জাহীদ রেজা নূর

বায়ান্ন সাল থেকে আমার নিজেরই আরও কিছু জিনিসপত্তর ছিল: এর একটি হলো রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের একটা সাদা-কালো ছবি। ছবিটা আমাকে উপহার দিয়েছিল লা হাভরে পরিবারের মেয়েটি। ওরা রানির সিংহাসনে আরোহণের সময় ক্লাসসুদ্ধ সবাই লন্ডনে গিয়েছিল। যখন ছবিটা পেয়েছিলাম, তখন থেকেই ছবির উল্টোপিঠে একটা খয়েরি রঙের দাগ আমি খেয়াল করেছিলাম। সে দাগটা আমার মেজাজ খারাপ করে দিত। যখনই ছবিটা আমার চোখে পড়ত, তখনই মনে ভেসে উঠত ওই খয়েরি রঙের দাগটা।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ছবিটা তোলা হয়েছিল সামনাসামনি, প্রোফাইল। তার চোখের দৃষ্টি মনে হচ্ছিল অনেক গভীর থেকে উঠে আসছে, ছোট চুলগুলো ছিল পেছন দিকে শক্ত করে বাঁধা, মোটা ঠোঁটটা আরও মোটা লাগছিল গাঢ় লিপস্টিকের কারণে। বাঁ হাতটা ছিল পশমের ওপর, ডান হাতে ছিল পাখা। এখন মনে পড়ছে না, রানিকে তখন সুশ্রী নাকি কুশ্রী লাগছিল। সম্ভবত আমি সে রকম করে ভেবেও দেখিনি। রানি সুশ্রী না কুশ্রী, সেটা কি কোনো প্রশ্ন হতে পারে, রানি তো রানিই; আমার আরও ছিল লাল রঙের একটা চামড়ার ব্যাগ। এর মধ্যে ছিল কাঁচি, একটা হুক, ছিদ্র সেলাই করার জন্য মুচিদের ব্যবহার্য একটা সুঁই ইত্যাদি। সেটা হারিয়ে গেছে। ক্রিসমাস ডেতে আমাকে উপহার দেওয়া হয়েছিল ব্যাগটা, সেটা আরাম করে ব্যবহার করা যেত। এটির মধ্যে আমি আমার লেখালেখির কাগজপত্র রাখতাম, লিমোজেস ক্যাথিড্রালের ছবিওয়ালা পোস্টকার্ড ছিল তাতে। আমি আর বাবা যখন লুর্দসে গিয়েছিলাম, তখন সেখান থেকে মাকে পাঠিয়েছিলাম এই পোস্টকার্ডটি। পোস্টকার্ডের উল্টো পিঠে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল, ‘লিমোজেস হোটেলটা অনেক বড়, অনেক বিদেশি পর্যটক আছে এখানে। তোমার জন্য চুমু।’ নিচে আমার নাম লেখা আর ‘বাবা’। ঠিকানা লিখে দিয়েছিল বাবা। পোস্টাপিসের সিল ছিল ২২-০৮-৫২; আরও ছিল লুর্দেস ক্যাসেলের এক সেট আর পাইরেনিয়ান জাদুঘরের এক সেট পোস্টকার্ড। বোঝাই যাচ্ছে, এগুলো আমি কিনেছিলাম ওখানে যাওয়ার পর। ‘কিউবা ভ্রমণ’ গানের কথা ও নোটেশন কিনেছিলাম। সেটা লেখা ছিল আকাশি রঙে দুই পৃষ্ঠাজুড়ে। প্রথম পাতায় চলমান নৌকার ছবি ছিল, আর তাতে লেখা ছিল কণ্ঠশিল্পীদের নাম। যারা গানটি করেছিলেন, তারা হলেন: পাত্রিস আর মারিও, ইতেন ভগ্নীদ্বয়, মার্সেল আজ্জোলা, ঝান সাবলোন প্রমুখ।
মনে হয় গানটি আমার খুব প্রিয় ছিল, কারণ এই গানের লিরিক কেনার জন্য আমি মায়ের কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিয়েছিলাম। মা অবশ্য বলেছিলেন, তুচ্ছ এ জিনিস পড়াশোনার কোনো কাজে আসবে না। তবে সেই গ্রীষ্মে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল ‘আমার ছোট্ট পাগল করা ভালোবাসা’ আর ‘মেক্সিকো’ গান দুটি। গান দুটি লুর্দেসে যাওয়ার পথে একজন গাড়িচালকের মুখে শুনেছিলাম। আমার হাতের নিচে চাপা পড়ে ছিল প্রার্থনাবিষয়ক বইটি। ‘রোমান মিসাল উইথ টেক্সট অব দ্য সার্ভিসেস’ নাম বইটির। ব্রুজেস থেকে ছাপা হওয়া। প্রতিটি পৃষ্ঠায় দুটো কলাম। এক কলামে লেখা ফরাসি ভাষায়, অন্য কলামে লাতিন। তবে বইয়ের মাঝামাঝি এসে ‘প্রতিদিনের প্রার্থনা’ পাতায় এসে দেখা যাচ্ছে পুরো ডান দিকের পাতায় ফরাসি, বাঁ দিকের পাতায় লাতিন। প্রার্থনার বইটির শুরুতেই ছিল ১৯৫২ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত কোন কোন উৎসব হবে এবং কোন কোন উৎসব হবে না, এর দীর্ঘ একটি ক্যালেন্ডার।
বইটিতে তারিখগুলো আজব, দেখে মনে হয় বইটি বুঝি কয়েক শতাব্দী আগে লেখা। রহস্যময় কত শব্দ তাতে! স্যাক্রামেন্ট, গ্রাজুয়াল, অ্যান্টিফোন (আমার মনে নেই, সে সময় আমি এই শব্দগুলোর অর্থ জানার চেষ্টা করেছিলাম কি না)। বইটি আমাকে শান্তি দিত না, বরং ভয় ধরাত। মনে হতো আমার সামনে অবোধ্য, রহস্যময় এক ভাষা!
শব্দগুলো মোটামুটি পরিচিত, আমি বিনা বাধায় পড়ে ফেলতে পারি ‘অ্যাগনাস ডে’ (ঈশ্বরের মেষশাবক) কিংবা ছোটখাটো কোনো প্রার্থনা, কিন্তু বাল্যকালে আমি নিজের ইচ্ছায় রোববার বা অন্য কোনো ধর্মীয় উৎসবে প্রার্থনা না করলে মনে করতাম না যে আমার পাপ হবে।
ছবিগুলো প্রমাণ করে, ১৯৫২ সালে আমি শারীরিকভাবে এখানে ছিলাম আর প্রার্থনার বইটি প্রমাণ করে, ছোটবেলায় (না হলে কেন আমি এতবার স্থান পরিবর্তনের পরও বইটি সংরক্ষণ করেছি) ধর্মীয় বইয়ের প্রতি আমার একটা আকর্ষণ ছিল, যা আজ অতীত হয়ে গেছে। কিন্তু ওই গানটা! ভ্রমণ আর ভালোবাসা দিয়ে মোড়া ‘কিউবায় ভ্রমণ’ গানটি এখনো মনে হয় আমার খুব কাছের একটা ব্যাপার। খুবই আনন্দের সঙ্গে আমি গানের পঙ্ক্তিগুলো আওড়াই:
দুই কিশোর আর দুই কিশোরী
ঢেউ তুমি খেলতে থাক, উল্লাসে মাতো
ছোট্ট এক তরিই সম্বল
তাতে করেই কিউবার পথে…
সেই রবিবারের কথাটাই ভাবছিলাম শেষ কয়েক দিন ধরে। ঘটনাগুলো লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে কতটা রঙিন হয়ে, কণ্ঠস্বর হয়ে, অঙ্গভঙ্গি হয়ে তা আমার কাছে দৃশ্যমান হয়েছে। এখন অবশ্য আবার তা স্তিমিত হয়ে গেছে আর কণ্ঠটাও মিইয়ে গেছে সেই চলচ্চিত্রের মতো, যেটা এনক্রিপ্টেড চ্যানেলে ডেকোডার না বসিয়েই যেমন দেখা হয়। আমি সেই সত্যকে ভাষায় প্রকাশ করতে পারি কি না পারি, তাতে কিছুই পরিবর্তিত হচ্ছে না। সেটা সব সময়ই পাগলামি আর মৃত্যুর সঙ্গে জড়াজড়ি করে থাকছে। আর এই দৃশ্যের সঙ্গেই আমি আমার জীবনের সবচেয়ে যন্ত্রণাময় ঘটনাগুলো মিলিয়ে নিচ্ছিলাম, যেগুলো একটার চেয়ে আরেকটা আরও বেশি বেদনাদায়ক ছিল।
যেহেতু আমাকে আবার আমার লেখালেখির মধ্যে ফিরে আসতে হবে এবং আমি এ ছাড়া আর কিছুই করতে পারি না এবং সবাই যখন বলছে যে, আমি আবার নতুন বই লেখা শুরু করছি, তখন আমাকে আবার সবকিছু নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, নিরেট কিছু বাস্তব ঘটনাই শুধু আমার মনে আছে। এই দৃশ্যটা আমার মধ্যে ছিল একেবারে স্থিরচিত্রের মতো, আর আমি সে দৃশ্যটাকে গতিশীল করতে চাইছি, যেন তা আইকনিক পবিত্রতা অর্জন করে উঠতে না পারে (এবং আমি নিশ্চিত, এই দৃশ্যটাই আমাকে লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে এবং কোনো না কোনোভাবে তা আমার বইগুলোতে সুপ্তভাবে বিরাজ করছে)।
বহুদিন হয়ে গেছে আমি মনোবিশ্লেষণ কিংবা পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানীর দেওয়া পরিকল্পনামাফিক চলি না: বশ্যতা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় আমার মা ও বাবা কত কীই না করেছেন। ‘পারিবারিক আঘাত’, ‘শৈশবের দয়ালু মনটা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে’ এই ধরনের কথা আমার জন্য জুতসই নয়। যে অনুভূতিটা সব সময় আমাকে ঘিরে রেখেছে, সে অনুভূতিকেই সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেছি, এবং সেটা আমি পেয়েছি সেই দিনটি থেকেই, ‘জীবনের জন্য পাগল হও।’—এ ছাড়া আর কোনো বাক্যই আমার জন্য প্রযোজ্য নয়।
* * *
কাল আমি রুয়েনস আর্কাইভে গিয়েছিলাম ‘প্যারিস-নরমান্দি’ পত্রিকায় ১৯৫২ সালে কী লেখা হয়েছে, তা দেখার জন্য। এই পত্রিকাটি একজন হকার সব সময় আমার মা-বাবার কাছে দিয়ে যেত। এর আগপর্যন্ত আমি সাহসে ভর করে ১৯৫২ সালের জুন মাসের পত্রিকা দেখার কথা ভাবতে পারিনি। সিঁড়ি বেয়ে আর্কাইভে উঠছিলাম যখন, তখন বীভৎস কিছু একটা দেখব মনে করে আমার শরীর বেয়ে শীতল আতঙ্ক নেমে আসছিল। আর্কাইভটা ছিল মেয়রের অফিসে, সেখানকার একজন কর্মচারী আমার জন্য নিয়ে এলেন ১৯৫২ সালের দুটো বড় ফাইল। আমি পহেলা জানুয়ারি থেকে দেখতে শুরু করলাম। আমি জুন মাস পর্যন্ত পৌঁছানোর আগে কিছু সময় নিচ্ছিলাম। আগের তারিখগুলোর সুখকর সংবাদগুলোতে নিবিষ্ট হচ্ছিলাম।
প্রথম পাতার একেবারে ডান দিকের ওপরের অংশে অ্যাবট গ্যাব্রিয়েলের করা আবহাওয়ার প্রতিবেদনগুলো থাকত। আমার এখন একেবারেই মনে পড়ে না, কেমন ছিল সে দিনগুলোর আবহাওয়া। আমি তখন কী খেলতাম? আমি কি ঘুরতে বের হতাম? সূর্যের আলোময় দিন কিংবা মেঘে ঢাকা আকাশ ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে ওঠা, দমকা হাওয়া ইত্যাদি এখন আমাকে আর কোনো কথা মনে করিয়ে দেয় না। যে ঘটনাগুলোর কথা আমার মনে আছে, তা হলো ইন্দোচীনে আর কোরিয়ায় যুদ্ধ, অরলিয়ানে বিক্ষোভ, পিনের পরিকল্পনা, কিন্তু আমি এ ঘটনাগুলোকে ৫২ সালের সঙ্গেই যুক্ত করেছিলাম বলে মনে পড়ে না। তখন নয়, পরে এগুলো আমার কাছে কোনো না কোনো অর্থ পেয়েছিল। ‘সাইগনে ৬টি বাইসাইকেল বিস্ফোরণ হয়েছে’, কিংবা ‘ফ্রেনে দ্যুকলো’র (ফ্রান্সের কমিউনিস্ট নেতা—অনুবাদক) সঙ্গে ১৯৫২ সালের সেই কিশোরীকে কোনোভাবেই মেলাতে পারি না। অবাক কাণ্ড হচ্ছে, স্তালিন, চার্চিল, আইজেনহাওয়ারকে আমার ঠিক তেমনই লাগত, যেমন এখন লাগে ইয়েলৎসিন, ক্লিনটন বা কোহলকে। আমি কিছুই জানতে পারি না, যেন আমি সে সময়টা এই পৃথিবীতে কাটাইনি।
পিনের ছবি দেখে আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম তার সঙ্গে ঝিসকার দ্য’এস্তেনের চেহারার মিল দেখে। আমি এখনকার টেকোমাথা ঝিসকারের কথা বলছি না, বলছি আজ থেকে কুড়ি বছর আগে সে যেমন ছিল, তার কথা। ‘আয়রন কার্টেন’ বা লৌহপর্দা বিষয়টি মনে এলেই আমার মনে পড়ে প্রাইভেট স্কুলে পড়ার সময় নারী শিক্ষক আমাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘খ্রিষ্টধর্মে দশ পুঁতির জপমালা দিয়ে কী বোঝায়’, আর আমার তখন মনে হতো একটি লোহার খাঁচায় অনেকগুলো পুরুষ এবং নারী বন্দী হয়ে খাঁচাটিকে প্রবলভাবে নাড়াচ্ছেন। তবে বলতেই পারি, আমি অবলীলায় মনে করতে পারলাম, কৌতুক স্ট্রিপ ‘পুস্তিক’-এর কথা। এই স্ট্রিপ বহু বহুদিন ধরে ‘ফ্রান্স-সুয়ার’ পত্রিকার শেষের পাতায় প্রকাশ হয়েছে। সে সময় কৌতুক পড়ে আমি মজা পেতাম কি পেতাম না, তা মনে করতে পারি না। যেমন একটা কৌতুক ছিল:
‘কী হে মৎস্যশিকারি, কামড়াচ্ছে?’
‘না না, এরা খুব ছোট। কামড়ালেও ব্যথা লাগছে না।’
আমি সিনেমার বিজ্ঞাপন এবং যে সিনেমাগুলো আসত প্রথমে রুয়ান শহরে, পরে আমাদের শহরে, সেগুলো সম্পর্কে জানতাম। ‘মিশর থেকে আসা প্রেমিকেরা’ ‘দারুণ বউ আমার’ ইত্যাদি সিনেমার কথা মনে আছে।
প্রতিদিনই কোনো না কোনো অঘটন ঘটত: দুই বছর বয়সী এক শিশু ক্রসাঁ খেয়ে আকস্মিকভাবে মারা গেছে, খেত পরিষ্কার করতে গিয়ে গমের খেতে খেলতে খেলতে লুকিয়ে পড়া ছেলের পা কেটে ফেলেছে এক কৃষক, ক্রেইলে মাইন বিস্ফোরণে তিন শিশু নিহত। এ ধরনের ঘটনায় আমার মনে আগ্রহ জাগত।
খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায়—মাখন আর দুধের দাম। সে সময় গ্রামকে বেশ দাম দেওয়া হতো। পা ও মুখের রোগ সম্পর্কে খবর বের হতো, থাকত কৃষকদের বউদের নিয়ে প্রতিবেদন, পশু চিকিৎসা নিয়ে লেখালেখি, লাপিক্রিন কিংবা ওসপোরৎসিন নিয়ে প্রতিবেদন থেকে তা ঢের বোঝা যেত।
কাশির লজেন্স আর সিরাপের এত বেশি বিজ্ঞাপন বের হতো যে মনে হতো, সব মানুষই কাশিতে ভুগছে এবং তারা চিকিৎসকের শরণাপন্ন না হয়ে এসব লজেন্স আর সিরাপ খেয়েই সেরে উঠছে।
শনিবারের পত্রিকায় ছিল ফিচার, ‘নারী, আপনার জন্য’। আমি সে পাতায় যে জ্যাকেট দেখেছি, এর সঙ্গে আমার বিয়ারিৎসে নিয়ে যাওয়া জ্যাকেটের মিল খুঁজে পাই। কিন্তু আমি নিশ্চিত, আমি বা মা কেউই এইটুকু ছাড়া আর কোনোভাবেই সে সময়ের ফ্যাশন অনুযায়ী সাজগোজ করিনি। আর চুলের যে কার্লগুলো দেখেছি, এর সঙ্গে আমার টুপিওয়ালা চুলের স্টাইলের কোনো মিল ছিল না।
আমি পত্রিকার ১৪-১৫ তারিখের শনি-রবিবারের পাতায় চোখ রাখলাম। প্রথম পাতায় বড় বড় করে লেখা ছিল:
শস্যের ফলন প্রত্যাশার চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি হয়েছে
২৪ ঘণ্টার গাড়ির প্রতিযোগিতায় প্যারিসে কোনো ফেবারিট নেই
মি. ঝ্যাক দ্যুকলো দীর্ঘ জেরার পরও অপরাধ স্বীকার করেননি
১০ দিন খোঁজাখুঁজির পর জোয়েল নামের শিশুটির মরদেহ তার বাড়ির পাশ থেকেই উদ্ধার:
স্বীকারোক্তি—প্রতিবেশিনী তাকে নর্দমায় ফেলে দেয়
এসব দেখে আর পত্রিকার পাতা ওল্টাতে ইচ্ছে হলো না। আর্কাইভ থেকে বের হয়ে, সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে আমি হঠাৎ বুঝতে পারলাম, আর একটু হলেই ১৯৫২ সালের সেই দিনটির, সেই খবরটির দেখা বুঝি পেয়ে যেতাম! পরে আমি বিস্মিত হয়ে ভেবেছি, ঘটনাটা তো সেই দিনটিতে ঘটেছিল, যে দিনে লে-মানে’তে সারা দিন ক্রমাগত গাড়ির গর্জন শোনা গিয়েছিল। দুটো ঘটনার এত সাদৃশ্য আমার কাছে অবিশ্বাস্য লাগছিল। সেই রোববার পৃথিবীতে যত ঘটনাই ঘটে থাকুক না কেন, আমি ওই একটি ঘটনার সঙ্গে আর কোনো ঘটনাকে মেলাতে পারি না। শুধু সেটা আমার জন্য ছিল এক বাস্তব অভিজ্ঞতা।
(চলবে)
আরও পড়ুন:

বায়ান্ন সাল থেকে আমার নিজেরই আরও কিছু জিনিসপত্তর ছিল: এর একটি হলো রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের একটা সাদা-কালো ছবি। ছবিটা আমাকে উপহার দিয়েছিল লা হাভরে পরিবারের মেয়েটি। ওরা রানির সিংহাসনে আরোহণের সময় ক্লাসসুদ্ধ সবাই লন্ডনে গিয়েছিল। যখন ছবিটা পেয়েছিলাম, তখন থেকেই ছবির উল্টোপিঠে একটা খয়েরি রঙের দাগ আমি খেয়াল করেছিলাম। সে দাগটা আমার মেজাজ খারাপ করে দিত। যখনই ছবিটা আমার চোখে পড়ত, তখনই মনে ভেসে উঠত ওই খয়েরি রঙের দাগটা।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ছবিটা তোলা হয়েছিল সামনাসামনি, প্রোফাইল। তার চোখের দৃষ্টি মনে হচ্ছিল অনেক গভীর থেকে উঠে আসছে, ছোট চুলগুলো ছিল পেছন দিকে শক্ত করে বাঁধা, মোটা ঠোঁটটা আরও মোটা লাগছিল গাঢ় লিপস্টিকের কারণে। বাঁ হাতটা ছিল পশমের ওপর, ডান হাতে ছিল পাখা। এখন মনে পড়ছে না, রানিকে তখন সুশ্রী নাকি কুশ্রী লাগছিল। সম্ভবত আমি সে রকম করে ভেবেও দেখিনি। রানি সুশ্রী না কুশ্রী, সেটা কি কোনো প্রশ্ন হতে পারে, রানি তো রানিই; আমার আরও ছিল লাল রঙের একটা চামড়ার ব্যাগ। এর মধ্যে ছিল কাঁচি, একটা হুক, ছিদ্র সেলাই করার জন্য মুচিদের ব্যবহার্য একটা সুঁই ইত্যাদি। সেটা হারিয়ে গেছে। ক্রিসমাস ডেতে আমাকে উপহার দেওয়া হয়েছিল ব্যাগটা, সেটা আরাম করে ব্যবহার করা যেত। এটির মধ্যে আমি আমার লেখালেখির কাগজপত্র রাখতাম, লিমোজেস ক্যাথিড্রালের ছবিওয়ালা পোস্টকার্ড ছিল তাতে। আমি আর বাবা যখন লুর্দসে গিয়েছিলাম, তখন সেখান থেকে মাকে পাঠিয়েছিলাম এই পোস্টকার্ডটি। পোস্টকার্ডের উল্টো পিঠে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল, ‘লিমোজেস হোটেলটা অনেক বড়, অনেক বিদেশি পর্যটক আছে এখানে। তোমার জন্য চুমু।’ নিচে আমার নাম লেখা আর ‘বাবা’। ঠিকানা লিখে দিয়েছিল বাবা। পোস্টাপিসের সিল ছিল ২২-০৮-৫২; আরও ছিল লুর্দেস ক্যাসেলের এক সেট আর পাইরেনিয়ান জাদুঘরের এক সেট পোস্টকার্ড। বোঝাই যাচ্ছে, এগুলো আমি কিনেছিলাম ওখানে যাওয়ার পর। ‘কিউবা ভ্রমণ’ গানের কথা ও নোটেশন কিনেছিলাম। সেটা লেখা ছিল আকাশি রঙে দুই পৃষ্ঠাজুড়ে। প্রথম পাতায় চলমান নৌকার ছবি ছিল, আর তাতে লেখা ছিল কণ্ঠশিল্পীদের নাম। যারা গানটি করেছিলেন, তারা হলেন: পাত্রিস আর মারিও, ইতেন ভগ্নীদ্বয়, মার্সেল আজ্জোলা, ঝান সাবলোন প্রমুখ।
মনে হয় গানটি আমার খুব প্রিয় ছিল, কারণ এই গানের লিরিক কেনার জন্য আমি মায়ের কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিয়েছিলাম। মা অবশ্য বলেছিলেন, তুচ্ছ এ জিনিস পড়াশোনার কোনো কাজে আসবে না। তবে সেই গ্রীষ্মে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল ‘আমার ছোট্ট পাগল করা ভালোবাসা’ আর ‘মেক্সিকো’ গান দুটি। গান দুটি লুর্দেসে যাওয়ার পথে একজন গাড়িচালকের মুখে শুনেছিলাম। আমার হাতের নিচে চাপা পড়ে ছিল প্রার্থনাবিষয়ক বইটি। ‘রোমান মিসাল উইথ টেক্সট অব দ্য সার্ভিসেস’ নাম বইটির। ব্রুজেস থেকে ছাপা হওয়া। প্রতিটি পৃষ্ঠায় দুটো কলাম। এক কলামে লেখা ফরাসি ভাষায়, অন্য কলামে লাতিন। তবে বইয়ের মাঝামাঝি এসে ‘প্রতিদিনের প্রার্থনা’ পাতায় এসে দেখা যাচ্ছে পুরো ডান দিকের পাতায় ফরাসি, বাঁ দিকের পাতায় লাতিন। প্রার্থনার বইটির শুরুতেই ছিল ১৯৫২ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত কোন কোন উৎসব হবে এবং কোন কোন উৎসব হবে না, এর দীর্ঘ একটি ক্যালেন্ডার।
বইটিতে তারিখগুলো আজব, দেখে মনে হয় বইটি বুঝি কয়েক শতাব্দী আগে লেখা। রহস্যময় কত শব্দ তাতে! স্যাক্রামেন্ট, গ্রাজুয়াল, অ্যান্টিফোন (আমার মনে নেই, সে সময় আমি এই শব্দগুলোর অর্থ জানার চেষ্টা করেছিলাম কি না)। বইটি আমাকে শান্তি দিত না, বরং ভয় ধরাত। মনে হতো আমার সামনে অবোধ্য, রহস্যময় এক ভাষা!
শব্দগুলো মোটামুটি পরিচিত, আমি বিনা বাধায় পড়ে ফেলতে পারি ‘অ্যাগনাস ডে’ (ঈশ্বরের মেষশাবক) কিংবা ছোটখাটো কোনো প্রার্থনা, কিন্তু বাল্যকালে আমি নিজের ইচ্ছায় রোববার বা অন্য কোনো ধর্মীয় উৎসবে প্রার্থনা না করলে মনে করতাম না যে আমার পাপ হবে।
ছবিগুলো প্রমাণ করে, ১৯৫২ সালে আমি শারীরিকভাবে এখানে ছিলাম আর প্রার্থনার বইটি প্রমাণ করে, ছোটবেলায় (না হলে কেন আমি এতবার স্থান পরিবর্তনের পরও বইটি সংরক্ষণ করেছি) ধর্মীয় বইয়ের প্রতি আমার একটা আকর্ষণ ছিল, যা আজ অতীত হয়ে গেছে। কিন্তু ওই গানটা! ভ্রমণ আর ভালোবাসা দিয়ে মোড়া ‘কিউবায় ভ্রমণ’ গানটি এখনো মনে হয় আমার খুব কাছের একটা ব্যাপার। খুবই আনন্দের সঙ্গে আমি গানের পঙ্ক্তিগুলো আওড়াই:
দুই কিশোর আর দুই কিশোরী
ঢেউ তুমি খেলতে থাক, উল্লাসে মাতো
ছোট্ট এক তরিই সম্বল
তাতে করেই কিউবার পথে…
সেই রবিবারের কথাটাই ভাবছিলাম শেষ কয়েক দিন ধরে। ঘটনাগুলো লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে কতটা রঙিন হয়ে, কণ্ঠস্বর হয়ে, অঙ্গভঙ্গি হয়ে তা আমার কাছে দৃশ্যমান হয়েছে। এখন অবশ্য আবার তা স্তিমিত হয়ে গেছে আর কণ্ঠটাও মিইয়ে গেছে সেই চলচ্চিত্রের মতো, যেটা এনক্রিপ্টেড চ্যানেলে ডেকোডার না বসিয়েই যেমন দেখা হয়। আমি সেই সত্যকে ভাষায় প্রকাশ করতে পারি কি না পারি, তাতে কিছুই পরিবর্তিত হচ্ছে না। সেটা সব সময়ই পাগলামি আর মৃত্যুর সঙ্গে জড়াজড়ি করে থাকছে। আর এই দৃশ্যের সঙ্গেই আমি আমার জীবনের সবচেয়ে যন্ত্রণাময় ঘটনাগুলো মিলিয়ে নিচ্ছিলাম, যেগুলো একটার চেয়ে আরেকটা আরও বেশি বেদনাদায়ক ছিল।
যেহেতু আমাকে আবার আমার লেখালেখির মধ্যে ফিরে আসতে হবে এবং আমি এ ছাড়া আর কিছুই করতে পারি না এবং সবাই যখন বলছে যে, আমি আবার নতুন বই লেখা শুরু করছি, তখন আমাকে আবার সবকিছু নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, নিরেট কিছু বাস্তব ঘটনাই শুধু আমার মনে আছে। এই দৃশ্যটা আমার মধ্যে ছিল একেবারে স্থিরচিত্রের মতো, আর আমি সে দৃশ্যটাকে গতিশীল করতে চাইছি, যেন তা আইকনিক পবিত্রতা অর্জন করে উঠতে না পারে (এবং আমি নিশ্চিত, এই দৃশ্যটাই আমাকে লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে এবং কোনো না কোনোভাবে তা আমার বইগুলোতে সুপ্তভাবে বিরাজ করছে)।
বহুদিন হয়ে গেছে আমি মনোবিশ্লেষণ কিংবা পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানীর দেওয়া পরিকল্পনামাফিক চলি না: বশ্যতা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় আমার মা ও বাবা কত কীই না করেছেন। ‘পারিবারিক আঘাত’, ‘শৈশবের দয়ালু মনটা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে’ এই ধরনের কথা আমার জন্য জুতসই নয়। যে অনুভূতিটা সব সময় আমাকে ঘিরে রেখেছে, সে অনুভূতিকেই সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেছি, এবং সেটা আমি পেয়েছি সেই দিনটি থেকেই, ‘জীবনের জন্য পাগল হও।’—এ ছাড়া আর কোনো বাক্যই আমার জন্য প্রযোজ্য নয়।
* * *
কাল আমি রুয়েনস আর্কাইভে গিয়েছিলাম ‘প্যারিস-নরমান্দি’ পত্রিকায় ১৯৫২ সালে কী লেখা হয়েছে, তা দেখার জন্য। এই পত্রিকাটি একজন হকার সব সময় আমার মা-বাবার কাছে দিয়ে যেত। এর আগপর্যন্ত আমি সাহসে ভর করে ১৯৫২ সালের জুন মাসের পত্রিকা দেখার কথা ভাবতে পারিনি। সিঁড়ি বেয়ে আর্কাইভে উঠছিলাম যখন, তখন বীভৎস কিছু একটা দেখব মনে করে আমার শরীর বেয়ে শীতল আতঙ্ক নেমে আসছিল। আর্কাইভটা ছিল মেয়রের অফিসে, সেখানকার একজন কর্মচারী আমার জন্য নিয়ে এলেন ১৯৫২ সালের দুটো বড় ফাইল। আমি পহেলা জানুয়ারি থেকে দেখতে শুরু করলাম। আমি জুন মাস পর্যন্ত পৌঁছানোর আগে কিছু সময় নিচ্ছিলাম। আগের তারিখগুলোর সুখকর সংবাদগুলোতে নিবিষ্ট হচ্ছিলাম।
প্রথম পাতার একেবারে ডান দিকের ওপরের অংশে অ্যাবট গ্যাব্রিয়েলের করা আবহাওয়ার প্রতিবেদনগুলো থাকত। আমার এখন একেবারেই মনে পড়ে না, কেমন ছিল সে দিনগুলোর আবহাওয়া। আমি তখন কী খেলতাম? আমি কি ঘুরতে বের হতাম? সূর্যের আলোময় দিন কিংবা মেঘে ঢাকা আকাশ ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে ওঠা, দমকা হাওয়া ইত্যাদি এখন আমাকে আর কোনো কথা মনে করিয়ে দেয় না। যে ঘটনাগুলোর কথা আমার মনে আছে, তা হলো ইন্দোচীনে আর কোরিয়ায় যুদ্ধ, অরলিয়ানে বিক্ষোভ, পিনের পরিকল্পনা, কিন্তু আমি এ ঘটনাগুলোকে ৫২ সালের সঙ্গেই যুক্ত করেছিলাম বলে মনে পড়ে না। তখন নয়, পরে এগুলো আমার কাছে কোনো না কোনো অর্থ পেয়েছিল। ‘সাইগনে ৬টি বাইসাইকেল বিস্ফোরণ হয়েছে’, কিংবা ‘ফ্রেনে দ্যুকলো’র (ফ্রান্সের কমিউনিস্ট নেতা—অনুবাদক) সঙ্গে ১৯৫২ সালের সেই কিশোরীকে কোনোভাবেই মেলাতে পারি না। অবাক কাণ্ড হচ্ছে, স্তালিন, চার্চিল, আইজেনহাওয়ারকে আমার ঠিক তেমনই লাগত, যেমন এখন লাগে ইয়েলৎসিন, ক্লিনটন বা কোহলকে। আমি কিছুই জানতে পারি না, যেন আমি সে সময়টা এই পৃথিবীতে কাটাইনি।
পিনের ছবি দেখে আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম তার সঙ্গে ঝিসকার দ্য’এস্তেনের চেহারার মিল দেখে। আমি এখনকার টেকোমাথা ঝিসকারের কথা বলছি না, বলছি আজ থেকে কুড়ি বছর আগে সে যেমন ছিল, তার কথা। ‘আয়রন কার্টেন’ বা লৌহপর্দা বিষয়টি মনে এলেই আমার মনে পড়ে প্রাইভেট স্কুলে পড়ার সময় নারী শিক্ষক আমাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘খ্রিষ্টধর্মে দশ পুঁতির জপমালা দিয়ে কী বোঝায়’, আর আমার তখন মনে হতো একটি লোহার খাঁচায় অনেকগুলো পুরুষ এবং নারী বন্দী হয়ে খাঁচাটিকে প্রবলভাবে নাড়াচ্ছেন। তবে বলতেই পারি, আমি অবলীলায় মনে করতে পারলাম, কৌতুক স্ট্রিপ ‘পুস্তিক’-এর কথা। এই স্ট্রিপ বহু বহুদিন ধরে ‘ফ্রান্স-সুয়ার’ পত্রিকার শেষের পাতায় প্রকাশ হয়েছে। সে সময় কৌতুক পড়ে আমি মজা পেতাম কি পেতাম না, তা মনে করতে পারি না। যেমন একটা কৌতুক ছিল:
‘কী হে মৎস্যশিকারি, কামড়াচ্ছে?’
‘না না, এরা খুব ছোট। কামড়ালেও ব্যথা লাগছে না।’
আমি সিনেমার বিজ্ঞাপন এবং যে সিনেমাগুলো আসত প্রথমে রুয়ান শহরে, পরে আমাদের শহরে, সেগুলো সম্পর্কে জানতাম। ‘মিশর থেকে আসা প্রেমিকেরা’ ‘দারুণ বউ আমার’ ইত্যাদি সিনেমার কথা মনে আছে।
প্রতিদিনই কোনো না কোনো অঘটন ঘটত: দুই বছর বয়সী এক শিশু ক্রসাঁ খেয়ে আকস্মিকভাবে মারা গেছে, খেত পরিষ্কার করতে গিয়ে গমের খেতে খেলতে খেলতে লুকিয়ে পড়া ছেলের পা কেটে ফেলেছে এক কৃষক, ক্রেইলে মাইন বিস্ফোরণে তিন শিশু নিহত। এ ধরনের ঘটনায় আমার মনে আগ্রহ জাগত।
খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায়—মাখন আর দুধের দাম। সে সময় গ্রামকে বেশ দাম দেওয়া হতো। পা ও মুখের রোগ সম্পর্কে খবর বের হতো, থাকত কৃষকদের বউদের নিয়ে প্রতিবেদন, পশু চিকিৎসা নিয়ে লেখালেখি, লাপিক্রিন কিংবা ওসপোরৎসিন নিয়ে প্রতিবেদন থেকে তা ঢের বোঝা যেত।
কাশির লজেন্স আর সিরাপের এত বেশি বিজ্ঞাপন বের হতো যে মনে হতো, সব মানুষই কাশিতে ভুগছে এবং তারা চিকিৎসকের শরণাপন্ন না হয়ে এসব লজেন্স আর সিরাপ খেয়েই সেরে উঠছে।
শনিবারের পত্রিকায় ছিল ফিচার, ‘নারী, আপনার জন্য’। আমি সে পাতায় যে জ্যাকেট দেখেছি, এর সঙ্গে আমার বিয়ারিৎসে নিয়ে যাওয়া জ্যাকেটের মিল খুঁজে পাই। কিন্তু আমি নিশ্চিত, আমি বা মা কেউই এইটুকু ছাড়া আর কোনোভাবেই সে সময়ের ফ্যাশন অনুযায়ী সাজগোজ করিনি। আর চুলের যে কার্লগুলো দেখেছি, এর সঙ্গে আমার টুপিওয়ালা চুলের স্টাইলের কোনো মিল ছিল না।
আমি পত্রিকার ১৪-১৫ তারিখের শনি-রবিবারের পাতায় চোখ রাখলাম। প্রথম পাতায় বড় বড় করে লেখা ছিল:
শস্যের ফলন প্রত্যাশার চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি হয়েছে
২৪ ঘণ্টার গাড়ির প্রতিযোগিতায় প্যারিসে কোনো ফেবারিট নেই
মি. ঝ্যাক দ্যুকলো দীর্ঘ জেরার পরও অপরাধ স্বীকার করেননি
১০ দিন খোঁজাখুঁজির পর জোয়েল নামের শিশুটির মরদেহ তার বাড়ির পাশ থেকেই উদ্ধার:
স্বীকারোক্তি—প্রতিবেশিনী তাকে নর্দমায় ফেলে দেয়
এসব দেখে আর পত্রিকার পাতা ওল্টাতে ইচ্ছে হলো না। আর্কাইভ থেকে বের হয়ে, সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে আমি হঠাৎ বুঝতে পারলাম, আর একটু হলেই ১৯৫২ সালের সেই দিনটির, সেই খবরটির দেখা বুঝি পেয়ে যেতাম! পরে আমি বিস্মিত হয়ে ভেবেছি, ঘটনাটা তো সেই দিনটিতে ঘটেছিল, যে দিনে লে-মানে’তে সারা দিন ক্রমাগত গাড়ির গর্জন শোনা গিয়েছিল। দুটো ঘটনার এত সাদৃশ্য আমার কাছে অবিশ্বাস্য লাগছিল। সেই রোববার পৃথিবীতে যত ঘটনাই ঘটে থাকুক না কেন, আমি ওই একটি ঘটনার সঙ্গে আর কোনো ঘটনাকে মেলাতে পারি না। শুধু সেটা আমার জন্য ছিল এক বাস্তব অভিজ্ঞতা।
(চলবে)
আরও পড়ুন:
জাহীদ রেজা নূর

বায়ান্ন সাল থেকে আমার নিজেরই আরও কিছু জিনিসপত্তর ছিল: এর একটি হলো রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের একটা সাদা-কালো ছবি। ছবিটা আমাকে উপহার দিয়েছিল লা হাভরে পরিবারের মেয়েটি। ওরা রানির সিংহাসনে আরোহণের সময় ক্লাসসুদ্ধ সবাই লন্ডনে গিয়েছিল। যখন ছবিটা পেয়েছিলাম, তখন থেকেই ছবির উল্টোপিঠে একটা খয়েরি রঙের দাগ আমি খেয়াল করেছিলাম। সে দাগটা আমার মেজাজ খারাপ করে দিত। যখনই ছবিটা আমার চোখে পড়ত, তখনই মনে ভেসে উঠত ওই খয়েরি রঙের দাগটা।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ছবিটা তোলা হয়েছিল সামনাসামনি, প্রোফাইল। তার চোখের দৃষ্টি মনে হচ্ছিল অনেক গভীর থেকে উঠে আসছে, ছোট চুলগুলো ছিল পেছন দিকে শক্ত করে বাঁধা, মোটা ঠোঁটটা আরও মোটা লাগছিল গাঢ় লিপস্টিকের কারণে। বাঁ হাতটা ছিল পশমের ওপর, ডান হাতে ছিল পাখা। এখন মনে পড়ছে না, রানিকে তখন সুশ্রী নাকি কুশ্রী লাগছিল। সম্ভবত আমি সে রকম করে ভেবেও দেখিনি। রানি সুশ্রী না কুশ্রী, সেটা কি কোনো প্রশ্ন হতে পারে, রানি তো রানিই; আমার আরও ছিল লাল রঙের একটা চামড়ার ব্যাগ। এর মধ্যে ছিল কাঁচি, একটা হুক, ছিদ্র সেলাই করার জন্য মুচিদের ব্যবহার্য একটা সুঁই ইত্যাদি। সেটা হারিয়ে গেছে। ক্রিসমাস ডেতে আমাকে উপহার দেওয়া হয়েছিল ব্যাগটা, সেটা আরাম করে ব্যবহার করা যেত। এটির মধ্যে আমি আমার লেখালেখির কাগজপত্র রাখতাম, লিমোজেস ক্যাথিড্রালের ছবিওয়ালা পোস্টকার্ড ছিল তাতে। আমি আর বাবা যখন লুর্দসে গিয়েছিলাম, তখন সেখান থেকে মাকে পাঠিয়েছিলাম এই পোস্টকার্ডটি। পোস্টকার্ডের উল্টো পিঠে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল, ‘লিমোজেস হোটেলটা অনেক বড়, অনেক বিদেশি পর্যটক আছে এখানে। তোমার জন্য চুমু।’ নিচে আমার নাম লেখা আর ‘বাবা’। ঠিকানা লিখে দিয়েছিল বাবা। পোস্টাপিসের সিল ছিল ২২-০৮-৫২; আরও ছিল লুর্দেস ক্যাসেলের এক সেট আর পাইরেনিয়ান জাদুঘরের এক সেট পোস্টকার্ড। বোঝাই যাচ্ছে, এগুলো আমি কিনেছিলাম ওখানে যাওয়ার পর। ‘কিউবা ভ্রমণ’ গানের কথা ও নোটেশন কিনেছিলাম। সেটা লেখা ছিল আকাশি রঙে দুই পৃষ্ঠাজুড়ে। প্রথম পাতায় চলমান নৌকার ছবি ছিল, আর তাতে লেখা ছিল কণ্ঠশিল্পীদের নাম। যারা গানটি করেছিলেন, তারা হলেন: পাত্রিস আর মারিও, ইতেন ভগ্নীদ্বয়, মার্সেল আজ্জোলা, ঝান সাবলোন প্রমুখ।
মনে হয় গানটি আমার খুব প্রিয় ছিল, কারণ এই গানের লিরিক কেনার জন্য আমি মায়ের কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিয়েছিলাম। মা অবশ্য বলেছিলেন, তুচ্ছ এ জিনিস পড়াশোনার কোনো কাজে আসবে না। তবে সেই গ্রীষ্মে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল ‘আমার ছোট্ট পাগল করা ভালোবাসা’ আর ‘মেক্সিকো’ গান দুটি। গান দুটি লুর্দেসে যাওয়ার পথে একজন গাড়িচালকের মুখে শুনেছিলাম। আমার হাতের নিচে চাপা পড়ে ছিল প্রার্থনাবিষয়ক বইটি। ‘রোমান মিসাল উইথ টেক্সট অব দ্য সার্ভিসেস’ নাম বইটির। ব্রুজেস থেকে ছাপা হওয়া। প্রতিটি পৃষ্ঠায় দুটো কলাম। এক কলামে লেখা ফরাসি ভাষায়, অন্য কলামে লাতিন। তবে বইয়ের মাঝামাঝি এসে ‘প্রতিদিনের প্রার্থনা’ পাতায় এসে দেখা যাচ্ছে পুরো ডান দিকের পাতায় ফরাসি, বাঁ দিকের পাতায় লাতিন। প্রার্থনার বইটির শুরুতেই ছিল ১৯৫২ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত কোন কোন উৎসব হবে এবং কোন কোন উৎসব হবে না, এর দীর্ঘ একটি ক্যালেন্ডার।
বইটিতে তারিখগুলো আজব, দেখে মনে হয় বইটি বুঝি কয়েক শতাব্দী আগে লেখা। রহস্যময় কত শব্দ তাতে! স্যাক্রামেন্ট, গ্রাজুয়াল, অ্যান্টিফোন (আমার মনে নেই, সে সময় আমি এই শব্দগুলোর অর্থ জানার চেষ্টা করেছিলাম কি না)। বইটি আমাকে শান্তি দিত না, বরং ভয় ধরাত। মনে হতো আমার সামনে অবোধ্য, রহস্যময় এক ভাষা!
শব্দগুলো মোটামুটি পরিচিত, আমি বিনা বাধায় পড়ে ফেলতে পারি ‘অ্যাগনাস ডে’ (ঈশ্বরের মেষশাবক) কিংবা ছোটখাটো কোনো প্রার্থনা, কিন্তু বাল্যকালে আমি নিজের ইচ্ছায় রোববার বা অন্য কোনো ধর্মীয় উৎসবে প্রার্থনা না করলে মনে করতাম না যে আমার পাপ হবে।
ছবিগুলো প্রমাণ করে, ১৯৫২ সালে আমি শারীরিকভাবে এখানে ছিলাম আর প্রার্থনার বইটি প্রমাণ করে, ছোটবেলায় (না হলে কেন আমি এতবার স্থান পরিবর্তনের পরও বইটি সংরক্ষণ করেছি) ধর্মীয় বইয়ের প্রতি আমার একটা আকর্ষণ ছিল, যা আজ অতীত হয়ে গেছে। কিন্তু ওই গানটা! ভ্রমণ আর ভালোবাসা দিয়ে মোড়া ‘কিউবায় ভ্রমণ’ গানটি এখনো মনে হয় আমার খুব কাছের একটা ব্যাপার। খুবই আনন্দের সঙ্গে আমি গানের পঙ্ক্তিগুলো আওড়াই:
দুই কিশোর আর দুই কিশোরী
ঢেউ তুমি খেলতে থাক, উল্লাসে মাতো
ছোট্ট এক তরিই সম্বল
তাতে করেই কিউবার পথে…
সেই রবিবারের কথাটাই ভাবছিলাম শেষ কয়েক দিন ধরে। ঘটনাগুলো লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে কতটা রঙিন হয়ে, কণ্ঠস্বর হয়ে, অঙ্গভঙ্গি হয়ে তা আমার কাছে দৃশ্যমান হয়েছে। এখন অবশ্য আবার তা স্তিমিত হয়ে গেছে আর কণ্ঠটাও মিইয়ে গেছে সেই চলচ্চিত্রের মতো, যেটা এনক্রিপ্টেড চ্যানেলে ডেকোডার না বসিয়েই যেমন দেখা হয়। আমি সেই সত্যকে ভাষায় প্রকাশ করতে পারি কি না পারি, তাতে কিছুই পরিবর্তিত হচ্ছে না। সেটা সব সময়ই পাগলামি আর মৃত্যুর সঙ্গে জড়াজড়ি করে থাকছে। আর এই দৃশ্যের সঙ্গেই আমি আমার জীবনের সবচেয়ে যন্ত্রণাময় ঘটনাগুলো মিলিয়ে নিচ্ছিলাম, যেগুলো একটার চেয়ে আরেকটা আরও বেশি বেদনাদায়ক ছিল।
যেহেতু আমাকে আবার আমার লেখালেখির মধ্যে ফিরে আসতে হবে এবং আমি এ ছাড়া আর কিছুই করতে পারি না এবং সবাই যখন বলছে যে, আমি আবার নতুন বই লেখা শুরু করছি, তখন আমাকে আবার সবকিছু নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, নিরেট কিছু বাস্তব ঘটনাই শুধু আমার মনে আছে। এই দৃশ্যটা আমার মধ্যে ছিল একেবারে স্থিরচিত্রের মতো, আর আমি সে দৃশ্যটাকে গতিশীল করতে চাইছি, যেন তা আইকনিক পবিত্রতা অর্জন করে উঠতে না পারে (এবং আমি নিশ্চিত, এই দৃশ্যটাই আমাকে লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে এবং কোনো না কোনোভাবে তা আমার বইগুলোতে সুপ্তভাবে বিরাজ করছে)।
বহুদিন হয়ে গেছে আমি মনোবিশ্লেষণ কিংবা পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানীর দেওয়া পরিকল্পনামাফিক চলি না: বশ্যতা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় আমার মা ও বাবা কত কীই না করেছেন। ‘পারিবারিক আঘাত’, ‘শৈশবের দয়ালু মনটা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে’ এই ধরনের কথা আমার জন্য জুতসই নয়। যে অনুভূতিটা সব সময় আমাকে ঘিরে রেখেছে, সে অনুভূতিকেই সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেছি, এবং সেটা আমি পেয়েছি সেই দিনটি থেকেই, ‘জীবনের জন্য পাগল হও।’—এ ছাড়া আর কোনো বাক্যই আমার জন্য প্রযোজ্য নয়।
* * *
কাল আমি রুয়েনস আর্কাইভে গিয়েছিলাম ‘প্যারিস-নরমান্দি’ পত্রিকায় ১৯৫২ সালে কী লেখা হয়েছে, তা দেখার জন্য। এই পত্রিকাটি একজন হকার সব সময় আমার মা-বাবার কাছে দিয়ে যেত। এর আগপর্যন্ত আমি সাহসে ভর করে ১৯৫২ সালের জুন মাসের পত্রিকা দেখার কথা ভাবতে পারিনি। সিঁড়ি বেয়ে আর্কাইভে উঠছিলাম যখন, তখন বীভৎস কিছু একটা দেখব মনে করে আমার শরীর বেয়ে শীতল আতঙ্ক নেমে আসছিল। আর্কাইভটা ছিল মেয়রের অফিসে, সেখানকার একজন কর্মচারী আমার জন্য নিয়ে এলেন ১৯৫২ সালের দুটো বড় ফাইল। আমি পহেলা জানুয়ারি থেকে দেখতে শুরু করলাম। আমি জুন মাস পর্যন্ত পৌঁছানোর আগে কিছু সময় নিচ্ছিলাম। আগের তারিখগুলোর সুখকর সংবাদগুলোতে নিবিষ্ট হচ্ছিলাম।
প্রথম পাতার একেবারে ডান দিকের ওপরের অংশে অ্যাবট গ্যাব্রিয়েলের করা আবহাওয়ার প্রতিবেদনগুলো থাকত। আমার এখন একেবারেই মনে পড়ে না, কেমন ছিল সে দিনগুলোর আবহাওয়া। আমি তখন কী খেলতাম? আমি কি ঘুরতে বের হতাম? সূর্যের আলোময় দিন কিংবা মেঘে ঢাকা আকাশ ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে ওঠা, দমকা হাওয়া ইত্যাদি এখন আমাকে আর কোনো কথা মনে করিয়ে দেয় না। যে ঘটনাগুলোর কথা আমার মনে আছে, তা হলো ইন্দোচীনে আর কোরিয়ায় যুদ্ধ, অরলিয়ানে বিক্ষোভ, পিনের পরিকল্পনা, কিন্তু আমি এ ঘটনাগুলোকে ৫২ সালের সঙ্গেই যুক্ত করেছিলাম বলে মনে পড়ে না। তখন নয়, পরে এগুলো আমার কাছে কোনো না কোনো অর্থ পেয়েছিল। ‘সাইগনে ৬টি বাইসাইকেল বিস্ফোরণ হয়েছে’, কিংবা ‘ফ্রেনে দ্যুকলো’র (ফ্রান্সের কমিউনিস্ট নেতা—অনুবাদক) সঙ্গে ১৯৫২ সালের সেই কিশোরীকে কোনোভাবেই মেলাতে পারি না। অবাক কাণ্ড হচ্ছে, স্তালিন, চার্চিল, আইজেনহাওয়ারকে আমার ঠিক তেমনই লাগত, যেমন এখন লাগে ইয়েলৎসিন, ক্লিনটন বা কোহলকে। আমি কিছুই জানতে পারি না, যেন আমি সে সময়টা এই পৃথিবীতে কাটাইনি।
পিনের ছবি দেখে আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম তার সঙ্গে ঝিসকার দ্য’এস্তেনের চেহারার মিল দেখে। আমি এখনকার টেকোমাথা ঝিসকারের কথা বলছি না, বলছি আজ থেকে কুড়ি বছর আগে সে যেমন ছিল, তার কথা। ‘আয়রন কার্টেন’ বা লৌহপর্দা বিষয়টি মনে এলেই আমার মনে পড়ে প্রাইভেট স্কুলে পড়ার সময় নারী শিক্ষক আমাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘খ্রিষ্টধর্মে দশ পুঁতির জপমালা দিয়ে কী বোঝায়’, আর আমার তখন মনে হতো একটি লোহার খাঁচায় অনেকগুলো পুরুষ এবং নারী বন্দী হয়ে খাঁচাটিকে প্রবলভাবে নাড়াচ্ছেন। তবে বলতেই পারি, আমি অবলীলায় মনে করতে পারলাম, কৌতুক স্ট্রিপ ‘পুস্তিক’-এর কথা। এই স্ট্রিপ বহু বহুদিন ধরে ‘ফ্রান্স-সুয়ার’ পত্রিকার শেষের পাতায় প্রকাশ হয়েছে। সে সময় কৌতুক পড়ে আমি মজা পেতাম কি পেতাম না, তা মনে করতে পারি না। যেমন একটা কৌতুক ছিল:
‘কী হে মৎস্যশিকারি, কামড়াচ্ছে?’
‘না না, এরা খুব ছোট। কামড়ালেও ব্যথা লাগছে না।’
আমি সিনেমার বিজ্ঞাপন এবং যে সিনেমাগুলো আসত প্রথমে রুয়ান শহরে, পরে আমাদের শহরে, সেগুলো সম্পর্কে জানতাম। ‘মিশর থেকে আসা প্রেমিকেরা’ ‘দারুণ বউ আমার’ ইত্যাদি সিনেমার কথা মনে আছে।
প্রতিদিনই কোনো না কোনো অঘটন ঘটত: দুই বছর বয়সী এক শিশু ক্রসাঁ খেয়ে আকস্মিকভাবে মারা গেছে, খেত পরিষ্কার করতে গিয়ে গমের খেতে খেলতে খেলতে লুকিয়ে পড়া ছেলের পা কেটে ফেলেছে এক কৃষক, ক্রেইলে মাইন বিস্ফোরণে তিন শিশু নিহত। এ ধরনের ঘটনায় আমার মনে আগ্রহ জাগত।
খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায়—মাখন আর দুধের দাম। সে সময় গ্রামকে বেশ দাম দেওয়া হতো। পা ও মুখের রোগ সম্পর্কে খবর বের হতো, থাকত কৃষকদের বউদের নিয়ে প্রতিবেদন, পশু চিকিৎসা নিয়ে লেখালেখি, লাপিক্রিন কিংবা ওসপোরৎসিন নিয়ে প্রতিবেদন থেকে তা ঢের বোঝা যেত।
কাশির লজেন্স আর সিরাপের এত বেশি বিজ্ঞাপন বের হতো যে মনে হতো, সব মানুষই কাশিতে ভুগছে এবং তারা চিকিৎসকের শরণাপন্ন না হয়ে এসব লজেন্স আর সিরাপ খেয়েই সেরে উঠছে।
শনিবারের পত্রিকায় ছিল ফিচার, ‘নারী, আপনার জন্য’। আমি সে পাতায় যে জ্যাকেট দেখেছি, এর সঙ্গে আমার বিয়ারিৎসে নিয়ে যাওয়া জ্যাকেটের মিল খুঁজে পাই। কিন্তু আমি নিশ্চিত, আমি বা মা কেউই এইটুকু ছাড়া আর কোনোভাবেই সে সময়ের ফ্যাশন অনুযায়ী সাজগোজ করিনি। আর চুলের যে কার্লগুলো দেখেছি, এর সঙ্গে আমার টুপিওয়ালা চুলের স্টাইলের কোনো মিল ছিল না।
আমি পত্রিকার ১৪-১৫ তারিখের শনি-রবিবারের পাতায় চোখ রাখলাম। প্রথম পাতায় বড় বড় করে লেখা ছিল:
শস্যের ফলন প্রত্যাশার চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি হয়েছে
২৪ ঘণ্টার গাড়ির প্রতিযোগিতায় প্যারিসে কোনো ফেবারিট নেই
মি. ঝ্যাক দ্যুকলো দীর্ঘ জেরার পরও অপরাধ স্বীকার করেননি
১০ দিন খোঁজাখুঁজির পর জোয়েল নামের শিশুটির মরদেহ তার বাড়ির পাশ থেকেই উদ্ধার:
স্বীকারোক্তি—প্রতিবেশিনী তাকে নর্দমায় ফেলে দেয়
এসব দেখে আর পত্রিকার পাতা ওল্টাতে ইচ্ছে হলো না। আর্কাইভ থেকে বের হয়ে, সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে আমি হঠাৎ বুঝতে পারলাম, আর একটু হলেই ১৯৫২ সালের সেই দিনটির, সেই খবরটির দেখা বুঝি পেয়ে যেতাম! পরে আমি বিস্মিত হয়ে ভেবেছি, ঘটনাটা তো সেই দিনটিতে ঘটেছিল, যে দিনে লে-মানে’তে সারা দিন ক্রমাগত গাড়ির গর্জন শোনা গিয়েছিল। দুটো ঘটনার এত সাদৃশ্য আমার কাছে অবিশ্বাস্য লাগছিল। সেই রোববার পৃথিবীতে যত ঘটনাই ঘটে থাকুক না কেন, আমি ওই একটি ঘটনার সঙ্গে আর কোনো ঘটনাকে মেলাতে পারি না। শুধু সেটা আমার জন্য ছিল এক বাস্তব অভিজ্ঞতা।
(চলবে)
আরও পড়ুন:

বায়ান্ন সাল থেকে আমার নিজেরই আরও কিছু জিনিসপত্তর ছিল: এর একটি হলো রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের একটা সাদা-কালো ছবি। ছবিটা আমাকে উপহার দিয়েছিল লা হাভরে পরিবারের মেয়েটি। ওরা রানির সিংহাসনে আরোহণের সময় ক্লাসসুদ্ধ সবাই লন্ডনে গিয়েছিল। যখন ছবিটা পেয়েছিলাম, তখন থেকেই ছবির উল্টোপিঠে একটা খয়েরি রঙের দাগ আমি খেয়াল করেছিলাম। সে দাগটা আমার মেজাজ খারাপ করে দিত। যখনই ছবিটা আমার চোখে পড়ত, তখনই মনে ভেসে উঠত ওই খয়েরি রঙের দাগটা।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ছবিটা তোলা হয়েছিল সামনাসামনি, প্রোফাইল। তার চোখের দৃষ্টি মনে হচ্ছিল অনেক গভীর থেকে উঠে আসছে, ছোট চুলগুলো ছিল পেছন দিকে শক্ত করে বাঁধা, মোটা ঠোঁটটা আরও মোটা লাগছিল গাঢ় লিপস্টিকের কারণে। বাঁ হাতটা ছিল পশমের ওপর, ডান হাতে ছিল পাখা। এখন মনে পড়ছে না, রানিকে তখন সুশ্রী নাকি কুশ্রী লাগছিল। সম্ভবত আমি সে রকম করে ভেবেও দেখিনি। রানি সুশ্রী না কুশ্রী, সেটা কি কোনো প্রশ্ন হতে পারে, রানি তো রানিই; আমার আরও ছিল লাল রঙের একটা চামড়ার ব্যাগ। এর মধ্যে ছিল কাঁচি, একটা হুক, ছিদ্র সেলাই করার জন্য মুচিদের ব্যবহার্য একটা সুঁই ইত্যাদি। সেটা হারিয়ে গেছে। ক্রিসমাস ডেতে আমাকে উপহার দেওয়া হয়েছিল ব্যাগটা, সেটা আরাম করে ব্যবহার করা যেত। এটির মধ্যে আমি আমার লেখালেখির কাগজপত্র রাখতাম, লিমোজেস ক্যাথিড্রালের ছবিওয়ালা পোস্টকার্ড ছিল তাতে। আমি আর বাবা যখন লুর্দসে গিয়েছিলাম, তখন সেখান থেকে মাকে পাঠিয়েছিলাম এই পোস্টকার্ডটি। পোস্টকার্ডের উল্টো পিঠে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল, ‘লিমোজেস হোটেলটা অনেক বড়, অনেক বিদেশি পর্যটক আছে এখানে। তোমার জন্য চুমু।’ নিচে আমার নাম লেখা আর ‘বাবা’। ঠিকানা লিখে দিয়েছিল বাবা। পোস্টাপিসের সিল ছিল ২২-০৮-৫২; আরও ছিল লুর্দেস ক্যাসেলের এক সেট আর পাইরেনিয়ান জাদুঘরের এক সেট পোস্টকার্ড। বোঝাই যাচ্ছে, এগুলো আমি কিনেছিলাম ওখানে যাওয়ার পর। ‘কিউবা ভ্রমণ’ গানের কথা ও নোটেশন কিনেছিলাম। সেটা লেখা ছিল আকাশি রঙে দুই পৃষ্ঠাজুড়ে। প্রথম পাতায় চলমান নৌকার ছবি ছিল, আর তাতে লেখা ছিল কণ্ঠশিল্পীদের নাম। যারা গানটি করেছিলেন, তারা হলেন: পাত্রিস আর মারিও, ইতেন ভগ্নীদ্বয়, মার্সেল আজ্জোলা, ঝান সাবলোন প্রমুখ।
মনে হয় গানটি আমার খুব প্রিয় ছিল, কারণ এই গানের লিরিক কেনার জন্য আমি মায়ের কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিয়েছিলাম। মা অবশ্য বলেছিলেন, তুচ্ছ এ জিনিস পড়াশোনার কোনো কাজে আসবে না। তবে সেই গ্রীষ্মে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল ‘আমার ছোট্ট পাগল করা ভালোবাসা’ আর ‘মেক্সিকো’ গান দুটি। গান দুটি লুর্দেসে যাওয়ার পথে একজন গাড়িচালকের মুখে শুনেছিলাম। আমার হাতের নিচে চাপা পড়ে ছিল প্রার্থনাবিষয়ক বইটি। ‘রোমান মিসাল উইথ টেক্সট অব দ্য সার্ভিসেস’ নাম বইটির। ব্রুজেস থেকে ছাপা হওয়া। প্রতিটি পৃষ্ঠায় দুটো কলাম। এক কলামে লেখা ফরাসি ভাষায়, অন্য কলামে লাতিন। তবে বইয়ের মাঝামাঝি এসে ‘প্রতিদিনের প্রার্থনা’ পাতায় এসে দেখা যাচ্ছে পুরো ডান দিকের পাতায় ফরাসি, বাঁ দিকের পাতায় লাতিন। প্রার্থনার বইটির শুরুতেই ছিল ১৯৫২ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত কোন কোন উৎসব হবে এবং কোন কোন উৎসব হবে না, এর দীর্ঘ একটি ক্যালেন্ডার।
বইটিতে তারিখগুলো আজব, দেখে মনে হয় বইটি বুঝি কয়েক শতাব্দী আগে লেখা। রহস্যময় কত শব্দ তাতে! স্যাক্রামেন্ট, গ্রাজুয়াল, অ্যান্টিফোন (আমার মনে নেই, সে সময় আমি এই শব্দগুলোর অর্থ জানার চেষ্টা করেছিলাম কি না)। বইটি আমাকে শান্তি দিত না, বরং ভয় ধরাত। মনে হতো আমার সামনে অবোধ্য, রহস্যময় এক ভাষা!
শব্দগুলো মোটামুটি পরিচিত, আমি বিনা বাধায় পড়ে ফেলতে পারি ‘অ্যাগনাস ডে’ (ঈশ্বরের মেষশাবক) কিংবা ছোটখাটো কোনো প্রার্থনা, কিন্তু বাল্যকালে আমি নিজের ইচ্ছায় রোববার বা অন্য কোনো ধর্মীয় উৎসবে প্রার্থনা না করলে মনে করতাম না যে আমার পাপ হবে।
ছবিগুলো প্রমাণ করে, ১৯৫২ সালে আমি শারীরিকভাবে এখানে ছিলাম আর প্রার্থনার বইটি প্রমাণ করে, ছোটবেলায় (না হলে কেন আমি এতবার স্থান পরিবর্তনের পরও বইটি সংরক্ষণ করেছি) ধর্মীয় বইয়ের প্রতি আমার একটা আকর্ষণ ছিল, যা আজ অতীত হয়ে গেছে। কিন্তু ওই গানটা! ভ্রমণ আর ভালোবাসা দিয়ে মোড়া ‘কিউবায় ভ্রমণ’ গানটি এখনো মনে হয় আমার খুব কাছের একটা ব্যাপার। খুবই আনন্দের সঙ্গে আমি গানের পঙ্ক্তিগুলো আওড়াই:
দুই কিশোর আর দুই কিশোরী
ঢেউ তুমি খেলতে থাক, উল্লাসে মাতো
ছোট্ট এক তরিই সম্বল
তাতে করেই কিউবার পথে…
সেই রবিবারের কথাটাই ভাবছিলাম শেষ কয়েক দিন ধরে। ঘটনাগুলো লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে কতটা রঙিন হয়ে, কণ্ঠস্বর হয়ে, অঙ্গভঙ্গি হয়ে তা আমার কাছে দৃশ্যমান হয়েছে। এখন অবশ্য আবার তা স্তিমিত হয়ে গেছে আর কণ্ঠটাও মিইয়ে গেছে সেই চলচ্চিত্রের মতো, যেটা এনক্রিপ্টেড চ্যানেলে ডেকোডার না বসিয়েই যেমন দেখা হয়। আমি সেই সত্যকে ভাষায় প্রকাশ করতে পারি কি না পারি, তাতে কিছুই পরিবর্তিত হচ্ছে না। সেটা সব সময়ই পাগলামি আর মৃত্যুর সঙ্গে জড়াজড়ি করে থাকছে। আর এই দৃশ্যের সঙ্গেই আমি আমার জীবনের সবচেয়ে যন্ত্রণাময় ঘটনাগুলো মিলিয়ে নিচ্ছিলাম, যেগুলো একটার চেয়ে আরেকটা আরও বেশি বেদনাদায়ক ছিল।
যেহেতু আমাকে আবার আমার লেখালেখির মধ্যে ফিরে আসতে হবে এবং আমি এ ছাড়া আর কিছুই করতে পারি না এবং সবাই যখন বলছে যে, আমি আবার নতুন বই লেখা শুরু করছি, তখন আমাকে আবার সবকিছু নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, নিরেট কিছু বাস্তব ঘটনাই শুধু আমার মনে আছে। এই দৃশ্যটা আমার মধ্যে ছিল একেবারে স্থিরচিত্রের মতো, আর আমি সে দৃশ্যটাকে গতিশীল করতে চাইছি, যেন তা আইকনিক পবিত্রতা অর্জন করে উঠতে না পারে (এবং আমি নিশ্চিত, এই দৃশ্যটাই আমাকে লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে এবং কোনো না কোনোভাবে তা আমার বইগুলোতে সুপ্তভাবে বিরাজ করছে)।
বহুদিন হয়ে গেছে আমি মনোবিশ্লেষণ কিংবা পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানীর দেওয়া পরিকল্পনামাফিক চলি না: বশ্যতা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় আমার মা ও বাবা কত কীই না করেছেন। ‘পারিবারিক আঘাত’, ‘শৈশবের দয়ালু মনটা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে’ এই ধরনের কথা আমার জন্য জুতসই নয়। যে অনুভূতিটা সব সময় আমাকে ঘিরে রেখেছে, সে অনুভূতিকেই সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেছি, এবং সেটা আমি পেয়েছি সেই দিনটি থেকেই, ‘জীবনের জন্য পাগল হও।’—এ ছাড়া আর কোনো বাক্যই আমার জন্য প্রযোজ্য নয়।
* * *
কাল আমি রুয়েনস আর্কাইভে গিয়েছিলাম ‘প্যারিস-নরমান্দি’ পত্রিকায় ১৯৫২ সালে কী লেখা হয়েছে, তা দেখার জন্য। এই পত্রিকাটি একজন হকার সব সময় আমার মা-বাবার কাছে দিয়ে যেত। এর আগপর্যন্ত আমি সাহসে ভর করে ১৯৫২ সালের জুন মাসের পত্রিকা দেখার কথা ভাবতে পারিনি। সিঁড়ি বেয়ে আর্কাইভে উঠছিলাম যখন, তখন বীভৎস কিছু একটা দেখব মনে করে আমার শরীর বেয়ে শীতল আতঙ্ক নেমে আসছিল। আর্কাইভটা ছিল মেয়রের অফিসে, সেখানকার একজন কর্মচারী আমার জন্য নিয়ে এলেন ১৯৫২ সালের দুটো বড় ফাইল। আমি পহেলা জানুয়ারি থেকে দেখতে শুরু করলাম। আমি জুন মাস পর্যন্ত পৌঁছানোর আগে কিছু সময় নিচ্ছিলাম। আগের তারিখগুলোর সুখকর সংবাদগুলোতে নিবিষ্ট হচ্ছিলাম।
প্রথম পাতার একেবারে ডান দিকের ওপরের অংশে অ্যাবট গ্যাব্রিয়েলের করা আবহাওয়ার প্রতিবেদনগুলো থাকত। আমার এখন একেবারেই মনে পড়ে না, কেমন ছিল সে দিনগুলোর আবহাওয়া। আমি তখন কী খেলতাম? আমি কি ঘুরতে বের হতাম? সূর্যের আলোময় দিন কিংবা মেঘে ঢাকা আকাশ ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে ওঠা, দমকা হাওয়া ইত্যাদি এখন আমাকে আর কোনো কথা মনে করিয়ে দেয় না। যে ঘটনাগুলোর কথা আমার মনে আছে, তা হলো ইন্দোচীনে আর কোরিয়ায় যুদ্ধ, অরলিয়ানে বিক্ষোভ, পিনের পরিকল্পনা, কিন্তু আমি এ ঘটনাগুলোকে ৫২ সালের সঙ্গেই যুক্ত করেছিলাম বলে মনে পড়ে না। তখন নয়, পরে এগুলো আমার কাছে কোনো না কোনো অর্থ পেয়েছিল। ‘সাইগনে ৬টি বাইসাইকেল বিস্ফোরণ হয়েছে’, কিংবা ‘ফ্রেনে দ্যুকলো’র (ফ্রান্সের কমিউনিস্ট নেতা—অনুবাদক) সঙ্গে ১৯৫২ সালের সেই কিশোরীকে কোনোভাবেই মেলাতে পারি না। অবাক কাণ্ড হচ্ছে, স্তালিন, চার্চিল, আইজেনহাওয়ারকে আমার ঠিক তেমনই লাগত, যেমন এখন লাগে ইয়েলৎসিন, ক্লিনটন বা কোহলকে। আমি কিছুই জানতে পারি না, যেন আমি সে সময়টা এই পৃথিবীতে কাটাইনি।
পিনের ছবি দেখে আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম তার সঙ্গে ঝিসকার দ্য’এস্তেনের চেহারার মিল দেখে। আমি এখনকার টেকোমাথা ঝিসকারের কথা বলছি না, বলছি আজ থেকে কুড়ি বছর আগে সে যেমন ছিল, তার কথা। ‘আয়রন কার্টেন’ বা লৌহপর্দা বিষয়টি মনে এলেই আমার মনে পড়ে প্রাইভেট স্কুলে পড়ার সময় নারী শিক্ষক আমাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘খ্রিষ্টধর্মে দশ পুঁতির জপমালা দিয়ে কী বোঝায়’, আর আমার তখন মনে হতো একটি লোহার খাঁচায় অনেকগুলো পুরুষ এবং নারী বন্দী হয়ে খাঁচাটিকে প্রবলভাবে নাড়াচ্ছেন। তবে বলতেই পারি, আমি অবলীলায় মনে করতে পারলাম, কৌতুক স্ট্রিপ ‘পুস্তিক’-এর কথা। এই স্ট্রিপ বহু বহুদিন ধরে ‘ফ্রান্স-সুয়ার’ পত্রিকার শেষের পাতায় প্রকাশ হয়েছে। সে সময় কৌতুক পড়ে আমি মজা পেতাম কি পেতাম না, তা মনে করতে পারি না। যেমন একটা কৌতুক ছিল:
‘কী হে মৎস্যশিকারি, কামড়াচ্ছে?’
‘না না, এরা খুব ছোট। কামড়ালেও ব্যথা লাগছে না।’
আমি সিনেমার বিজ্ঞাপন এবং যে সিনেমাগুলো আসত প্রথমে রুয়ান শহরে, পরে আমাদের শহরে, সেগুলো সম্পর্কে জানতাম। ‘মিশর থেকে আসা প্রেমিকেরা’ ‘দারুণ বউ আমার’ ইত্যাদি সিনেমার কথা মনে আছে।
প্রতিদিনই কোনো না কোনো অঘটন ঘটত: দুই বছর বয়সী এক শিশু ক্রসাঁ খেয়ে আকস্মিকভাবে মারা গেছে, খেত পরিষ্কার করতে গিয়ে গমের খেতে খেলতে খেলতে লুকিয়ে পড়া ছেলের পা কেটে ফেলেছে এক কৃষক, ক্রেইলে মাইন বিস্ফোরণে তিন শিশু নিহত। এ ধরনের ঘটনায় আমার মনে আগ্রহ জাগত।
খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায়—মাখন আর দুধের দাম। সে সময় গ্রামকে বেশ দাম দেওয়া হতো। পা ও মুখের রোগ সম্পর্কে খবর বের হতো, থাকত কৃষকদের বউদের নিয়ে প্রতিবেদন, পশু চিকিৎসা নিয়ে লেখালেখি, লাপিক্রিন কিংবা ওসপোরৎসিন নিয়ে প্রতিবেদন থেকে তা ঢের বোঝা যেত।
কাশির লজেন্স আর সিরাপের এত বেশি বিজ্ঞাপন বের হতো যে মনে হতো, সব মানুষই কাশিতে ভুগছে এবং তারা চিকিৎসকের শরণাপন্ন না হয়ে এসব লজেন্স আর সিরাপ খেয়েই সেরে উঠছে।
শনিবারের পত্রিকায় ছিল ফিচার, ‘নারী, আপনার জন্য’। আমি সে পাতায় যে জ্যাকেট দেখেছি, এর সঙ্গে আমার বিয়ারিৎসে নিয়ে যাওয়া জ্যাকেটের মিল খুঁজে পাই। কিন্তু আমি নিশ্চিত, আমি বা মা কেউই এইটুকু ছাড়া আর কোনোভাবেই সে সময়ের ফ্যাশন অনুযায়ী সাজগোজ করিনি। আর চুলের যে কার্লগুলো দেখেছি, এর সঙ্গে আমার টুপিওয়ালা চুলের স্টাইলের কোনো মিল ছিল না।
আমি পত্রিকার ১৪-১৫ তারিখের শনি-রবিবারের পাতায় চোখ রাখলাম। প্রথম পাতায় বড় বড় করে লেখা ছিল:
শস্যের ফলন প্রত্যাশার চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি হয়েছে
২৪ ঘণ্টার গাড়ির প্রতিযোগিতায় প্যারিসে কোনো ফেবারিট নেই
মি. ঝ্যাক দ্যুকলো দীর্ঘ জেরার পরও অপরাধ স্বীকার করেননি
১০ দিন খোঁজাখুঁজির পর জোয়েল নামের শিশুটির মরদেহ তার বাড়ির পাশ থেকেই উদ্ধার:
স্বীকারোক্তি—প্রতিবেশিনী তাকে নর্দমায় ফেলে দেয়
এসব দেখে আর পত্রিকার পাতা ওল্টাতে ইচ্ছে হলো না। আর্কাইভ থেকে বের হয়ে, সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে আমি হঠাৎ বুঝতে পারলাম, আর একটু হলেই ১৯৫২ সালের সেই দিনটির, সেই খবরটির দেখা বুঝি পেয়ে যেতাম! পরে আমি বিস্মিত হয়ে ভেবেছি, ঘটনাটা তো সেই দিনটিতে ঘটেছিল, যে দিনে লে-মানে’তে সারা দিন ক্রমাগত গাড়ির গর্জন শোনা গিয়েছিল। দুটো ঘটনার এত সাদৃশ্য আমার কাছে অবিশ্বাস্য লাগছিল। সেই রোববার পৃথিবীতে যত ঘটনাই ঘটে থাকুক না কেন, আমি ওই একটি ঘটনার সঙ্গে আর কোনো ঘটনাকে মেলাতে পারি না। শুধু সেটা আমার জন্য ছিল এক বাস্তব অভিজ্ঞতা।
(চলবে)
আরও পড়ুন:

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
২ দিন আগে
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২১ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১৫ অক্টোবর ২০২৫
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১০ অক্টোবর ২০২৫নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
মঞ্চনাট্যটি স্কলাস্টিকার প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসমিন মুরশেদকে উৎসর্গ করা হয়।

স্কুলের এসটিএম মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তী উদ্যাপনকে সামনে রেখে আয়োজিত এ নাট্যানুষ্ঠানের সমাপনী দিনে বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত, দিলারা জামান ও আফজাল হোসেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার অধ্যক্ষ ফারাহ্ সোফিয়া আহমেদ।
হীরক রাজার দেশে নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। প্রোডাকশন ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন শৈলী পারমিতা নীলপদ্ম। সংগীত পরিচালনা করেন গাজী মুন্নোফ, ইলিয়াস খান ও পলাশ নাথ লোচন। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শাম্মী ইয়াসমিন ঝিনুক ও ফরহাদ আহমেদ শামিম।
নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন নাজিফা ওয়াযিহা আহমেদ, আরিয়াদ রহমান, আজিয়াদ রহমান, বাজনীন রহমান, মোহম্মদ সফির চৌধুরী, ফাহিম আহম্মেদ, সৈয়দ কাফশাত তাইয়ুশ হামদ ও তাজরীবা নওফাত প্রমুখ।
শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত অভিনয়, গান ও নাচ উপভোগ করেন।

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
মঞ্চনাট্যটি স্কলাস্টিকার প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসমিন মুরশেদকে উৎসর্গ করা হয়।

স্কুলের এসটিএম মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তী উদ্যাপনকে সামনে রেখে আয়োজিত এ নাট্যানুষ্ঠানের সমাপনী দিনে বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত, দিলারা জামান ও আফজাল হোসেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার অধ্যক্ষ ফারাহ্ সোফিয়া আহমেদ।
হীরক রাজার দেশে নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। প্রোডাকশন ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন শৈলী পারমিতা নীলপদ্ম। সংগীত পরিচালনা করেন গাজী মুন্নোফ, ইলিয়াস খান ও পলাশ নাথ লোচন। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শাম্মী ইয়াসমিন ঝিনুক ও ফরহাদ আহমেদ শামিম।
নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন নাজিফা ওয়াযিহা আহমেদ, আরিয়াদ রহমান, আজিয়াদ রহমান, বাজনীন রহমান, মোহম্মদ সফির চৌধুরী, ফাহিম আহম্মেদ, সৈয়দ কাফশাত তাইয়ুশ হামদ ও তাজরীবা নওফাত প্রমুখ।
শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত অভিনয়, গান ও নাচ উপভোগ করেন।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ছবিটা তোলা হয়েছিল সামনাসামনি, প্রোফাইল। তার চোখের দৃষ্টি মনে হচ্ছিল অনেক গভীর থেকে উঠে আসছে, ছোট চুলগুলো ছিল পেছন দিকে শক্ত করে বাঁধা, মোটা ঠোঁটটা আরও মোটা লাগছিল গাঢ় লিপস্টিকের কারণে। বাঁ হাতটা ছিল পশমের ওপর, ডান হাতে ছিল পাখা। এখন মনে পড়ছে না, রানিকে তখন সুশ্রী নাকি কুশ্রী
১৯ অক্টোবর ২০২২
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২১ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১৫ অক্টোবর ২০২৫
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১০ অক্টোবর ২০২৫আজকের পত্রিকা ডেস্ক

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ছবিটা তোলা হয়েছিল সামনাসামনি, প্রোফাইল। তার চোখের দৃষ্টি মনে হচ্ছিল অনেক গভীর থেকে উঠে আসছে, ছোট চুলগুলো ছিল পেছন দিকে শক্ত করে বাঁধা, মোটা ঠোঁটটা আরও মোটা লাগছিল গাঢ় লিপস্টিকের কারণে। বাঁ হাতটা ছিল পশমের ওপর, ডান হাতে ছিল পাখা। এখন মনে পড়ছে না, রানিকে তখন সুশ্রী নাকি কুশ্রী
১৯ অক্টোবর ২০২২
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
২ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১৫ অক্টোবর ২০২৫
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১০ অক্টোবর ২০২৫নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।
মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।
মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।
নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।
বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।
মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।
মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।
নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।
বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ছবিটা তোলা হয়েছিল সামনাসামনি, প্রোফাইল। তার চোখের দৃষ্টি মনে হচ্ছিল অনেক গভীর থেকে উঠে আসছে, ছোট চুলগুলো ছিল পেছন দিকে শক্ত করে বাঁধা, মোটা ঠোঁটটা আরও মোটা লাগছিল গাঢ় লিপস্টিকের কারণে। বাঁ হাতটা ছিল পশমের ওপর, ডান হাতে ছিল পাখা। এখন মনে পড়ছে না, রানিকে তখন সুশ্রী নাকি কুশ্রী
১৯ অক্টোবর ২০২২
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
২ দিন আগে
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২১ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১০ অক্টোবর ২০২৫আজকের পত্রিকা ডেস্ক

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।
তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।
তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।
২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।
চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।
তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।
তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।
তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।
২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।
চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।
তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ছবিটা তোলা হয়েছিল সামনাসামনি, প্রোফাইল। তার চোখের দৃষ্টি মনে হচ্ছিল অনেক গভীর থেকে উঠে আসছে, ছোট চুলগুলো ছিল পেছন দিকে শক্ত করে বাঁধা, মোটা ঠোঁটটা আরও মোটা লাগছিল গাঢ় লিপস্টিকের কারণে। বাঁ হাতটা ছিল পশমের ওপর, ডান হাতে ছিল পাখা। এখন মনে পড়ছে না, রানিকে তখন সুশ্রী নাকি কুশ্রী
১৯ অক্টোবর ২০২২
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
২ দিন আগে
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২১ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১৫ অক্টোবর ২০২৫