Ajker Patrika

নীতি সহযোগিতা পেলেই হবে সমৃদ্ধ

শাইখ সিরাজ
নীতি সহযোগিতা পেলেই হবে সমৃদ্ধ

গত নভেম্বরের মাঝামাঝির দিকে ঢাকায় শীত তেমন অনুভূত না হলেও চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ভোরবেলায় শীতের আগমনী প্রকোপ বেশ টের পাওয়া যাচ্ছিল। চারদিক কুয়াশাচ্ছন্ন। কুয়াশা ছাপিয়ে পশ্চিম আকাশে লাল আভা ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা চলছিলাম নাহার অ্যাগ্রোর পোলট্রির প্যারেন্টস স্টক খামার দেখতে। নাহার অ্যাগ্রো লিমিটেডের কর্ণধার রকিবুর রহমান টুটুল। বাংলাদেশে যাঁরা আধুনিক কৃষি খামার গড়েছেন, তিনি তাঁদের একজন। পোলট্রি ও গবাদিপ্রাণীর আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন খামার গড়ে তুলেছেন। কৃষিকে তিনি নিয়ে গেছেন শিল্পের কাতারে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই সময়ে বিশ্বব্যাপী কৃষি উৎপাদনে তথ্যপ্রযুক্তির কার্যকর ও দক্ষতাপূর্ণ ব্যবহারের তৎপরতা চলছে। কৃষিতে শ্রম কমানো ও উৎপাদনব্যবস্থাকে গাণিতিক হিসাবের মধ্যে আনতে তথ্যপ্রযুক্তি রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে প্রাণিসম্পদ খাতে। ইন্টারনেটের সঙ্গে কম্পিউটার কিংবা মোবাইল যুক্ত করে এই খাতের কার্যক্রম পরিচালনায় এসেছে দারুণ সাফল্য। গত কয়েক বছরে দুগ্ধ খামার তথা প্রাণিসম্পদে ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) ব্যবহার নিয়ে কয়েকটি প্রতিবেদন আমি প্রচার করেছি। ২০১৬ সালে নেদারল্যান্ডসের ওয়েগিনিংগেন ইউনিভার্সিটির প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের গবেষণা খামারগুলোতে দেখেছি প্রযুক্তি তথা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির নানামুখী ব্যবহার। এরপর ২০১৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলের চুংনামে একটি ডেইরি খামারে স্মার্ট প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে একটি প্রতিবেদনের কথা আপনাদের হয়তো মনে থাকতে পারে। সেখানকার সবকিছু প্রচলিত খামারের মতোই।

বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, খামার পরিচালনায় মানুষ নেই বললেই চলে। কিম নামের একজন খামারি ছোট্ট একটি কন্ট্রোল রুম থেকে নিয়ন্ত্রণ করেন পুরো খামার। আর বাংলাদেশে দুগ্ধ খামারে ইন্টারনেট অব থিংসের ব্যবহার প্রথম দেখলাম নারায়ণগঞ্জের কাঞ্চন এলাকায় মাসকো ডেইরি লিমিটেডে। পরে দেখেছি সূর্যমুখী প্রাণিসেবা নামের একটি প্রতিষ্ঠানে আইওটির সফল ব্যবহার। বছরখানেক আগে, গত বছর জানুয়ারিতে মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ে স্থাপিত ডাচ ডেইরিতেও দেখেছি আইওটির ব্যবহার। দেশে বৃহৎ খামার পর্যায়ে আইওটির সফল ব্যবহারের নজির গড়েছে চট্টগ্রামের নাহার ডেইরি। গত বছর জোরারগঞ্জে টুটুলের গবেষণা খামার দেখেছি। বিশাল এলাকা নিয়ে সেখানে চলছে দেশি গরুর জাত উন্নয়নের কাজ।

মিরসরাইয়ে পোলট্রি প্যারেন্টস স্টক খামারে পৌঁছে যাই অল্প সময়েই। টুটুল আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। বায়োসিকিউরিটি বা জৈবনিরাপত্তা বিষয়ে টুটুল বেশ সচেতন। রীতিমতো গোসল করে কাপড় পাল্টে ঢুকতে হলো তাঁর খামারে। পোলট্রি খামারে জৈবনিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। উন্নত বিশ্বের অনেক খামারেই আমি দেখেছি জৈবনিরাপত্তা ইস্যুতে তারা বেশ সচেতন। মনে পড়ছে চীনের শ্যাংডন প্রদেশে নিউ হোপে কোম্পানির হ্যাচারিতে আমাদের প্রবেশের আগে গোসল করে কাপড় পাল্টে ঢুকতে হয়েছিল।

এরপর চললাম খামার ঘুরে দেখতে। চলতে চলতে কথা হচ্ছিল টুটুলের সঙ্গে। টুটুলের মুখেই শুনলাম তাঁর শুরুর গল্প। ‘১৯৮৬ সালে তখন স্কুলে পড়ি। ছোট থেকেই আমার কৃষির প্রতি ঝোঁক। আপনার মাটি ও মানুষের কোনো পর্বই মিস করতাম না। মুরগির খামার গড়ে কিংবা ডেইরি খামারের প্রতিবেদনগুলো বেশ নাড়া দিত আমাকে। স্কুলে পড়তে পড়তেই ৩০০ মুরগি দিয়ে শুরু করলাম ছোট্ট খামার।

৩০০ মুরগি কিনে খামার দিলাম। বাঁশ কিনে খাঁচা তৈরি করলাম। আমি তো তখনো স্কুলের ছাত্র! মা-ই দেখাশোনা করতেন। মায়ের নামে খামারের নাম রাখলাম। এরপর দুটি গরু কিনে শুরু করলাম ডেইরি খামার। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলা।

আমাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। আমি সারা জীবন ভেবেছি আমার হারানোর কিছু নেই। ৩০০ মুরগি কেনার টাকাটা থাকলেই হলো। এই ভেবে যেকোনো বড় সিদ্ধান্ত নিতে ভয় করিনি কখনো।’ কী এক দারুণ প্রত্যয়ের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন টুটুল।

টুটুলের কথাই ঠিক, উদ্যোক্তা হতে হলে রিস্ক নিতে হবে। লাভ আর ক্ষতির কিনারায় দাঁড়িয়ে যে ঠিক সিদ্ধান্তটি নিয়ে শ্রম আর অধ্যবসায়ে এগিয়ে যেতে পারে, সে-ই সফল হয়। টুটুলের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। ৩৮ বছরের পথচলায় কৃষিভিত্তিক সুবিশাল কার্যক্রম গড়ে তুলেছেন তিনি। এখন চার হাজার কর্মী কাজ করছেন তাঁর বিভিন্ন কৃষিভিত্তিক খামার ও শিল্পকারখানায়। আর্থিক সাফল্যও বিস্ময়কর। বছরে হাজার-বারো শ কোটি টাকার টার্নওভার।

টুটুল বেশ পরিকল্পিতভাবেই গড়ে তুলেছেন তাঁর খামার ব্যবস্থাপনা। খামারের উৎপাদনব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি। টুটুল আমাদের বলছিলেন কীভাবে মুরগিকে খাবার দেওয়া হয়, যত্ন নেওয়া হয়...এসব বিষয়ের খুঁটিনাটি। প্রাণিসম্পদ খামার ব্যবস্থাপনা এখন ধীরে ধীরে শিল্পের আকার নিচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তিতে বড় পরিসরে পরিচালিত হচ্ছে এমন সব খামার।

পাঠক, আপনাদের মনে থাকতে পারে গাজীপুরের কাপাসিয়ায় অবস্থিত মুরগির ডিম উৎপাদনের আধুনিক একটি খামার তুলে ধরেছিলাম আপনাদের সামনে। যেকোনো বড় আয়োজনের রয়েছে বহুমুখী প্রতিবন্ধকতা। জনবহুল দেশ বলে সুরক্ষিত জায়গা পাওয়া যেমন কঠিন, তেমন কঠিন দক্ষ জনবল খুঁজে নেওয়া। আরও একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হলো প্রাণীর মানসম্পন্ন ওষুধপত্র পাওয়া। এই সংকটগুলো অতিক্রম করাই মূল চ্যালেঞ্জ বলছিলেন উদ্যোক্তা রকিবুর রহমান টুটুল।

বর্তমানে নাহার অ্যাগ্রোর বিভিন্ন খামারে ব্রয়লার এবং লেয়ার পোলট্রি প্যারেন্টস স্টক মুরগি রয়েছে ১২ লাখ। এসব প্যারেন্টস স্টক মুরগির ডিম থেকে বিভিন্ন হ্যাচারিতে প্রতি সপ্তাহে ২২ থেকে ২৪ লাখ বাচ্চা উৎপাদন হয়। প্রায় ২৫ হাজারের মতো খামারি এই হ্যাচারি থেকে উপকার ভোগ করছেন। কাজগুলো সম্পন্ন করতে হয় ধাপে ধাপে। প্রথম ধাপে ১৮ দিন রাখা হয় ইনকিউবেটরে। এর পরের ধাপে চলে ক্যান্ডেলিং। অনুর্বর ডিম ফেলে দিয়ে উর্বর ডিমগুলোকে রাখা হয় হ্যাচিং মেশিনে। এভাবেই ধাপে ধাপে ডিম থেকে জন্ম হয় নতুন বাচ্চার। নতুন সম্ভাবনার।

আমাদের দেশে প্রাণিজ আমিষ চাহিদার প্রায় ৪৫ শতাংশ পোলট্রি খাতনির্ভর। দিন দিন বাড়ছে এই খাতে বিনিয়োগ। অনেক খামারেই জৈবনিরাপত্তা নিশ্চিত করে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে চলছে উৎপাদনব্যবস্থা। নিজেদের পুষ্টি নিরাপত্তার পাশাপাশি আমরা এখন বিশ্ববাজারে হালাল মাংস রপ্তানির কথা ভাবতে পারি। টুটুলের মতো উদ্যোক্তাদের হাত ধরে বিকশিত হয়েছে আমাদের দেশের প্রাণিসম্পদ খাত। আমার বিশ্বাস, সরকারের নীতি সহযোগিতা পেলে তাঁদের হাতেই উন্মোচিত হবে রপ্তানি বাণিজ্যের নতুন ধারা।

লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিক্ষোভ থেকে সহিংসতায় উত্তাল ভাঙ্গা, মসজিদে আশ্রয় নিয়েছেন পুলিশ সদস্যরা

দাওয়াত না দেওয়ায় মাদ্রাসার সব খাবার খেয়ে গেলেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা

উত্তাল ভাঙ্গা: থানাসহ চারটি সরকারি দপ্তরে হামলা-ভাঙচুর, পুলিশসহ আহত অনেকে

সন্তানের গলা কেটে লাশ বাবার হাতে তুলে দিলেন মা

কক্সবাজার, মাদারীপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ডিসি প্রত্যাহার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত