Ajker Patrika

দখলের দৌরাত্ম্য

দখলের সংক্রমণে জেরবার সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল

  • দখলের উৎসবে প্রাচীর দিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়েছে কয়েক একর।
  • প্রাচীরের বাইরে জমি দখল করে গড়ে উঠেছে বস্তি, ঘর, দোকান।
  • প্রাচীরের ভেতরে বসে মাদক ও জুয়ার আসর, নেই নিরাপত্তা।
  • দেয়াল ভেঙে পকেট গেট বানিয়ে চলাচল করছে স্থানীয়রা।
মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ, ঢাকা
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

দখলের সংক্রমণ থেকে বেরই হতে পারছে না রাজধানীর মহাখালীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল। দখলের থাবায় ক্রমে আয়তন কমছে বিশেষায়িত এই স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানটির। সীমানা প্রাচীরের বাইরে জমি দখল করে গড়ে উঠেছে সাততলা বস্তি, ঘর, দোকান, কাঁচাবাজারসহ বিভিন্ন স্থাপনা। সীমানাপ্রাচীরের ভেতরে সন্ধ্যা ও রাতে বসে মাদক ও জুয়ার আসর।

হাসপাতালের প্রধান ফটক এবং দেয়াল ভেঙে করা পকেট গেট দিয়ে চলাচল করে আশপাশের বাসিন্দারা। এতে ব্যাহত হচ্ছে পরিবেশ। নিরাপত্তাহীনতার কারণে আবাসিক এলাকায় থাকেন না চিকিৎসকেরা। চিকিৎসা নিতে রোগীদেরও আগ্রহ কম।

হাসপাতাল সূত্র বলেছে, দখলের সঙ্গে হাসপাতালের কিছু কর্মচারী ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। বস্তিতে তাঁদের কারও কারও ১০০ থেকে ২০০ ঘর রয়েছে। বেদখল হওয়া জমি উদ্ধার ও নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি জানিয়ে বিভিন্ন সময় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং পুলিশ প্রশাসনকে চিঠি দিলেও দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে দখলের বিস্তার ঘটেছে। গত আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিলেও চিত্র বদলায়নি।

মহাখালীতে হেলথ জোনের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে সরকারি বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের অবস্থান। সংক্রামক রোগের চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামে একটি হাসপাতাল থাকলেও মহাখালীরটিই বড়। এটি ১০০ শয্যার এবং দেশে সংক্রামক ব্যাধি চিকিৎসার একমাত্র পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল। এখানে কুকুর, বানর, বিড়াল, শিয়ালসহ বিভিন্ন হিংস্র প্রাণীর কামড়ে আহত রোগী, ধনুষ্টংকার, ভাইরাল এনকেফেলাইটিস, ডিপথেরিয়া, ভাইরাল হেপাটাইটিস, এইচআইভি পজিটিভ, কোভিড-১৯, জন্ডিস, জলবসন্ত, নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, হামসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগে আক্রান্তদের ভর্তি করে চিকিৎসা ও টিকা দেওয়া হয়। অথচ অবহেলিত এই হাসপাতাল পূর্ণ সক্ষমতায় সেবা দিতে পারছে না। পরিবেশসহ বিভিন্ন কারণে চিকিৎসা নিতে রোগীদেরও আগ্রহ কম বলে জানিয়েছেন হাসপাতালসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন নামে ১৯৫৬ সালে এই প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু। ১৯৭২ সালে এর নামকরণ করা হয় সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল। তখন হাসপাতালকে ৩৫ একর জমি বরাদ্দ দেয় সরকার। পরে বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ (বিএমআরসি), ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল স্টাফ কোয়ার্টার, ন্যাশনাল ইলেকট্রো-মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (নিমিউ অ্যান্ড টিসি), ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স অর্গানাইজেশন (টেমো), পরিবার পরিকল্পনা পণ্যগার, জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল স্টাফ কোয়ার্টার, কুষ্ঠ হাসপাতাল স্টাফ কোয়ার্টার, আইপিএইচ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বঙ্গমাতা জাতীয় সেলুলার এবং মলিকুলার রিসার্চ সেন্টারসহ কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ওই জমি থেকে ২৪ একর জমি দেওয়া হয়। তবে একমাত্র বঙ্গমাতা জাতীয় সেলুলার এবং মলিকুলার রিসার্চ সেন্টারের নামে ৩ একর জমির রেজিস্ট্রেশন রয়েছে। বাকি ২১ একর জমি এখনো সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের নামে থাকায় খাজনা দিতে হয় এই প্রতিষ্ঠানকেই।

কর্তৃপক্ষ বলেছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ছেড়ে দেওয়ার পর হাসপাতালের কাছে থাকা বাকি ১১ একর জমির বেশির ভাগই বেদখল হয়ে গেছে। দখল না হওয়া জমিতে হাসপাতালের মূল ভবন, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আবাসিক ভবন, মসজিদ, মন্দির, গাড়ির গ্যারেজ, পানির পাম্প হাউস, জলাতঙ্ক প্রতিরোধমূলক ভবন রয়েছে। প্রাচীরের বাইরে থাকা জমি দখল করে গড়ে উঠেছে বস্তিঘর; কাঁচা, আধা পাকা ও পাকাঘর; দোকান; রিকশার গ্যারেজ; কাঁচাবাজার; রাজনৈতিক দলের কার্যালয়সহ অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা। তবে প্রাচীরের ভেতরেও স্বস্তি নেই। প্রাচীরের ভেতরে ভবনের সামনে সন্ধ্যা ও রাতে বসে মাদক ও জুয়ার আসর। নিরাপত্তাহীনতার কারণে আবাসিক এলাকায় থাকছেন না চিকিৎসকেরা।

সরেজমিনে দেখা যায়, বিএমআরসির দক্ষিণ পাশে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের সাততলা মূল ভবন। অবৈধ দখল থেকে রক্ষা করতে দুই দশক আগে হাসপাতাল ভবনের চারপাশে প্রাচীর তৈরি করেছে কর্তৃপক্ষ। তবে প্রাচীরের পশ্চিম দিকের দেয়াল ভেঙে স্থানীয় বাসিন্দারা যাতায়াতের পথ করেছেন। হাসপাতালের মূল ফটক দিয়ে ঢুকে দক্ষিণের পকেট গেট দিয়ে বের হন তাঁরা। হাসপাতাল প্রাঙ্গণে সারাক্ষণ চিৎকার-চেঁচামেচি। দুপুরের পর মানুষের সমাগম বাড়ে। কয়েকজন বললেন, সন্ধ্যায় মাদক ও জুয়ার আসরও বসে। এতে চিকিৎসা বিঘ্নিত হয়। রাতে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন রোগী, তাঁদের স্বজন এবং সেবাদানকারীরা।

দক্ষিণ পাশে প্রাচীর ঘেঁষে হাসপাতাল জামে মসজিদ। কয়েক গজ দূরে কর্মচারীদের চারটি আবাসিক ভবন (অনামিকা ১, ২, ৩, ৪)। আরেক পাশে চিকিৎসক ও নার্সদের আবাসিক এলাকা। সেখানে ফটক দিয়ে ঢুকতে শুরুর ভবনটি নার্সিং সুপার ভবন, সার্জন কোয়ার্টার (বলাকা-২), তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের ভবন (বলাকা-৩), নার্সিং ডরমিটরি (বলাকা-৫), সিনিয়র কনসালট্যান্ট কোয়ার্টার (বলাকা-১)। দিনেও সেখানে মাদকের আসর বসাতে দেখা গেছে। বস্তিবাসীরা হাসপাতাল প্রাঙ্গণের শেষ প্রান্তে গরুও চরান। শেষ মাথায় বানানো হয়েছে পকেট গেট। সবজি চাষও করা হচ্ছে। এই কম্পাউন্ডের গেটে জাকের পার্টির কার্যালয়। সেখানে প্রতি বেলা বড় ডেকচিতে রান্না হয় বলে জানা গেল। এই প্রাঙ্গণের বাইরে হাসপাতালের থাকা অন্তত ৭ একর জমি বেদখল হয়েছে। মূল প্রাচীর ঘিরে ময়লার স্তূপ। ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনায় ঘাটতির কারণে ভারী বর্ষণে প্লাবিত হয় হাসপাতাল এলাকা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের একজন কর্মচারী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সাততলা বস্তি’ দিন দিন হাসপাতালকে গ্রাস করছে। অবৈধ স্থাপনা হাসপাতাল ও আবাসিক এলাকার সীমানার মধ্যে বিস্তার লাভ করছে। এতে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হওয়াসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

জানা যায়, হাসপাতালের জায়গা দখল চলছে কয়েক দশক ধরে। এর পেছনে ওই হাসপাতালের কর্মচারী ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জড়িত। কারও কারও এই বস্তিতে ১০০ থেকে ২০০ ঘর রয়েছে। তাঁরা মাসে লাখ লাখ টাকা ভাড়া আদায় করছেন।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, দখল হওয়া জমি উদ্ধারে ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময় কার্যক্রম নেওয়া হয়। তবে হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকায় তা স্থগিত হয়। বর্তমানে প্রাচীরের বাইরে হাসপাতালের খালি জায়গা দখল করে বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এসব অবৈধ স্থাপনা, বস্তিঘর, দোকান, রিকশা গ্যারেজে অবৈধভাবে হাসপাতালের বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাসের সংযোগ নেওয়া হয়েছে। এই বিদ্যুৎ বিল দিতে হচ্ছে হাসপাতাল প্রশাসনকে। গত জানুয়ারিতে বিদ্যুৎ বিল দিতে হয়েছে ৪ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। কোনো কোনো মাসে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা বিল হয়। অবৈধ বিদ্যুৎ-সংযোগ দেওয়ার সঙ্গে হাসপাতালের ইলেকট্রিশিয়ান জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বেদখল হওয়া জমি ও স্থাপনা উদ্ধার এবং নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি জানিয়ে বিভিন্ন সময় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং পুলিশ প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছে। তবে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সর্বশেষ গত ১১ ফেব্রুয়ারি ডিএমপির গুলশান বিভাগে ও ৯ মার্চ স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে চিঠি দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের বহু জমি অবৈধভাবে দখল হয়েছে। হাসপাতালে আগত রোগী ও সেবাদানকারীদের নিরাপত্তাহীনতার কথা আমরা জেনেছি। আমরা এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছি।’

জানা যায়, সরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে শয্যার চেয়ে কয়েক গুণ রোগী থাকলেও সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে নিরাপত্তা ও উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে মোট শয্যার বিপরীতে ৫০ শতাংশ রোগী ভর্তি থাকে। হাসপাতালটিতে ১০ শয্যার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) ৫টি শয্যা চালু রয়েছে। পাঁচ শয্যার হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ) থাকলেও জনবলের অভাবে তা অকার্যকর। অস্ত্রোপচারের কক্ষ (ওটি) এখনো নির্মাণাধীন। ওটি না থাকায় সংক্রামক ও জটিল রোগী, এইচআইভি আক্রান্ত রোগী ও প্রসূতিদের অস্ত্রোপচার হচ্ছে না। চিকিৎসক এবং অন্যান্য জনবলের সংকটও রয়েছে হাসপাতালটিতে।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করা সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. মো. আরিফুল বাসার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘হাসপাতালের জমি অবৈধ দখলের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জানানো হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে ব্যবস্থা নেবে। আমরা চিকিৎসা সেবার মান উন্নয়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

অবৈধ দখল রোধ ও নিরাপত্তার বিষয়টি আমলে নিয়ে কাজ করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলে জানান অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত সড়ক কার্পেটিং বিচারপতি খিজির হায়াতের, প্রমাণ পেয়েছে দুদক

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

বগুড়ায় ছাত্রদল নেতার ওপর হামলা, পাঁচ নেতা-কর্মীকে শোকজ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত