন, মালদ্বীপে ৪০০ টন, নেপালে ৮ হাজার টন, পাকিস্তানে ৮০ হাজার টন এবং শ্রীলঙ্কায় ৮ হাজার টন খাদ্য মজুত আছে।  

প্রশ্ন: এই অঞ্চলের খামারিদের জন্য সার্কের একটি বীজভান্ডার (সিড ব্যাংক) গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ১২ বছর আগে। কী অবস্থা এই বীজভান্ডারের? 
মহাসচিব: সার্ক সিড ব্যাংক এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চালু আছে। আজকাল দেশে দেশে লবণাক্ততা ও খরা ইত্যাদি বড় রকমের সমস্যা হয়ে দেখা দিচ্ছে। সিড ব্যাংকের আওতায় লবণাক্ততা ও খরাসহিষ্ণু জাতসহ উচ্চ ফলনশীল বিভিন্ন ধরনের ফসলের বীজ সদস্যদেশগুলো অন্য দেশ থেকে সংগ্রহ করতে পারে। যেমন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত ধানের বীজ ভারত নিয়েছে। ভারত ব্রি-৬৯, ব্রি-৭৫, বিনা ধান–৮, ১০, ১১, ১২ ও ১৭ জাতের বীজ নিয়েছে। 

প্রশ্ন: সিড ব্যাংকের বর্তমান মজুত কত? 
মহাসচিব: ফুড ব্যাংকে খাদ্য মজুত রাখা হয়। কিন্তু সিড ব্যাংক উদ্ভাবনভিত্তিক। যেমন কোনো কিছুর জিন সিড ব্যাংকের আওতায় আসতে পারে। ধরুন কোনো দেশে ভালো জাতের মহিষ আছে। কিংবা কোনো দেশে আছে কালো ছাগল (ব্ল্যাক গোট)। কোনো সদস্যদেশ চাইলে অন্য দেশ থেকে এগুলো সংগ্রহ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে দেশগুলোকে বীজের একটি নির্দিষ্ট মান বজায় রাখার ওপর জোর দিতে হয়। 

প্রশ্ন: সার্কে আফগানিস্তানের তালেবানের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে সদস্যদেশগুলোর কয়েকটির মতভেদে সার্ক বর্তমানে অচলাবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অর্থসংকটে বিশেষায়িত সংস্থা এবং ৫টি আঞ্চলিক কেন্দ্রের নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনাও সম্ভব হচ্ছে না। এই অচলাবস্থা কি তাড়াতাড়ি কাটিয়ে ওঠার কোনো সম্ভাবনা আছে?
মহাসচিব: আফগানিস্তান সার্কের সদস্য। অন্য সদস্যদেশের তরফে আফগানিস্তান সরকারের সঙ্গে কাজ করার ব্যাপারটি ফয়সালা হলেই ঝামেলা মিটে যাবে। এ ক্ষেত্রে সদস্যদেশগুলোর নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ আছে। আমরা এ ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতির জন্য অপেক্ষায় আছি। 

প্রশ্ন: সার্কের শীর্ষ সম্মেলন ২০১৬ সাল থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রয়েছে। মহাসচিব হিসেবে আপনি কি সদস্যদেশগুলোর কাছ থেকে সহসা শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠানের জন্য কোনো রকম ইঙ্গিত পাচ্ছেন? কখন হতে পারে শীর্ষ সম্মেলন? 
মহাসচিব: শীর্ষ সম্মেলনের কোনো সুনির্দিষ্ট তারিখ এখনো নেই। তবে এ ক্ষেত্রে সামান্য অগ্রগতি আছে। সার্কের পরবর্তী শীর্ষ সম্মেলন পাকিস্তানে হওয়ার কথা। পাকিস্তান এ সম্মেলন করতে চায়। 

প্রশ্ন: ইন-পারসন (শীর্ষ নেতাদের সশরীরে উপস্থিতিতে)? 
মহাসচিব: তারা (পাকিস্তান) প্রয়োজনে হাইব্রিড (সশরীরে ও ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মের সমন্বিত) ব্যবস্থায় সম্মেলন করার কথা ভাবছে। যার পক্ষে সম্ভব সশরীরে যেতে পারবেন। অন্যরা চাইলে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে যোগ দিতে পারবেন। সার্ক নেতারা এর আগেও করোনার মধ্যে ভার্চুয়াল সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। জাতিসংঘের অনেক বৈঠকও হাইব্রিড ও ভার্চুয়াল ব্যবস্থায় হচ্ছে। তবে শীর্ষ সম্মেলন হাইব্রিড ব্যবস্থায় করার বিষয়টি একটি অনানুষ্ঠানিক প্রস্তাব। বিষয়টি একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। কিছুই চূড়ান্ত হয়নি। এখনো কোনো তারিখও সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। 

প্রশ্ন: আপনার এবারের সফরের সময় বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন বৈঠকে আপনাকে সার্ক চাঙা করার জন্য সদস্যদেশগুলোর সঙ্গে আলাপ করার কথা বলা হয়েছে। 
মহাসচিব: সশরীরে সফরের সুযোগগুলো আমি নিই। কারণ, সবকিছু সব সময় ভার্চুয়াল বৈঠকে বলা হয়ে ওঠে না। আর সার্কের মতো আন্তসরকার সংস্থায় মূলত সদস্যদেশগুলোর নেতারাই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। নেতারা যা বলেন, তা আমাকে বিবেচনায় নিতেই হয়। আর এ ক্ষেত্রে আমার ভূমিকা অনেকটা বার্তাবাহকের মতো। দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ একটি বড় সুযোগও বটে। কোনো নেতা আস্থা রেখে যা বলেন, তা আমাকে অবিকল বহন করতে হয় অন্য নেতাদের কাছে। এগুলো প্রকাশ্যে বলার সুযোগ আমার নেই। 

প্রশ্ন: প্রশ্ন করা হয়নি, এমন কোনো বিষয়ে আপনি কি কিছু যোগ করবেন? 
মহাসচিব: বাংলাদেশ সফরে এটা বলাই যায়, বাংলাদেশ না হলে হয়তো সার্কই হতো না। বাংলাদেশ সব সময়ই সার্ক ব্যবস্থায় অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) চান, সার্ক প্রক্রিয়া যেন চালু থাকে। এটাই তাঁর বার্তা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত