Ajker Patrika

টাঙ্গাইলে ‘তাণ্ডব’ চলচ্চিত্র প্রদর্শনে বাধা প্রসঙ্গে যা বললেন আয়োজক

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১১ জুন ২০২৫, ১৭: ১৭
জেলা পরিষদের কমিউনিটি সেন্টারে তাণ্ডব সিনেমা প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ছবি: সংগৃহীত
জেলা পরিষদের কমিউনিটি সেন্টারে তাণ্ডব সিনেমা প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ছবি: সংগৃহীত

টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে নিরাপত্তার অভাবে চলচ্চিত্র প্রদর্শন বন্ধ করার হয়েছে বলে জানিয়েছেন আয়োজকেরা। উপজেলার আউলিয়াবাদ এলাকায় অবস্থিত জেলা পরিষদের কমিউনিটি সেন্টার কাম মাল্টিপারপাস হল ভাড়া করে ঈদের দিন থেকে ‘তাণ্ডব’ সিনেমা প্রদর্শন করা হচ্ছিল। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে সেটি বন্ধ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে আয়োজক কামরুজ্জামান সাইফুল এবং সাজু মেহেদী গণমাধ্যমকে বলেন, হলটি দৈনিক ১০ হাজার টাকা ভাড়ায় জেলা পরিষদ থেকে অনুমোদন নিয়েছিলেন তাঁরা। পাঁচ দিনের ভাড়া অগ্রিম দিয়েছিলেন। শুরু থেকে একটি মহল চলচ্চিত্র প্রদর্শনের বিরোধিতায় নামে। প্রচার–প্রচারণায় বাধা দেওয়া হয়েছে। পোস্টার লাগাতে দেয়নি। নিরাপত্তাহীনতার কারণে গতকাল সন্ধ্যা থেকে চলচ্চিত্র প্রদর্শন বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা।

এ নিয়ে আজ বুধবার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন আয়োজক কামরুজ্জমান সাইফুল। তাঁর স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো:

আমি মোহাম্মদ কামরুজ্জমান সাইফুল দীর্ঘদিন থেকে ফিল্ম মার্কেটিং এবং ফিল্ম অফস্ক্রিন অ্যাডভার্টাইজিং এর সাথে জড়িত। এ কারনে চলচ্চিত্রের প্রতি আমার এক ধরনের ভালোবাসা আছে। যেহেতু টাঙ্গাইল শহরে কোন সিনেমা হলে নেই সে কারনে আমরা উভয়ে মিলে ঈদুল আযহা উপলক্ষে তান্ডব ছবিটি অস্থায়ী প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শন করার পরিকল্পনা করি। টাঙ্গাইল শহরের ভেতরে কোন অডিটোরিয়াম খালি না থাকায় ‘জেলা পরিষদের’ মালিকানাধীন কালিহাতী থানার অন্তর্গত আউলিয়াবাদ অডিটোরিয়ামটি যথাযথ নিয়মে ১ মাসের জন্য ভাড়া নেই।

ঈদের দিন থেকে সিনেমা চালানোর জন্য প্রচারণা এবং অডিটোরিয়ামটি প্রস্তুত করতে থাকি। এর মধ্যে আমরা খবর পাই ঈদের আগের দিন স্থানীয় মসজিদ ও মাদ্রাসাগুলো থেকে অডিটোরিয়ামে তান্ডব চালানো বন্ধ করার জন্য মাইকে ঘোষণা হয়েছে এবং সমস্ত পোস্টার ও ব্যনার ছিড়ে ফেলা হয়েছে। এরপর আলেম সমাজ বা ওলামা পরিষদ নামে একটি মিছিল বের হয়। ঘটনাটি ফেসবুকে স্থানীয়ভাবে ভাইরাল হয়ে যায়। এতে করে স্থানীয় জনগণের ভেতরে আশংকা তৈরি হয় যে অডিটোরিয়ামটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ঈদের দিন অডিটোরিয়াম ঘেরাও হতে পারে এরকম সংবাদ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। চারিদিকে আতঙ্কিত অবস্থার সৃষ্টি হয়। ফলাফল ঈদের দিন অডিটোরিয়ামটিতে কোন দর্শক আসেনি। সঠিক সময়ে আশে পাশের এলাকার দর্শক না আসায় দূরের দর্শক অডিটোরিয়ামের সামনে দিয়ে এসেও ঘুরে যেতে থাকে। তবুও একপ্রকার অনন্যোপায় হয়েই মাত্র ২০ / ২৫ জন দর্শক নিয়েই সন্ধ্যার শো টি চালু করে দেয়া হয়।

পরের দিন আলেম সমাজ আউলিয়াবাদ বাজারসহ আশেপাশের এলাকা থেকে সিনেমা হল বন্ধ করার জন্য গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করে উপজেলা নির্বাহী পরিষদ বরাবর আবেদন করে। আমরা ঈদের আগেই স্থানীয় থানায় পুলিশি সহায়তা চেয়ে আবেদন করেছিলাম। এলাকার থমথমে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে থানায় যোগাযোগ করা হলে আলেম সমাজের কথা শুনে কার্যত থানা থেকে কোন ধরনের সহায়তা করা হয়না। টাঙ্গাইল ডিএসবি এবং এসপি অফিসে যোগাযোগ করার পর ঈদের বন্ধের অযুহাতে নিরাপত্তা না দিয়ে পাশ কাটিয়ে দেয়া হয়। এভাবে সব জায়গাথেকে চেষ্টা করেও আমাদের প্রশসানিক সহায়তা পেতে ব্যর্থ হতে হয়। এমতাবস্থায় শত বাধা সত্বেও ঈদের পরের দিন অডিটোরিয়াম চালু রাখার সিদ্ধান্ত নেই। সেদিন মিছিল না হলেও আলেম সমাজের সমাবেশ ঘটে। জানা যায় শুধুমাত্র আউলিয়াবাদ নয় আলেম সমাজ সারা টাঙ্গাইল শহরে সর্বদলীয় মিছিল সমাবেশ করার আহŸান করা হয়েছে। উপরন্তু সহায়তা প্রদান না করে থানা, উপজেলা, জেলা পরিষদ তদুপারি ডিএসবি অফিস থেকে আমাকে জানানো হয়, এই বিষয় নিয়ে মিটিং মিছিল হলে পারমিশন ক্যানসেল করে দেয়া হবে। প্রায় সবাই আমাকে নেগোশিয়েট করার পরামর্শ দেয়। স্থানীয় গণ্যমান্য লোকজনও সংস্কৃতিপ্রেমী হলেও তারা এরকম ধর্মীয় সেনসিটিভ ইস্যূ নিয়ে আলেম সমাজের মতের বাইরে কথা বলতে চায়না। তবুও আলেম সমাজের সাথে কথা বলার সুযোগ পাওয়া গেল এক শর্তে তারা কেউ কোন কথা বলবেনা শুধুমাত্র আমাকেই যা বলার বলতে হবে।

আমি হাত জোড় করে মাফ চেয়ে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সময়ের আর্জি জানালাম। আলেম সমাজ অনড়। আমাকে কালই চলে যেতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমি না চলে যাবো ততক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের কার্যক্রম চলতেই থাকবে। অত্র এলাকায় প্রচারণার জন্য মাইক বন্ধ করে দেয়া হয়। অডিটোরিয়ামে থাকা সমস্ত কর্মীকে ভেতরে অবরোধ করে রাখার হুমকি দেয়া হয়। এতে করে অত্র এলাকায় একটি আতঙ্কিত ও থমথমে পরিবেশের সৃষ্টি হয়। আরো গুঞ্জন শোনা যায় অডিটোরিয়ামের বাইরে বের হলেই আমাদের উপর হামলা হতে পারে। ইতোমধ্যে আমাদের অডিটোরিয়ামের সামনে থেকে বড় ব্যানারটি খুলে ফেলতে নির্দেশ দেয়া হয়। আমি অডিটোরিয়াম থেকে বড় ব্যানারটি খুলে ফেললে কার্যত হলটি বন্ধ হয়ে যায়।

অত্র এলাকায় আমাকে ‘নাস্তিক’ ‘মুরতাদ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এতে করে আমি প্রতিনিয়ত নিরাপত্তহীনতায় ভুগতে থাকি। এমতাবস্থায় আমরা নিজেদের জান মাল রক্ষোর্থে পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই অডিটোরিয়ামটি বন্ধ করে রাতের আধারে চলে আসতে বাধ্য হই।

চলচ্চিত্র হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহত্তম গণমাধ্যম। এর নির্মাণ আয়োজন যেমন বিশাল তেমনই প্রদর্শনের জন্য দরকার পড়ে ব্যাপক প্রস্তুতির। ঈদ মানেই আনন্দ। ঈদের সিনেমা একটা বড় আনন্দ ও বিনোদনেরই অংশবিশেষ। ঈদের সময় মানুষ দীর্ঘ সারি পেরিয়ে সিনেমা হলে যায়। অনেক হলে এসি নেই। একে তো লোকে লোকারণ্য তার উপর আবার নড়বড়ে ফ্যান। ঘামে সারা গা জবজব করে। এতসব মেনে নিয়েও মানুষ সিনেমা দেখে। বিনোদন পেতে চায়। আর তাইতো ঈদের সময় বড় বড় তারকা সম্বলিত চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। প্রযোজকের লগ্নি উঠে আসে। এক সময় আমাদের ১৪০০ এর ও বেশি নিয়মিত সিনেমা হল ছিলো। কমতে কমতে এখন ৭০ / ৮০টি নিয়মিত এবংদেড় শতাধিকের মতো সিনেমা হল হিসেবে টিকে আছে। সরকার যদি অপশক্তির কাছে ভয় পায় তাহলে অচিরেই সিনেমা হল শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে।

আউলিয়াবাদ অডিটোরিয়াম মানেই এ দেশের যেকোন সিনেমা হল। শুধুমাত্র আলেম সমাজের বাঁধার কারনে এখান থেকে তান্ডব সরিয়ে নেয়া মানে পুরো তান্ডবের সাথে সংশ্লিষ্ট সবার সাথেই এমন ধর্মীয় ধুয়ো তুলে আঘাত হানা। এ কারনেই শিল্প সংস্কৃতিকে বাঁচাতে হলে সবাইকে যার যার জায়গা থেকে এগিয়ে আসতে হবে। বিভিন্ন সমিতির প্রতিবাদ করতে হবে। সাংবাদিকদের কলম তুলতে হবে। নইলে আজ আমাকে ধ্বংস করেছে কাল সবাইকে এমন ঘটনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

আউলিয়াবাদের এই ন্যাক্কারজনক ঘটনা সারাদেশের চলচ্চিত্রপ্রেমী এবং তান্ডব প্রযোজনা পরিবেশনা প্রতিষ্ঠান ও তদসংশ্লিষ্ট সকলের জন্যই একটা অশনী সংকেত! আজ আমি ধ্বসপ্রাপ্ত এবং ক্লান্ত। আমার ব্যর্থতার সমস্ত দায়ভার আমার উপর নিয়ে শিল্প সংস্কৃতির উপর যে আঘাত হানা হয়ে তার বিচারের দায়ভার জাতীর উপর দিয়ে ভারমুক্ত হলাম। ধন্যবাদ সবাইকে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত