Ajker Patrika

আসলে তিনি কী? 

প্রতিনিধি, দীঘিনালা (খাগড়াছড়ি)
আপডেট : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২: ০৯
আসলে তিনি কী? 

একাধারে তিনি চিকিৎসক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ আবার করেন কুরিয়ারের ব্যবসাও। ভিজিটিং কার্ড, প্রেসক্রিপশন, ব্যানারে কখনো নিজেকে পরিচয় দিচ্ছেন চিকিৎসক, কখনো ডেন্টিস্ট্রি আবার কখনো দন্ত চিকিৎসা প্রযুক্তিবিদ। 

খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় পাহাড়ি অঞ্চলে মদিনা ডেন্টাল কেয়ারের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে এভাবেই দাঁতের চিকিৎসার নামে প্রতারণা করে আসছেন মোহাম্মদ সেলিম নামের এই ভুয়া চিকিৎসক। নিজেকে দন্ত চিকিৎসক দাবি করলেও নেই কোন বিডিএস ডিগ্রি। চুক্তিভিত্তিক টাকা নিয়ে স্থানীয়দের অপচিকিৎসা দিয়ে আসছেন দিনের পর দিন। অভিযোগের অন্ত নেই এই ভুয়া চিকিৎসকের বিরুদ্ধে। বোয়ালখালী নতুন বাজারে একটি চেম্বার ও খাগড়াছড়ি জেলা সদরের নারিকেল বাগান এলাকায় আরেকটি চেম্বারে তিনি ভুয়া চিকিৎসা দিচ্ছেন। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাঁর কাছে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থতার চেয়ে জটিলতায় পড়েছেন বেশি মানুষ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মেরুং ইউপির বাসিন্দা (আজকের পত্রিকার কাছে অভিযোগের রেকর্ড রয়েছে) অভিযোগ করে বলেন, ২০১৯ সালে তিনি চাকরিতে যোগদানের আগে দুটি দাঁতের চিকিৎসা করাতে যান। পরে মোহাম্মদ সেলিম ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে দুই দাঁতের চিকিৎসা করে দিয়ে বলেন, আজীবনে কোন সমস্যা হবে না। তবে বছর পার হতেই ভোগান্তিতে পড়েন অভিযোগকারী। তিনি বলেন, বছর পার হতেই দাঁত দিয়ে রক্ত পড়া শুরু হয়, বাড়তে থাকে যন্ত্রণা। পরে ফের চিকিৎসার জন্য সেলিম ওই ভুক্তভোগীর কাছ থেকে ৩ হাজার টাকা দাবি করেন। তবে তাতেও মুক্তি মেলেনি ভুক্তভোগীর। আজকের পত্রিকার কাছে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এসব ভুয়া চিকিৎসকের আইনের আওতায় আনতে হবে। 

দীঘিনালায় চেম্বার দিয়ে চিকিৎসা দিচ্ছেন অভিযুক্ত মোহাম্মদ সেলিমউপজেলার আরেক বাসিন্দা ইমরান (২৩) বলেন, মোহাম্মদ সেলিম একাই এক্স-রের কাজ করেন, চিকিৎসা সেবা দেন। তাঁর চেম্বারে নেই কোন রেডিওগ্রাফির লোক, নেই কোন টেকনিশিয়ান।

এব্যাপারে উপজেলা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. তনয় তালুকদার বলেন, যদি কোন ডিগ্রি না থাকে তাহলে নামের আগে ডাক্তার বসানো আইনবহির্ভূত।

আজকের পত্রিকার অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ শহিদ হোসেন চৌধুরী সেলিমের পরিচালনাধীন আল মদিনা ডেন্টাল কেয়ারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন। দন্ত চিকিৎসক সনদ দেখাতে না পারায় তাঁকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। পাশাপাশি ডিগ্রি অর্জন করা ব্যতীত চিকিৎসক পরিচয় দিয়ে কোন রকম চিকিৎসা প্রদান করবে না এই মর্মে একটি মুচলেকাও দেন। 

এদিকে নিজের ভুয়া চিকিৎসা কার্যক্রমের চালিয়ে নেওয়ার জন্য নিজেকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেও প্রতিষ্ঠা করেছেন মোহাম্মদ সেলিম। ২০১০ সালে উপজেলার বোয়ালখালী ইউপি' ৮  নম্বর ওয়ার্ড যুব দলের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা যুব দলের সক্রিয় সদস্য থাকা এই সেলিম বর্তমানে উপজেলা বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের সভাপতি। টানা দ্বিতীয়বার ২০১৪ সালে আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর কৌশলে আওয়ামী লীগের দলীয় ব্যানারে যোগদান করেন সেলিম। 

দীঘিনালা উপজেলা বিএনপি যুগ্ম সম্পাদক কাজী রানা সেলিমের ২০১০ সালে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় থাকার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। 

এব্যাপারে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মো. কাশেম বলেন, তিনি সেলিমকে চেনেন। সেলিমের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, দেশে এখন হাইব্রিড নেতাদের জন্য প্রকৃত আওয়ামী লীগ নেতারা বিপাকে রয়েছেন। ভুঁইফোড় সংগঠন ও কথিত ভুঁইফোড় নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও তিনি জানান। 

মোহাম্মদ সেলিমের বিরুদ্ধে রয়েছে আরেক প্রতারণার অভিযোগ। নিজের রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে তিনি শুরু করেছেন সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের ব্যবসা। গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা, পণ্য খোয়া, ঠিকমতো পণ্য ডেলিভারি না দেওয়া এবং অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ নেওয়াসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ আছে তাঁর এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। 

 দীঘিনালায় চেম্বার দিয়ে চিকিৎসা দিচ্ছেন অভিযুক্ত মোহাম্মদ সেলিমএ বিষয়ে সুন্দরবনের গ্রাহক সোহেল বড়ুয়া জানান, তাঁর একটি পার্সেল থেকে অন্তত ৩ হাজার টাকার পণ্য খোয়া যায়। এ বিষয়ে এজেন্টর মালিক সেলিমকে জানালে সে কোন পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি। 

সেলিম সম্পর্কে তাঁর আপন ভগ্নিপতি শাহ-আলম জানান, 'সেলিমের বাবা গ্রামে দন্ত সেবা দিত। বাবার কাছ থেকে তিনি দাঁতের কিছুটা রপ্ত করেছেন। চট্টগ্রামের কোথাও থেকে কোর্স করে নিজেকে ডাক্তার বলে পরিচয় দিয়ে রাতারাতি এই এলাকায় একটি চেম্বার খুলে বসেন তিনি। মূলত উপজেলা বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের সভাপতি হওয়ার পর থেকেই তাঁর উত্থান শুরু হয়।' 

আজকের পত্রিকার অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত কাঠমিস্ত্রি সহকারী ছিলেন সেলিম। উপজেলার কাঠমিস্ত্রি মালেক এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, সেলিম আমার ও মৃদুল কাঠমিস্ত্রির সঙ্গে কাজ করে দক্ষ কাঠমিস্ত্রি হয়ে ওঠেন একসময়।

ভুঁইফোড় অনলাইলের আইডি কার্ড ব্যবহার করছেন মোহাম্মদ সেলিমনিজেকে সাংবাদিক হিসেবেও এলাকায় পরিচিত দেন মোহাম্মদ সেলিম। নিজের ফেসবুকে তিনি একটি সংবাদমাধ্যমের আইডি কার্ডের ছবি পোস্ট করেন। সেখানে দেখা যায় তিনি টপনিউজ ২৪ নামের ভুঁইফোড় অনলাইন নিউজ পোর্টালের খাগড়াছড়ি জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত।

খাগড়াছড়ির সিভিল সার্জন ডা. নুপুর কান্তি দাশ আজকের পত্রিকাকে জানান, এমবিবিএস বা বিডিএস ডিগ্রিধারী না হলে কেউ নিজেকে ডাক্তার হিসেবে পরিচয় দিতে পারবেন না। কেউ এমন পরিচয় ব্যবহার করলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এব্যাপারে অভিযুক্ত মোহাম্মদ সেলিমের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বললে তিনি প্রথমে নিজেকে চিকিৎসক পরিচয় দেন। পরে বলেন তাঁর বিএমডিসির নিবন্ধন নেই। রাজনৈতিক ও সাংবাদিকতার পরিচয়ের সত্যতা নিশ্চিত করে তিনি এই প্রতিবেদককে সংবাদ প্রকাশ না করার জন্যও অনুরোধ করেন।

তাঁর সকল অপকর্ম ও ডাক্তার পরিচয়ে আইনবহির্ভূত কাজের অভিযোগ আসার পর আজকের পত্রিকার প্রতিনিধির অনুসন্ধানকালে সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য বিভিন্ন হুমকি ও সংবাদ প্রকাশিত হলে মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন সেলিম। পাশাপাশি দীঘিনালা থেকে প্রতিনিধিকে বিতাড়িত করবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন। এ বিষয়ে দীঘিনালা থানায় এরই মধ্যে একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত