Ajker Patrika

হাট বসিয়ে মিয়ানমারের চোরাই গরু বেচাকেনা

শাহরিয়ার হাসান ও বাপ্পী শাহরিয়ার, চকরিয়া (কক্সবাজার) থেকে
হাট বসিয়ে মিয়ানমারের চোরাই গরু বেচাকেনা

প্রায় এক বছর ধরে বন্ধ রয়েছে মিয়ানমার থেকে পশু আমদানির করিডর। কিন্তু বন্ধ হয়নি দেশটি থেকে পশু আসা। সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন শত শত গরু-মহিষ বাংলাদেশে পাচার করছে আন্তর্জাতিক চোরাকারবারি চক্র। চোরাই পথে আসা এসব পশু বিক্রিও হচ্ছে প্রকাশ্যে, রীতিমতো হাট বসিয়ে। 

চোরাই পশু বেচাকেনার এই হাট বসে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ছড়ারকুলে। আর অবৈধ এই হাট থেকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে এসব পশু। হাটে পশু নিয়ে আসা চোরাকারবারি সিন্ডিকেটগুলো এতই শক্তিশালী যে তাদের নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না। বাধা দেয় না স্থানীয় প্রশাসনও। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চকরিয়ার এই অবৈধ গরুর হাটটি চালান ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মী ও জনপ্রতিনিধিরা। প্রশাসনের সঙ্গে যোগসাজশে পরিচালনা করা এই হাটে গরুর ক্রেতারা সাধারণ মানুষ হলেও বিক্রেতারা চোরাকারবারি।

হাটটি যাঁরা দেখভাল করেন, তাঁদের একজন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু মুছা। 

গতকাল হাটের বিষয়ে মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে তিনি প্রশ্ন শুনে বলেন, ‘ব্যস্ত আছি।’ এরপরই ফোন কেটে দেন। 
তবে অবৈধ পশুর হাটটির আরেকজন অংশীদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই হাটের কথা সবাই জানেন। উপজেলা থেকে কেউ কখনো বাধা দেয় না। এখানে মিয়ানমারের গরু-মহিষ প্রকাশ্যে বিক্রি হয়।

চোরাই গরুর হাটের বিষয়ে জানতে চাইলে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বেশ কয়েক মাস ধরে এখানে অবৈধ একটি হাট বসছে। সেখানে মিয়ানমার-থাইল্যান্ড থেকে পাচার হওয়া গরু আসছে। এ নিয়ে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মিটিংয়েও আলোচনা হয়েছে। আমরা সম্মিলিত একটি অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করছি।’

অবৈধ হাটে গরু আসে কীভাবে 
কক্সবাজার জেলার রামু, বান্দরবানের আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার পূর্ব-দক্ষিণে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য। তিন উপজেলায় মিয়ানমারের সঙ্গে অন্তত ২০০ কিলোমিটার সীমান্ত। এই সীমানা এলাকায় বড় কোনো নদী না থাকার সুযোগে পাহাড়ি পথে গরু-মহিষ নিয়ে আসছে চোরাকারবারিরা। ইতিমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই পথকে আন্তর্জাতিক পশু চোরাচালান রুট হিসেবে শনাক্ত করেছে। সীমান্তের এপারে স্থানীয়রা থাকলেও ওপারে পশু সিন্ডিকেটটির সঙ্গে সরাসরি আরাকান আর্মি ও আরসার সদস্যরা জড়িত বলে তথ্য মিলেছে বলে জানিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।

এ বিষয়ে বান্দরবানে আলীকদম ৫৭ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, গরুসহ চোরাচালান শুধু এলাকার ভারসাম্য নয়, দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করছে। বিজিবি চেকপোস্ট বসিয়ে কারবারিদের ধরার চেষ্টা করছে।

বিজিবির তথ্য বলছে, দেশে প্রবেশের মুখে আলীকদম এলাকা থেকেই গত ৬ মাসে অনন্ত ১ হাজার ২৩টি গরু ও মহিষ আটক করা হয়। অবৈধ গরু আটকের বিষয়ে ২৯টি মামলাও করা হয়। গ্রেপ্তার হয় ২৭ জন চোরাকারবারি। যদিও স্থানীয়রা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে সবগুলো চালান আটক করা সম্ভব হয় না। ১০টি চালানের ৯টিই হাত ফসকে চলে যায় এবং চলে আসে অবৈধ পশুর হাটে।
মিয়ানমারের সঙ্গে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ১১ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধীন সীমান্ত ৭১ কিলোমিটার এবং জোনের অধীনে সীমান্ত ৯৪ কিলোমিটার। সীমান্ত পিলার ৫৫ থেকে আলীকদম ৬৮ নম্বর পোয়ামুহুরী পর্যন্ত এলাকায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন (অরক্ষিত) রয়েছে। ফলে নাইক্ষ্যংছড়ির আশারতলী, ফুলতলী, লেমুছড়ি, চাকঢালা, ঘুমধুম সীমান্ত, অন্যদিকে আলীকদমের করুকপাতা ও পোয়ামুহুরীর বিভিন্ন ঝিরি দিয়ে অবাধে মিয়ানমার থেকে আসছে গরু-মহিষ। এসব পশু লামার ইয়াংছা শামুক ছড়া, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের মিরিঞ্জা এবং কক্সবাজারের রামু ও চকরিয়া দিয়ে পাচার করা হয়। 

অবৈধ হাটটি সম্পর্কে যা জানা গেল
ফাঁসিয়াখালীর ছড়ারকুলে প্রায় দেড় একর জমির ওপর ঢাকার এক ব্যক্তির রাবার ফ্যাক্টরি ছিল। সেটি ২০১৫ সালের দিকে বন্ধ করা হয়। দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকার পর ২০২২ সালের নভেম্বরে থেকে সেখানে পশুর হাট বসান স্থানীয়রা। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে প্রবেশ করা গরু-মহিষ ট্রাক ও চান্দের গাড়িভর্তি হয়ে ঢুকছে এ হাটে। প্রতিটি গরু-মহিষ হাটে প্রবেশ করানোর সময় ৫০০ এবং বিক্রির পর দিতে হচ্ছে ৮০০ টাকা। এ হাটে প্রতিদিন ৩৫০-৪০০ গরু-মহিষ কেনাবেচা হয়। 

ওই হাটে গিয়ে কথা হয় চট্টগ্রাম থেকে গরু কিনতে আসা দুই ব্যবসায়ী মালেক ও হাফিজুরের সঙ্গে। আজকের পত্রিকাকে এই দুই ব্যবসায়ী জানান, এই বাজার থেকে গত তিন মাসে ছয় শর অধিক গরু ও মহিষ কিনেছেন তাঁরা। এখানে গরু অন্য বাজার থেকে তুলনামূলক সস্তা।

চোরাই গরু বেচাকেনার বিষয়ে চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) চন্দন কুমার চক্রবর্তী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা মাঝেমধ্যে চোরাই গরুর বিষয়ে অভিযানে বের হই। কোনো অবৈধ পশু পেলে জব্দ করি। চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে মামলা দেই। তবে যাদের গরুর কাগজপত্র আছে, তাদের ছেড়ে দেই।’ 

অসহায় খামারি, ক্ষতিগ্রস্ত সরকার ও ব্যবসায়ী
দেশের বাইরে থেকে আমদানি করলে বাজারে দেশীয় পশুর (গরু, মহিষ, ছাগল) দাম কমে যাবে, এই যুক্তি দেখিয়ে গত বছর ঈদুল আজহার আগে কক্সবাজারের শাহপরীর দ্বীপের করিডর দিয়ে মিয়ানমার থেকে পশু আমদানি বন্ধ করে দেয় সরকার। এখন পর্যন্ত সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়নি। তাতে লাভও হয়নি খামারিদের।

চকরিয়ার খামারি বেলাল উদ্দিন বলেন, ‘সে তো একই হলো! মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে অবৈধভাবে গরু আসার কারণে বিপদে পড়তে হয়েছে আমাদের।’ 

শাহপরীর দ্বীপ করিডর পশু আমদানিকারক সমিতির সভাপতি আবদুল্লাহ মুনির বলেন, ২০০৩ সাল থেকে এ করিডর চালু ছিল। করিডর দিয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয়ও হচ্ছিল। সেটা বন্ধ হলো, কিন্ত চোরাই পথে গরু আসার বন্ধ হলো না। এতে সরকারও রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। খামারিরাও লোকসান গুনছে। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি বাসভবনে একাই থাকতেন শরীয়তপুরের ডিসি, পরিবার থাকত ঢাকায়

‘তোরা তো পুলিশ মারছিস, ফাঁড়ি জ্বালাইছিস’ বলেই জুলাই যোদ্ধাকে মারধর

কারাগারে ১০৫ মন্ত্রী-এমপি

বুশেহরে হামলা হলে মধ্যপ্রাচ্যে ‘ফুকুশিমা’ ঘটতে পারে, বিশ্লেষকদের হুঁশিয়ারি

ইউআইইউ শিক্ষার্থীদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত ও পুলিশ কর্মকর্তা প্রত্যাহার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত