Ajker Patrika

ইতিহাসের ঘরবাড়ি

সুমন্ত গুপ্ত 
আপডেট : ০৮ ডিসেম্বর ২০২১, ১৪: ০০
ইতিহাসের ঘরবাড়ি

বেলা সাড়ে ১১টা। দাঁড়িয়ে আছি এক শিহরণজাগানো জাদুঘরের সামনে। বিজয়ের মাসে জাদুঘরটি নিয়ে যাবে এক অন্যরকম ঐতিহাসিক অধ্যায়ে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পুলিশের প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধে বাহিনীটির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের স্মারক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে অবস্থিত এই জাদুঘর।

ছবি তোলা নিষেধ বলে মন খারাপ হলেও ভাবলাম, ছবি না তুলতে পারি, ইতিহাসটুকু তো জানতে পারব। সামনে দাঁড়াতেই খুলে গেল জাদুঘরের কাচের তৈরি স্বয়ংক্রিয় দরজাটি। ভেতরে ঢুকে প্রথমে বঙ্গবন্ধু গ্যালারি। বাঁ দিক থেকে শুরু হয়েছে প্রদর্শনী। আলোকচিত্র ও পোস্টারে দেওয়া তথ্যে এক লহমায় জানা যায় জাতির জনকের বিভিন্ন তথ্য।

বঙ্গবন্ধু গ্যালারির ঠিক মাঝখানে রয়েছে নিচে নামার সিঁড়ি। মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রদর্শনীর জন্য সিঁড়ি ভেঙে যেতে হয় ভূগর্ভে। আমরা চলেছি এগিয়ে। অডিও ভিজ্যুয়াল কক্ষে ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং ১৯৭৫ সালে পুলিশ সপ্তাহে দেওয়া জাতির জনকের বক্তৃতা দেখানো হয়। অল্প সময়ের, কিন্তু তথ্যবহুল অডিও ভিজ্যুয়াল দেখলাম আমরা। এখানে প্রদর্শনীর শুরুতে রয়েছে একটি চিঠির বাক্স। ১৮৬৩ সালে তৈরি চিঠি ও দলিল বিতরণের এই বাক্স পুলিশ ঐতিহ্যের অংশ। ১৯৭১ সালেও ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ব্যবহৃত হয়েছে এটি। এরপরই শুরু হয়েছে পুলিশের বিবর্তনের ইতিহাস।

ছবি ও লেখায় তুলে ধরা হয়েছে সুলতানি আমল, মোগল আমল, ব্রিটিশ আমল হয়ে আধুনিক পুলিশের ইতিবৃত্ত। একের পর এক ইতিহাসের সাক্ষী হতে হতে গৌরবে মনটা ভরে যাচ্ছে। এদিকে বেজে চলেছে দেশের গান। এর মধ্যেই চোখ আটকে যায় কাচঘেরা শেলফে রাখা একটি দশমিক ৩৮ বোরের রিভলবারের দিকে। অস্ত্রটি ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী কন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের। ব্রিটিশ পুলিশের হাত হয়ে এটি এখন বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। একদম সামনেই দেশভাগ নিয়ে ‘দ্য স্টেটমেন্ট’ ও ‘যুগান্তর’ পত্রিকার দুটি খবরের কাটিং জানান দিল পাকিস্তান সৃষ্টির। এরপর পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও আন্দোলন-সংগ্রামে পুলিশের ভূমিকার আলোকচিত্র রয়েছে সেখানে।

জাদুঘরের প্রতিটি স্মারক, আলোকচিত্র ও পোস্টারই আলাদা করে দাঁড়িয়ে দেখার মতো। প্রতিটি স্মারকই আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ। যেগুলোর তথ্য ও তাৎপর্য যে কাউকেই ভাবিয়ে তুলবে। সময়ের পরিক্রমায় চোখের সামনে ভেসে উঠবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটনাপ্রবাহ। জাদুঘরের পাশে আছে পুলিশ স্মৃতিসৌধ। এটি মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহিদদের স্মরণে তৈরি করা হয়েছে।

বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ভেতরের অংশমহান মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রহ পাগলা ঘণ্টা
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর পুলিশ লাইনস আক্রমণের মুহূর্তে এই পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে পুলিশ সদস্যদের একত্র করে প্রতিরোধের আহ্বান জানানো হয়। তথ্যে বলা হয়েছে, পাগলা ঘণ্টার আওয়াজ শুনে রাজারবাগের পুলিশ সদস্যরা সালামি গার্ডের পাশে জড়ো হন এবং অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে প্রতিরোধ গড়তে অবস্থান নেন। পাগলা ঘণ্টা বাজানোর কাজটি করেছিলেন পুলিশ সদস্য আবদুল আলী।

বেতারযন্ত্র
রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের খবর পাঠানো হয় এই বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে হেলিকপ্টার ব্যাজ মডেলের একটি বেতারযন্ত্র থেকে এই বার্তা পাঠান সেই সময়ের বেতার অপারেটর মো. শাহজাহান মিয়া।

স্মৃতির বেঞ্চ
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আহত দুই পুলিশ সদস্যকে নেওয়া হয় মতিঝিল টিঅ্যান্ডটি কলোনির হাসপাতালে। সেই মুহূর্তে হাসপাতালে কোনো শয্যা ছিল না। তাঁদের দুজনকে এ দুটি বেঞ্চের ওপর রেখেই চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হয়ে অজ্ঞাত ওই দুই পুলিশ সদস্য সেখানেই শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।

বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। ২০১৩ সালে এটি স্থাপিত হয়থ্রি নট থ্রি রাইফেল
সেই কালরাতে পুলিশ সদস্যদের হাতে ছিল থ্রি নট থ্রি রাইফেল। পাকিস্তানি বাহিনীর আধুনিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে এই অস্ত্র দিয়েই লড়েছিলেন বাঙালি পুলিশ সদস্যরা।

বীরদের স্মারক
মুক্তিযুদ্ধের সময় পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত রাইফেল, বন্দুক, মর্টার শেল, হাতব্যাগ, টুপি, চশমা, মানিব্যাগ, অণুবীক্ষণ যন্ত্র, সার্চলাইট, ট্রাংক ও ইউনিফর্ম রাখা হয়েছে স্মারক হিসেবে। আরও আছে বীর মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ সদস্যদের যুদ্ধের সময়ের ডায়েরি, হাতে লেখা বিভিন্ন বার্তা, আলোকচিত্র ও পোস্টার। এর মধ্যেই পাওয়া যাবে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পুলিশ কর্মকর্তাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র। সেসব স্মারকের তালিকায় রয়েছে তৎকালীন পিরোজপুর মহকুমার সাব-ডিভিশনাল পুলিশ কর্মকর্তা শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদের ব্যবহৃত রেডিও ও ডায়েরি। শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদ কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ও লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের বাবা।

প্রয়োজনীয় তথ্য
মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর মাসে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা এবং অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত জাদুঘরটি খোলা থাকে। বুধবার সাপ্তাহিক বন্ধ। শুক্রবার বেলা ৩টা থেকে ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে জাদুঘরটি। প্রবেশমূল্য ১০ টাকা। তবে ডিসেম্বরে শিক্ষার্থীদের জন্য এবং সব জাতীয় দিবসে সবার জন্য বিনা মূল্যে এই জাদুঘর দেখার ব্যবস্থা রয়েছে।

লেখক: ব্যাংকার

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বন্ধুর সঙ্গে স্ত্রীর গোপন সম্পর্ক, ধর্ষণের অভিযোগ স্বামীর

তালগাছ কেটে শতাধিক বাবুইছানা হত্যা: প্রধান আসামি মোবারেক গ্রেপ্তার

বিমানবন্দরে ব্যাগের মধ্যে গুলির ম্যাগাজিন, যে ব্যাখ্যা দিলেন উপদেষ্টা আসিফ

এনবিআর আন্দোলনের ৬ নেতার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামছে দুদক

শাটডাউন কর্মসূচি করুক, বৈঠক হবে না: অর্থ উপদেষ্টা

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত