Ajker Patrika

‘মোর পোলারে ওরা গাঙ্গে ভাসাইয়া দেছে’

পাথরঘাটা ও বরগুনা প্রতিনিধি
আপডেট : ১১ মার্চ ২০২২, ১৭: ০০
‘মোর পোলারে ওরা গাঙ্গে ভাসাইয়া দেছে’

‘রাইত ১০টার সময়ও কইছি, টাহা যায় যাউক, হাতর (সাঁতার) জানো না, বাবা ওগো লগে তোর পিকনিকে যাওন লাগবে না, মুই তোরে বাসায় কাইল ভালো রাইন্দা খাওয়ামু। যাওনের সোমায় ছারেগো কইছি, ছার মোর পোলায় কৈলোম হাতর জানে না, ওরে গাঙ্গে নামাইবেন না। মোর পোলারে ওরা গাঙ্গে ভাসাইয়া দেছ। ও বাবা, মোর সূর্য, তুই কোম্মে ঘুমাইলি বাবা...’ বুক চাপড়ে আহাজারি করছিলেন উমা ঘোষ। বরগুনা কলেজসংলগ্ন ডিকেপি সড়কের পীযূষ ঘোষের বাড়িতে তখন মাতম, স্বজনদের আহাজারিতে গোটা এলাকার পরিবেশ ভারী।

বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলায় নদীতে গোসল করতে নেমে নিখোঁজ স্কুলছাত্রের মরদেহ পাওয়া গেছে। আজ শুক্রবার সকাল ৬টার দিকে হরিণঘাটা পর্যটনকেন্দ্রসংলগ্ন লালদিয়ার চর এলাকায় জেলেদের জালে মরদেহটি উঠে আসে। সূর্য ঘোষ (১৩) নামের ওই স্কুলছাত্র গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা দেড়টার দিকে নিখোঁজ হয়। মরদেহটি উদ্ধার করেছে পাথরঘাটা থানার পুলিশ।

পাথরঘাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল বাশার বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, হরিণঘাটা এলাকার মাছ ধরা নৌকার জেলেরা মাছ শিকারে গিয়ে ভাসমান মরদেহ দেখতে পান। পরে মাছ শিকার বন্ধ রেখে তাঁরা মরদেহটি উদ্ধার করে তীরে নিয়ে আসেন। 

সূর্য ঘোষ বরগুনা পৌর এলাকার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের পীযূষ ঘোষের ছেলে। সে সৃষ্টি বিজ্ঞান স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ছিল। গতকাল বৃহস্পতিবার স্কুল থেকে অন্য সহপাঠীদের সঙ্গে হরিণঘাটা পর্যটনকেন্দ্রে বনভোজনে এসেছিল সে।

সূর্য ঘোষের বড় ভাই সাগর ঘোষ বলেন, ‘সকাল সাড়ে ৬টার দিকে সৃষ্টি বিজ্ঞান স্কুল ও কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা হরিণঘাটা এলাকায় শিক্ষা সফরে যায়। আমরা সূর্যকে পাঠাতে চাইনি, কারণ ও সাঁতার জানে না। ওই স্কুলের একজন পরিচালক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস দায়িত্ব নিয়ে সূর্যকে সঙ্গে নিয়ে যান। এরপর আমার মা একাধিকবার ফোন করে সূর্যের খোঁজ-খবর নেন। দুপুর সাড়ে ১২টার পর আর সূর্যকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না। এরপর একাধিক শিক্ষককে একাধিকবার কল করলেও তারা ফোন ধরেননি। বিকেল ৩টার দিকে স্কুলের একজন শিক্ষক ফোন রিসিভ করে জানান, সূর্যকে পাওয়া যাচ্ছে না। পরে বিকেল ৫টার দিকে শিক্ষকেরা জানান, সূর্যকে পাওয়া গেছে এবং বরগুনায় নিয়ে আসা হচ্ছে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে সবাই ট্রলারে ফিরে আসে।’

সাগর ঘোষ আরও জানান, ‘আমরা ট্রলারঘাঁটে গিয়ে সূর্যের খোঁজ করি, কিন্তু সে আসেনি। এ সময় শিক্ষকেরা কেউ আমাদের সঙ্গে কথা না বলে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে দ্রুত ট্রলারঘাট ত্যাগ করেন। পরে আমার বাবা ও কাকাকে ঘটনাস্থলে পাঠিয়ে জানতে পারি সূর্যকে পাওয়া যায়নি।’ 
 

সাগর অভিযোগ করে বলেন, ‘স্কুল কর্তৃপক্ষের বাধ্যবাধকতায় পিকনিকে পাঠাতে হয়েছে। তারা এভাবে প্রেশার করেছে, ‘হয় টাকা দাও, নয় পিকনিকে পাঠাও।’ আমরা বারবার সতর্ক করেছি, সূর্য সাঁতার জানে না। কিন্তু যে ভয় করেছিলাম, সেটিই ঘটেছে।’

সূর্যের মা উমা ঘোষ বলেন, ‘আমার পোলায় হাতর জানে না, হেইয়ার লইগ্যা আমি ওরে পিকনিকে পাঠাইতে চাই নাই। ওরা (শিক্ষকেরা) আমারে কইছে কিচ্ছু হবে না, আমরা তো আছি। আমার যে ডরডা লাগছিল, হেইয়াই সত্য অইছে, আমার পোলাডারে পিকনিকে নিয়া ওরা আর কোলে ফিরাইয়া দেয় নাই।’ 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিকনিকে যাওয়া ওই স্কুলের দুই শিক্ষার্থী জানায়, ‘দুপুর ১২টার দিকে শিক্ষার্থীরা সাঁতার কাটতে ও ফুটবল খেলতে নদীর চরে যায়। সূর্য সাঁতার না জানায় হাঁটুপানিতে নেমে খেলছিল। এ সময় অন্যরা ফুটবল খেলতে গেলেও সূর্য নদীতেই খেলছিল। দুপুর ২টার দিকে মধ্যাহ্নভোজের সময় সূর্যকে দেখতে না পেয়ে সবাই খোঁজাখুঁজি শুরু করে। সন্ধ্যা অবধি না পাওয়ায় অধ্যক্ষসহ কয়েকজন শিক্ষক সেখান থেকে বাকি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বরগুনায় পাঠিয়ে দেন।’ 

সৃষ্টি বিজ্ঞান স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস জানান, বরগুনা থেকে লঞ্চে করে তাঁর কলেজের শিক্ষার্থীরা পাথরঘাটার হরিণঘাটা পর্যটনকেন্দ্রে আসে। কেন্দ্রের লালদিয়ার চর এলাকায় রান্নাবান্নার কাজ চলে। শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে কেন্দ্রের বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরি করে। অন্যদিকে সূর্য ঘোষসহ কয়েক ছাত্র ফুটবল খেলে। খেলার পর তারা নদীতে গোসল করতে নামে। তীরে উঠে আসার পর সূর্য ঘোষ নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারে তারা। গোসল করতে গিয়ে কখন সে স্রোতের মধ্যে হারিয়েছে, তা সবার অজানা।

বরগুনার পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর মল্লিক বলেন, ‘পরিবারে পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হলে আমরা তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’ 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত