Ajker Patrika

যশোরে কৃষক দল নেতা হত্যার জেরে ১৩ পরিবারের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট

­যশোর প্রতিনিধি
যশোরের অভয়নগরে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি। ছবি: আজকের পত্রিকা
যশোরের অভয়নগরে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি। ছবি: আজকের পত্রিকা

যশোরের অভয়নগর উপজেলার ডহরমশিয়াহাটি গ্রামের বাড়েদাপাড়া। ভবদহ অঞ্চলের বিলের মধ্যে মতুয়া সম্প্রদায়ের পাড়াটির অবস্থান। এখানে দোচালা টিনের বাড়িতে এক ছেলেকে নিয়ে বসবাস মহিতুল বিশ্বাস ও স্মৃতি বিশ্বাস দম্পতির। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে তাঁদের বাড়িতে চলছিল পূজা-অর্চনা। তখন কয়েকজন দুর্বৃত্ত এসে হামলা চালায়। প্রথমে লুটপাট, পরে অগ্নিসংযোগ করে। আগুনে দুটি বসতঘরের সব জিনিসপত্র পুড়ে যায়। নিস্তার পায়নি পাশের গোয়ালঘরটিও। সেখানেও আগুন দেয়। হামলার সময় পরিবারের সদস্যরা পালিয়ে আশ্রয় নেন পাশের বিলে।

স্মৃতির মতো আগুনে পুড়ে গেছে বাড়েদাপাড়ার ১৩ পরিবারের ১৮টি ঘর। অগ্নিসংযোগের আগে এসব ঘরে লুটপাট চলে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, উপজেলার নওয়াপাড়া পৌর কৃষক দলের সভাপতি তরিকুল ইসলাম সরদার গতকাল সন্ধ্যায় ঘের লিজ নেওয়ার জন্য বাড়েদাপাড়ার পিন্টু বিশ্বাসের বাড়ি যান। সেখানে চুক্তিপত্র করার সময় গোলযোগ হলে ৭-৮ জন দুর্বৃত্ত কুপিয়ে ও গুলি করে তরিকুলকে হত্যা করে। এ ঘটনার জেরে তরিকুলের সমর্থকেরা পিন্টুর তিনটি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেন। সেই সঙ্গে অজ্ঞাতনামা লোকজন দল বেঁধে এসে পিন্টুর প্রতিবেশীদের বাড়িতেও ভাঙচুর ও লুটপাট চালান। বাড়ির বাসিন্দারা ভয়ে আশ্রয় নেন বিলের ঝোপঝাড়ে। এরপর দূর থেকে দেখতে পান তাঁদের ঘরে আগুন জ্বলছে।

ভুক্তভোগীরা আজ শুক্রবার সকালে বাড়ি ফিরে দেখেন, ধানের গোলা, বসতঘর, রান্নাঘর, গোয়ালঘর, টিভি, ফ্রিজ, মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল—সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আজ বিকেলে পাড়াটি ঘুরে দেখা যায়, চারদিকে ঘরবাড়ি ও জিনিসপত্র পোড়ার ছাই। বেশির ভাগ বাড়ি পুরুষশূন্য। দূরদূরান্ত থেকে স্বজনেরা খাবার নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়িতে আসছেন। পাড়াটি গতকাল রাত থেকে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন। নিরাপত্তা দিতে মোড়ে মোড়ে মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ। মাঝেমধ্যে আসছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরাও। তারপরও আতঙ্ক কাটেনি মতুয়া সম্প্রদায়ের পাড়াটিতে।

পোড়া বাড়িতে স্মৃতি ফিরলেও ভয়ে স্বামী-ছেলে ফেরেননি। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘তিন দিন ধরে আমার বাড়িতে পূজা চলছিল, বিভিন্ন দল ধর্মীয় কীর্তন করছিল, বাজনা বাজছিল। হঠাৎ ছয় থেকে সাতজন আমার বাড়িতে এসে কিছু না বলেই ভাঙচুর করে, গালিগালাজ করতে থাকে। তাদের হাতে অস্ত্র ছিল। আমাদের মারধর করেছে। আগুন ধরাতে শুরু করতেই ভগবানের নাম নিতে নিতে প্রাণে বাঁচতে দৌড় দিলাম বিলের দিকে। বনজঙ্গল, পানি মাড়িয়ে বিলের এক ঢিবিতে লুকিয়ে থাকলাম। দূর থেকে দেখছি আমার বাড়িঘর আগুনে পুড়ছে। সকালে ফিরে এসে দেখি কিচ্ছু নেই। বাড়িতে দুো মোটরসাইকেল ছিল, সেটাও পুড়ে ছাই। ঘরের ভেতর বাক্স ভাঙা, তার ভেতরে কাপড়চোপড় আগুনে পুড়ে গেছে। ঘরের টিন পুড়েছে। স্বর্ণালংকার নিয়ে গেছে। আগুন দেওয়ার আগে তারা বাড়িঘর লুটপাট করেছে। গরু-ছাগলের ঘরও পুড়ে ছাই। পরনের কাপড় ছাড়া আমার আর কিছু নেই।’

যশোরের অভয়নগরে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি। ছবি: আজকের পত্রিকা
যশোরের অভয়নগরে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি। ছবি: আজকের পত্রিকা

পাড়াটির মাঝখানে বাড়ি চণ্ডিকা বিশ্বাসের। তাঁদের দুটি ঘর পুড়ে গেছে। পোড়া বাড়ির মেঝেতে শয্যাশায়ী তাঁর শাশুড়ি। উঠানের পেয়ারাগাছের নিচে কপালে হাত দিয়ে বসে থাকা মাঝবয়সী চণ্ডিকার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কিছু বলার নেই। কী বলব? যা যাওয়ার তো আমাদের চলে গেছে। আমরা কী অপরাধ করেছি? নিরীহ গরিব আমরা। যারা অপরাধ করেছে, তাদের শাস্তি দিক। আমরা তো কোনো অপরাধ করিনি। তাহলে আমাদের কেন পোড়াল?’

হামলার ভয়াবহতার স্মৃতিচারণ করে এই নারী বলেন, ‘যখন হামলা হয়, তখন ছেলে, ছেলের বউ আর আমার স্বামী বিলের জল মাড়িয়ে পাশের গ্রামে চলে যায়। আমার শাশুড়ি অসুস্থ। তাদের বলছে, তোমরা আমাদের ঘরে যা আছে নিয়ে যাও, আগুন দিয়ো না। তারপরও লুটপাট করে আগুন দিয়ে তারা চলে যায়। আমাকে গালাগালি দিয়ে তেড়ে মারতে আসলে আমি দূর থেকে সব দেখছিলাম।’

যশোরের অভয়নগরে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি। ছবি: আজকের পত্রিকা
যশোরের অভয়নগরে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি। ছবি: আজকের পত্রিকা

সবার আগে আগুন দেয় পরিতোষের বাড়িতে। তিনি বলেন, ‘কোনো রকমে জানডা নিয়ে পালিয়ে ছিলাম। জামা-গেঞ্জি পরার সময়টুকুও পাইনি। বাড়িতে বুড়ো বাবা-মা ছিল। তাদের ফেলে চলে গেছিলাম।’ তাঁর দাবি, আগুন দিলে ফায়ার সার্ভিসের লোকদের জানানো হয়, কিন্তু হামলাকারীরা তাঁদের আসতে দেয়নি।

পরিতোষ বলেন, ‘ঘরবাড়ি, দোকানপাট পুড়ে গেছে। গাছের পাতাও পুড়ে গেছে। আমরা আতঙ্কে আছি। পাড়া পুরুষশূন্য। আমরা নিরপরাধ এসব মানুষের যারা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।’

যশোরের অভয়নগরে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি। ছবি: আজকের পত্রিকা
যশোরের অভয়নগরে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি। ছবি: আজকের পত্রিকা

এদিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন যশোরের বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারা। এ ছাড়া জেলা পুলিশ সুপার রওনক জাহানসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যশোরের নেতারা ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলেছেন।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে অভয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল আলীম জানান, তরিকুল ইসলাম সরদার হত্যাকে কেন্দ্র করে কিছু বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল রাতেই পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা আগুন নিয়ন্ত্রণ করেন। ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে এবং এ ঘটনায় প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হত্যাকাণ্ড ও অগ্নিকাণ্ডে কোনো মামলা হয়নি। তবে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ড. ইউনূসের পদত্যাগের গুঞ্জন, পরিস্থিতি নিয়ে যা বলছে রাজনৈতিক দল ও উপদেষ্টারা

‘প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করবেন না’ লেখা পোস্টটি সরিয়ে ফেললেন ফয়েজ তৈয়্যব

দেশে ফিরলেন আওয়ামী লীগ নেতা, বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার

পার্লামেন্টে জুতায় বিয়ার ঢেলে পান করে রাজনীতিকে বিদায় জানালেন এমপি

চিকিৎসকের ছুরিকাঘাতে আহত তরুণ মারা গেছেন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত