Ajker Patrika

ম্রো ভাষায় পড়ছে ওরা

সিং ইয়ং ম্রো
ম্রো ভাষায় পড়ছে ওরা

পার্বত্য চট্টগ্রামের শুধু বান্দরবান জেলায় ম্রো জনগোষ্ঠীর বাস। এ অঞ্চলের অন্য জনগোষ্ঠীর তুলনায় ম্রোরা শিক্ষা-দীক্ষা, আর্থসামাজিক অবস্থা—সবকিছুতেই অনেক পিছিয়ে।

বর্তমানে সরকারি আদমশুমারি অনুযায়ী ম্রোদের সংখ্যা ৩৮ হাজার ৩৮৩। আর ২০০৬ সালের ম্রো সোশ্যাল কাউন্সিলের জরিপ অনুযায়ী এই সংখ্যা ৫৬ হাজার ২৮০।

বিষ্কার ও ক্রমবিকাশপার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের ভাষা নিয়ে প্রথম গবেষণা করেছিলেন ড. গ্রিয়ারসন। সেটা ১৯০৩ সালে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত তাঁর ‘Linguistic Survey of India’ নামের বইতে তিনি ম্রো ভাষাকে বর্মি বলেছিলেন। আসলে ম্রো ভাষা তিব্বতি-বার্মিজ ভাষা, ভোট-চৈনিকের অন্তর্ভুক্ত।

এককালে ম্রোদের কোনো বর্ণমালা ছিল না। ম্রোদের কিংবদন্তি প্রাণপুরুষ ও মহাসাধক মেনলে ম্রো (ক্রামাদি) ম্রো বর্ণমালা উদ্ভাবন করেন। সেটাও ১৯৮৫-৮৬ সালে। মোট ৩১টি বর্ণ ও ৯টি সংখ্যা রয়েছে। ম্রোদের বর্ণমালার সঙ্গে রোমান, শ্যাম, বর্মি ও চৈনিক বর্ণের মিল রয়েছে। বর্ণমালা উদ্ভাবনের পাশাপাশি তিনি ম্রো জাতির জন্য ‘ক্রামা’ ধর্ম প্রবর্তন করেন। মেনলে ম্রো শুধু ধর্ম ও বর্ণমালা প্রবর্তন করে থেমে থাকেননি। ম্রো জাতিসত্তার শিকড় সন্ধান ও ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে তাঁর মূল্যবান রচনাবলি রয়েছে। ১৯৮৬ সালের ১৫ আগস্ট আধ্যাত্মিক সাধনায় নিরুদ্দেশে চলে যান তিনি। যাওয়ার আগে শিষ্যদের ভাষা ও বর্ণমালা, ধর্মীয় গ্রন্থ, সামাজিক-পারিবারিক নীতিমালা ও চিকিৎসাসেবার জন্য নিজ হাতে ম্রো ভাষা ও বর্ণমালায় লেখা সব পাণ্ডুলিপি হস্তান্তর ও নির্দেশনা দিয়ে যান।

১৯৮৬ সালে তাঁর অনুসারীদের ইচ্ছায় ও সিদ্ধান্তে ম্রো ভাষা ও বর্ণমালার মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তারের জন্য পোড়াপাড়ায় (মেনলের নিজস্ব গ্রাম) ‘ম্রো চ চা সাংরা’, অর্থাৎ ম্রো ভাষা শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ৩০ শিক্ষার্থী আসে। এক বছর মেয়াদি এই প্রশিক্ষণ শেষ করে শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় স্বেচ্ছায় বর্ণমালা শিক্ষাদানের কাজে ব্রতী হয়।

সফলভাবে প্রথম ব্যাচের শিক্ষালাভের বিষয়টি ব্যাপকভাবে সাড়া পড়ে ম্রো জাতিসত্তা–অধ্যুষিত সব এলাকায়। সামগ্রিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে তৎকালীন ক্রামাদি মেনলের যোগ্য শিষ্যদের সুদক্ষ পরিচালনায়। সার্বিক কাজে অর্থের জোগান দেয় ম্রো জনগোষ্ঠীর সংশ্লিষ্ট পাড়াবাসী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, কারবারি, হেডম্যানরা।
ক্রামাদি মেনলে নিরুদ্দেশ হওয়ার পাঁচ বছর পর বিশাল কর্মী বাহিনী নিজ উদ্যোগে ম্রো–অধ্যুষিত এলাকায় ম্রো ভাষা শেখানোর অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। ফলে সম্মেলনে ম্রো ভাষা ও বর্ণমালার ওপর যাবতীয় সিদ্ধান্ত, বর্তমান কার্যক্রম মূল্যায়ন ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনার দিকনির্দেশনা গৃহীত হয়।

ভাষার উন্নয়ন কার্যক্রম
ম্রো ভাষা ও বর্ণমালার ওপর গবেষণা, প্রকাশনাসহ অনুশীলনকেন্দ্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৯০ সালের ১৮ জানুয়ারি গঠিত হয় ‘ম্রো ভাষা বর্ণমালা সংরক্ষণ ও উন্নয়ন কমিটি’। ১১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির মাধ্যমে ভাষা কমিটির যাত্রা শুরু হয়। ১৯৯৩ সালে ম্রো জাতির প্রবল উৎসাহী ও অঙ্গীকারবদ্ধ কর্মী বাহিনী ভাষা কমিটির কার্যক্রম সুসংগঠিত ও জোরদার করার লক্ষ্যে মূল কমিটির আওতাধীন উপজেলাভিত্তিক উপকমিটি গঠন করে। মূল কমিটির সঙ্গে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে নিয়মিত কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে তারা।

১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর মেনরুম ম্রো তৈরি করলেন ‘রিয়েন’ নামে একটি ম্রো ফন্ট। ম্রো ভাষার বর্ণমালা আধুনিক বিশ্বদরবারে পৌঁছানোর প্রচেষ্টা সার্থক হয়। এই কার্যক্রমে ভাষা কমিটির কর্মীরা উৎসাহ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত গবেষণা ও প্রকাশনার কাজে তথ্যসমৃদ্ধ ও মানসম্মত অঙ্গীকার নিয়ে মনোযোগী হলেন তাঁরা। গঠিত হলো গবেষণা ও প্রকাশনা কমিটি। সামাজিক ও সাংগঠনিক কাজের পরিধি যথারীতি রেখে তাঁরা গভীর মনোনিবেশ করলেন এ কাজে। এই কমিটির বিগত দিনের কার্যক্রম যখন আস্থা অর্জন করে, তখন ম্রো ভাষার বর্ণমালাকে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য মানসম্মত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রিয়েন ফন্টের মাধ্যমে শিশু থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার মানসম্মত পাঠ্যপুস্তকের পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজ সম্পন্ন হয় ২০০৩ সালে। গবেষণা ও প্রকাশনার উপযোগী পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ম্রো জনগোষ্ঠীর আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া হয়।

ম্রোদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের কার্যক্রম আরও গতিশীল করার লক্ষ্যে কমিটি গঠনের পরপরই ৩০ জন দক্ষ শিক্ষার্থী নিয়ে দুমাস মেয়াদি একটি বনিয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। পরে ম্রোদের ২০০ গ্রামে পাঠানো হয় তাঁদের। প্রতি শিক্ষার্থী তিন-চারটি গ্রাম নিয়ে কেন্দ্র গড়ে তুলে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমে শিক্ষাদান করেন। গ্রামবাসীর মুষ্টিচালের মাধ্যমে জমা করা মাসিক এক হাজার টাকা সম্মানী হিসেবে দেওয়া হয়। এভাবে ১৯৯১ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে এই কার্যক্রম ৯০ ভাগ সফলতা অর্জন করে।
বর্তমানে ম্রো সমাজে কেবল ম্রো ভাষা নয়, জাতীয় শিক্ষা গ্রহণেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। এককালে শিক্ষাবিমুখ ম্রো ছেলেমেয়েরা বর্তমানে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছে। ম্রোরা এখন নিজ ভাষায় ৬০ শতাংশ সাক্ষরতা অর্জন করেছে। 

সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কার্যক্রম
২০০০ সালে বান্দরবান উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট (বর্তমানে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট) ম্রো আবাসিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে ‘ম্রো ভাষা শিক্ষা কোর্স’ চালু করে। এতে ম্রোদের মাতৃভাষা উন্নয়নের বিষয়টি ফিরে আসে। পুনর্গঠিত হয় ‘ম্রো ভাষা ও বর্ণমালা উন্নয়ন ও সংরক্ষণ কমিটি’। 
২০০৫ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ম্রো ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র বান্দরবান জেলায় ৭ উপজেলার মোট ৩৫ গ্রামে গণপাঠশালা নামে ম্রো ভাষায় স্কুল পরিচালনা করে। এতে প্রায় এক হাজার শিশু মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়। এই বিদ্যালয় থেকে পাস করে অনেক ছাত্র-ছাত্রী বর্তমানে দেশে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে।

সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতায় বর্তমানে ম্রো ভাষার উন্নয়ন ঘটলেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। বিশাল অংশ এখনো এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এ ছাড়া পর্যাপ্ত বই নেই। রয়েছে অর্থের সংকট। সর্বোপরি ম্রো–অধ্যুষিত গ্রামে পড়ার পরিবেশ তৈরিতে স্কুলঘর দরকার। এসব বাধা কাটিয়ে উঠতে পারলে বিশ্বদরবারে ম্রো ভাষা হয়ে উঠবে একটি সমৃদ্ধ ভাষা। 

সিং ইয়ং ম্রো, কবি ও লেখক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

যুবককে আটক করা নিয়ে বিজিবি ও এলাকাবাসীর পাল্টাপাল্টি দাবি

‘তেলের ক্রেতা’ হিসেবে ভারতকে আর পাবে না রাশিয়া, জানালেন ডোনাল্ড ট্রাম্প

শাস্তি পাচ্ছেন বিটিআরসির মহাপরিচালকসহ ৩০ জনের বেশি কর্মকর্তা

বরখাস্ত সৈনিককে অস্ত্র দিয়েছেন বিএনপি নেতা, অডিও নিয়ে তোলপাড়

ভূমি অফিসের কাণ্ড: এসি ল্যান্ড দপ্তরের নামে দেড় কোটি টাকা আদায়

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত