Ajker Patrika

পেশার আড়ালে ছিনতাই

আল-আমিন রাজু, ঢাকা
আপডেট : ১১ মে ২০২২, ১০: ৪৬
পেশার আড়ালে ছিনতাই

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে ভালোই সুনাম কুড়িয়ে নেন মাসুদ রানা হাওলাদার (৩২)। স্কুলে পাঠদানের পাশাপাশি কোচিং সেন্টারেও ইংরেজি পড়াতেন তিনি। হিসাববিজ্ঞান বিভাগ থেকে অনার্স পাস এ শিক্ষক করোনায় স্কুল ও কোচিং সেন্টারের চাকরি হারান। হঠাৎ করে মাসুদের জীবনে নেমে আসে হতাশা আর অভাব-অনটন। একপর্যায়ে একটি ছিনতাই চক্রে যোগ দেন এ শিক্ষক। বাড্ডা, রামপুরা, খিলক্ষেতসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় চক্রের হয়ে দুই বছর ধরে দাপিয়ে বেড়ান।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাতে সম্প্রতি গ্রেপ্তারের পর মাসুদের বিষয়ে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। শুধু শিক্ষক নয়, চিকিৎসক ও ইঞ্জিনিয়ার থেকেও ছিনতাইকারী হওয়ার কথা জানিয়েছে ডিবি। এমনই এক চিকিৎসক কাজী রায়হান (ছদ্মনাম)। দেশের নাম করা মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় চিকিৎসাসেবা শুরু করেন রায়হান। এরই মধ্যে রায়হানের শরীরে কিডনির সমস্যা দেখা দেয়। প্রতি মাসে কিডনির চিকিৎসা ও ডায়ালাইসিসের খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে থাকেন রায়হান। চিকিৎসা খরচ মেটাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাইয়ে নামেন রায়হান।

আশরাফুল ইসলাম ওরফে ইঞ্জিনিয়ার আশরাফ পেশায় টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার। ধানমন্ডির একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে দেশের একটি নাম করা টেক্সটাইল কোম্পানিতে চাকরি শুরু করেন আশরাফুল। করোনার ধাক্কায় চাকরি হারিয়ে একই কোম্পানির মিনি ট্রাকচালক লেলিনের সঙ্গে ছিনতাই শুরু করেন আশরাফুল। মাসে ৩৫ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করা আশরাফুল কয়েক দিনেই ছিনতাই করে ১৪ থেকে ১৫ লাখ টাকা বাগিয়ে নেন। দিনে দিনে বাড়তে থাকে অবৈধ আয়ের নেশা। মিরপুরে মোটরসাইকেল নিয়ে দুজন ছিনতাইয়ে আরও সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ছিনতাইয়ের টাকায় আশরাফুল কুষ্টিয়ায় তাঁর শ্বশুরের সঙ্গে জমির ব্যবসা শুরু করেন।

ছিনতাইকাজে আশরাফুলের গুরু হয়ে ওঠেন ট্রাকচালক লেনিন। লেনিন অন্তত আট শতাধিক ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন। লেলিনের চক্রে মগবাজার এলাকার একটি হাসপাতালের দুই অ্যাম্বুলেন্সচালক জিল্লুর ও সাইফুলও যোগ দেন। ছিনতাইয়ের টাকা দিয়ে দু্ই চালক শুরু করেন আবাসন ব্যবসা।

মাসুদ রানা, রায়হান ও আশরাফুল। তিনজনেই ছিনতাইয়ের টাকা দিয়ে পেশাজীবী হয়েছেন। ছিনতাইয়ের আগেও তাঁরা সম্মানজনক পেশাতেই ছিলেন। ডিবি জানিয়েছে, ১ মে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। ডিবি জানায়, ছিনতাই চক্রের মোটরসাইকেলচালককে পাইলট নাম দেওয়া হয়। যিনি দ্রুত পালিয়ে যেতে সক্ষম। আর পেছনে বসে যিনি ব্যাগ টান দেওয়ার কাজ করেন, তাঁকে বলা হয় ইগল।

ডিবির গুলশান বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, শিক্ষিত যুবকেরা আর্থিক সংকটকে অজুহাত বানিয়ে অপরাধে জড়ান। যদিও চাকরি চলে যাওয়ার পর তাঁদের যোগ্যতা অনুযায়ী নতুন চাকরিতে যোগদানের সুযোগ ছিল। কিন্তু সহজে বেশি টাকা আয়ের লোভে তাঁরা ছিনতাই চক্রে জড়িয়েছেন। ছিনতাইকারী হতে তাঁরা করোনায় চাকরি হারানো আর অভাব-অনটনকে অজুহাত বানিয়েছেন।

উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিরা চুরি, ছিনতাই, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ায় সমাজে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে বলে জানান অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ক্রিমিনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক। তিনি বলেন, পেশাজীবীরা গোপনে অপরাধের সঙ্গে জড়ালে পেশার প্রতি মানুষের সম্মান কমে যাবে। এটা সমাজের জন্য অশনিসংকেত।

তৌহিদুল হক বলেন, সময়ের পরিবর্তন ও প্রযুক্তির কল্যাণে নানাভাবে শিক্ষিতরা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছেন। রাষ্ট্রকে অবশ্যই এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে আরও কৌশলী হতে হবে।

ঢাবির সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফাতেমা রেজিনা বলেন, সমাজে ছদ্মবেশী অপরাধীর সংখ্যা বাড়ছে। তাঁদের চিহ্নিত করাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষ সঙ্গদোষে অপরাধে জড়াচ্ছেন। উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিরা চাকরির আয়ের চেয়ে বেশি টাকা উপার্জনের কুচিন্তা থেকেই অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছেন। ফলে ভালো পেশায় থেকেও লোভের কারণে কেউ কেউ আজ ছিনতাইকারী।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত