Ajker Patrika

প্রাণঘাতী যত ঘূর্ণিঝড়

আপডেট : ১৩ মে ২০২৩, ১৫: ৩৯
প্রাণঘাতী যত ঘূর্ণিঝড়

ঘূর্ণিঝড় প্রলয়ংকরী দুর্যোগ। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই দুর্যোগ বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হেনে যাচ্ছে। প্রায় প্রতিবারই জানমালের ক্ষতিসাধন করছে; কখনো তার ব্যপ্তি ব্যাপক, কখনো খুব কম। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে ঘূর্ণিঝড় বন্ধ বা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু এর ছোবল থেকে জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানো যায়।  

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে নানা সময়ে, বিপুল ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা। বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশের দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ঝড়ে প্রাণক্ষয় কমেছে। কিন্তু তার আগে ১৯৭০ সালে ভোলার উপকূলে আঘাত হানা পৃথিবীর সবচেয়ে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়সহ কয়েক শতকে বহু ঘূর্ণিঝড়ে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানিসহ অপরিসীম ক্ষতি হয়েছে।

অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা যখন কক্সবাজার উপকূলের দিকে প্রায় ১৭৫ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসছে, সেই সময়ে চলুন দেখে নিই কয়েক শতকে এই বঙ্গভূমিতে আঘাত হানা প্রলয়ংকরী ঝড়গুলোতে প্রাণহানির চিত্র। অতি আদিকালের সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও মুঘল যুগ থেকে ঝড়গুলোতে প্রাণহানির কিছু কিছু চিত্র পাওয়া যায়।

  • ১৫৫৮ সালে সম্রাট আকবরের রাজত্বের ঊষালগ্নে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে এক ভয়ংকর ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হয়। পাঁচ ঘণ্টার ঘূর্ণিঝড়ে দুই লাখের বেশি মানুষের সলিলসমাধি ঘটে।
  • ১৫৮৪ সালে ঘূর্ণিঝড়ে বাকেরগঞ্জে (বরিশাল অঞ্চল) প্রাণহানি ২ লাখে পৌঁছায়। তখন জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৪ লাখ। মুঘল সুবাদার ছিলেন শাহবাজ খান (১৫৮৪-১৫৮৭)।
  • ১৭৬৭ সালে বরিশালের বাকেরগঞ্জে ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারায় ৩০ হাজার মানুষ।
  • ১৮২২ সালের জুন মাসে ঘূর্ণিঝড়ে বরিশাল, হাতিয়া ও নোয়াখালীতে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের প্রাণ যায়।
  • ১৮৩১ সালে বালেশ্বর-উড়িষ্যা উপকূল ঘেঁষে চলে যাওয়া তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে বরিশাল উপকূলের ২২ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
  • ১৮৭৬ সালের ২৯ অক্টোবর বরিশালের বাকেরগঞ্জে মেঘনা নদীর মোহনার কাছ দিয়ে তীব্র ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। এর গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২০ কিলোমিটার। ঝড়ের প্রভাবে ১২ মিটারের বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয় উপকূলীয় এলাকা। চট্টগ্রাম, বরিশাল ও নোয়াখালীর উপকূলে তাণ্ডব চালিয়ে যাওয়া ওই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ২ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।
  • ১৮৯৭ সালের ২৪ অক্টোবর চট্টগ্রাম অঞ্চলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড়, যাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কুতুবদিয়া দ্বীপ। ঝড়ে প্রাণ যায় পৌনে ২ লাখ মানুষের।
  • ১৯০৯ সালের ১৬ অক্টোবর খুলনা অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ে মৃত্যু হয় ৬৯৮ জনের।
  • ১৯৪৮ সালে ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারায় চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলে ১ হাজার ২০০ অধিবাসী।
  • ১৯৫৮ সালে বরিশাল ও নোয়াখালীতে ঝড়ে মারা যায় ৮৭০ জন।
  • ১৯৬০ সালের অক্টোবরে ঘণ্টায় ২১০ কিলোমিটার গতির বাতাস নিয়ে প্রবল ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বাকেরগঞ্জ, ফরিদপুর, পটুয়াখালী ও পূর্ব মেঘনা মোহনায়। ঝড়ের প্রভাবে ৪.৫ থেকে ৬.১ মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়। মারা পড়ে উপকূলের প্রায় ১০ হাজার বাসিন্দা।
  • ১৯৬১ সালের ৯ মে তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে বাগেরহাট ও খুলনা অঞ্চলে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬১ কিলোমিটার। প্রায় সাড়ে ১১ হাজার মানুষ মারা যায় সেই ঝড়ে।
  • ১৯৬২ সালে ২৬ অক্টোবর ফেনীতে তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে হাজারখানেক মানুষের মৃত্যু হয়।
  • ১৯৬৩ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত হয় চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজার এবং সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া, হাতিয়া ও মহেশখালী উপকূলীয় অঞ্চল। সেই ঝড়ে প্রাণ হারায় ১১ হাজার ৫২০ জন।
  • ১৯৬৫ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ে বারিশাল ও বাকেরগঞ্জে প্রাণ যায় ১৯ হাজার ২৭৯ জনের। সে বছরের ডিসেম্বরে আরেক ঝড়ে কক্সবাজারে মৃত্যু হয় ৮৭৩ জনের।
  • ১৯৬৬ সালের অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে সন্দ্বীপ, বাকেরগঞ্জ, খুলনা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কুমিল্লায়; ৮৫০ জনের মৃত্যু হয় সেই ঝড়ে।
  • ১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যায় প্রলয়ংকরী ‘গ্রেট ভোলা সাইক্লোন’। ওই ঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২২২ কিলোমিটার। চট্টগ্রাম, বরগুনা, খেপুপাড়া, পটুয়াখালী, ভোলার চর বোরহানুদ্দিনের উত্তর পাশ ও চর তজুমুদ্দিন এবং নোয়াখালীর মাইজদি ও হরিণঘাটার দক্ষিণ পাশ সেই ঘূর্ণিঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রাণ হারায় প্রায় সাড়ে ৫ লাখ মানুষ। ৪ লাখের মতো বসতভিটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
  • ১৯৮৫ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ে লন্ডভন্ড হয় সন্দ্বীপ, হাতিয়া ও উড়িরচর এলাকা; সেই ঝড়ে প্রাণ হারায় উপকূলের ১১ হাজার ৬৯ জন বাসিন্দা।
  • ১৯৮৮ সালের নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় লন্ডভন্ড করে দিয়ে যায় যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর এবং বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলের উপকূলীয় এলাকা। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬২ কিলোমিটার। সেই ঘূর্ণিঝড়ে ৫ হাজার ৭০৮ জনের মৃত্যু হয়।
  • ১৯৯১ সালের ৩০ এপ্রিল বয়ে যায় আরেক প্রলয়ংকরী ঝড়। ভারত মহাসাগরে উৎপত্তি ছিল সেই ঝড়ের, পরে তা ঘণ্টায় ২২৫ কিলোমিটার গতির ঘূর্ণিবায়ু নিয়ে আছড়ে পড়ে চট্টগ্রাম ও বরিশালের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে। প্রায় দেড় লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটে ওই ঝড়ে।
  • ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে বিধ্বস্ত হয় দেশের দক্ষিণ উপকূল। উত্তর ভারত মহাসাগরের আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাছে সৃষ্ট এ ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৬০ থেকে ৩০৫ কিলোমিটার। এতে ৩ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়।
  • ২০০৯ সালের ২১ মে ভারত মহাসাগরে সৃষ্টি হয় ঘূর্ণিঝড় আইলা, যার অবস্থান ছিল কলকাতা থেকে ৯৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে। চার দিনের মাথায় ২৫ মে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাংশে আঘাত হানে এই ঝড়। সেই ঘূর্ণিঝড় ভারতের ১৪৯ জন ও বাংলাদেশের ১৯৩ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়।
  • ২০১৩ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’-এ প্রাণ হারায় ১৭ জন।
  • ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই ঘূর্ণিঝড় কোমেনে দেশের চার জেলায় অন্তত চারজন মারা যায়। ঘণ্টায় ৬০ থেকে ৭০ কিলোমিটার বেগের ঝোড়ো হাওয়া নিয়ে সন্দ্বীপের কাছ দিয়ে চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম করে সেই ঝড়।
  • ২০১৬ সালের ২১ মে পূর্ণিমায় ভরা জোয়ারে আঘাত হানে রোয়ানু। সেই ঝড়ে লাখখানেক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, চট্টগ্রামে মৃত্যু হয় ২৪ জনের।
  • ২০১৯ সালের ৩ মে ঘূর্ণিঝড় ফণী ভারতের ওড়িশা উপকূলে আঘাত হানার পর বাংলাদেশে প্রবেশ করে, কেড়ে নেয় অন্তত ৯ জনের প্রাণ। তবে ফসলের ক্ষতি ছিল অনেক বেশি।
  • একই বছরের ৯ নভেম্বর অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে আঘাত হানার পর প্রবেশ করে বাংলাদেশে। সেই ঝড়ে মৃত্যু হয় অন্তত আটজনের, ক্ষতি হয়েছে সুন্দরবনেরও৷
  • ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে আঘাত হানে সুপার সাইক্লোন ‘আম্ফান’। ২১ মে এটি অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় রূপে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে আঘাত হানে। পরে রাতে এই ঝড় প্রবেশ করে বাংলাদেশে; আট জেলায় মারা যায় অন্তত ১৫ জন।
  • ২০২২ সালের ২৪ অক্টোবর মাঝারি শক্তির ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ আঘাত হানে উপকূলে। ঘণ্টায় ৯০ কিলোমিটারের বেশি গতিবেগের এই ঝড়ে বিভিন্ন স্থানে গাছ ও দেয়ালচাপায় অন্তত সাতজনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে ফসলেরও ক্ষতি হয়।

আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

‘ভারতে ঢুকে’ পাকিস্তানি সেনাদের গুলি, সীমান্তে সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে

এনবিআর চেয়ারম্যানের কক্ষের সামনে কর্মকর্তাদের অবস্থান

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত