Ajker Patrika

ভারত-কানাডা: বন্ধু থেকে শত্রু, গন্তব্য কোথায়

আবদুল বাছেদ
আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১: ২৫
ভারত-কানাডা: বন্ধু থেকে শত্রু, গন্তব্য কোথায়

চলতি মাসের শুরুতেই ফেডারেল নির্বাচনে বিদেশি হস্তক্ষেপের অভিযোগ তদন্তের ঘোষণা দেয় কানাডা। গুঞ্জন ওঠে, ২০১৯ ও ২১ সালের নির্বাচনে চীন ও রাশিয়া প্রভাব ফেলার চেষ্টা করেছিল। এতে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। চীনের সঙ্গে ভঙ্গুর সম্পর্ক নিয়ে আরও সতর্ক হতে বাধ্য হয় কানাডা।

বেইজিংয়ের সঙ্গে অন্যান্য পশ্চিমা জোটের সদস্য দেশগুলোর সম্পর্কে সর্বদা চোখ-কান খোলা রাখে অটোয়া; রাশিয়ার কর্মকাণ্ডও ছিল নজরদারিতে। এসবের মধ্যে একটি ব্যাপার অনেকেরই নজর এড়িয়ে গেছে, তা হলো এসব বিষয়ে ভারতের সংশ্লিষ্টতার ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন কানাডার মন্ত্রীরা।

সেসব ইশারা-ইঙ্গিত বাস্তবে রূপ নিয়েছে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর দেওয়া গত সোমবারের বক্তব্যে। চলতি বছরের জুনে ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত কানাডীয় হারদীপ সিং নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে দিল্লির সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে ‘বিশ্বাসযোগ্য’ সংযোগ পেয়েছেন বলে তিনি অভিযোগ করেছেন।

ভারতের পাঞ্জাবে শিখদের জন্য খালিস্তান নামে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলনের সংগঠক ছিলেন হারদীপ। ১৯৮০-এর দশকে খালিস্তান আন্দোলন গণমাধ্যমে এলেও তারও বহু আগে সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় শিখরা সার্বভৌমত্বের দাবি তোলেন।

কিন্তু ভারতে এই আন্দোলনকে কঠোরভাবে দমন করা হয়। শিখ সংগঠনগুলোকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়। ভারত সরকার হরদীপের বিরুদ্ধেও সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ আনে এবং তাকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কারও ঘোষণা করে। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৯৭ সালে কানাডায় পাড়ি জমান হরদীপ। তবু বাঁচতে পারলেন না। কানাডার গোয়েন্দা সংস্থাও তাঁর প্রাণনাশের হুমকির বিষয়ে সতর্ক করেছিল।

এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার যে অভিযোগ ট্রুডো করেছেন, তাকে ভারত ‘অযৌক্তিক’ বলে প্রত্যাখ্যান করলেও কানাডা তাতে কান দেয়নি। অটোয়ায় ভারতীয় হাইকমিশনে কর্মরত একজন সিনিয়র কূটনীতিক, যিনি গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়েরও (র) সদস্য, তাঁকে কানাডা বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয়। এর পাল্টা হিসেবে দিল্লিতে নিযুক্ত কানাডীয় কূটনীতিককে পাঁচ দিনের মধ্যে ভারত ছাড়ার নির্দেশ দেয় নরেন্দ্র মোদির সরকার।

সে যাহোক, এক দেশের মাটিতে গুপ্তহত্যায় অন্য দেশের গোয়েন্দা সংস্থার জড়িত থাকার বিষয়টি তেমন সচরাচর নয়। আবার সেই দেশ যদি হয় জি-৭ এর সদস্য ও বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ কানাডা, তখন বিষয়টি সত্যিই অবিশ্বাস্য ও উদ্বেগের।

এই ধরনের কার্যকলাপের সঙ্গে মস্কো সুপরিচিত, নয়াদিল্লি নয়। আর তাই অভিযোগের প্রভাব যে শুধু ভারত-কানাডার দ্বিপক্ষীয় গণ্ডির মধ্যেই যে সীমাবদ্ধ থাকবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কেননা, বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতিতে শুধু রাশিয়া নয়, তার মিত্র চীনও শক্তিশালী ও পশ্চিমাদের বৈরী হয়ে উঠছে। সে কারণে হারদীপ হত্যাকাণ্ড নিয়ে মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছেন বলে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন।

হারদীপ হত্যার ইস্যুতে ইংরেজি ভাষাভাষী পাঁচ দেশ কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের গোয়েন্দা জোট ‘ফাইভ আইজ’ নিজেদের মধ্য সম্পর্ক আরও গভীর করেছে। তারা ভারতকে নতুন ভারসাম্য শক্তি ও বিকল্প অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করছে।

এই বছরের শুরুর দিকে অটোয়া ও নয়াদিল্লি ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ বাণিজ্য চুক্তির রূপরেখা প্রণয়নের পরিকল্পনা করেছিল। তবে সেটা শেষ পর্যন্ত আর আলোর মুখ দেখেনি। উপরন্তু যুক্তরাজ্য এখনো চীন ও ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক এগিয়ে নিচ্ছে।

ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখাটা কোনো কোনো দেশের ক্ষেত্রে একপেশে চিন্তার ফল। তথ্য-উপাত্ত যাচাই না করেই তারা এমন সিদ্ধান্ত নেয়। ঠিক যেমন কিছু পশ্চিমা দেশ ভেবেছিল, চীনের অর্থনৈতিক উদারনৈতিক অবস্থান দেশটিকে রাজনৈতিক সংস্কারের দিকে নিয়ে যাবে। যদিও সব আলামত ছিল উল্টো। তার ফলও পেয়েছে তাঁরা। একই চিত্র ভারতের বেলায়ও, কেউ কেউ পরামর্শ দিচ্ছে, গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারত আদর্শ বাণিজ্য অংশীদার হতে পারে। অথচ সেখানে মোদির জাতীয়তাবাদ ও কর্তৃত্ববাদ ক্রমে উগ্র রূপ ধারণ করছে।

আবার কোনো কোনো দেশ সমস্বার্থ বিবেচনা করে বেশ বাস্তববাদী হয়ে উঠছে। চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তি ও মস্কোর সঙ্গে নয়াদিল্লির দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ককে সীমিত রাখার জন্য এবং রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন নিয়ে ভারতের নিরপেক্ষ অবস্থা বজায় রাখার স্বার্থকে তারা প্রাধান্য দিচ্ছে।

এ অবস্থায় ট্রুডো বাস্তববাদী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। তিনি হরদীপের ইস্যুটি ‘ব্যক্তিগতভাবে এবং সরাসরি’ মোদির সামনে উত্থাপন করেছেন। এখানে কোনো অনিশ্চিত বিষয় নেই বলেও জানিয়ে দিয়েছেন। দুই দেশের শীতল সম্পর্কের মধ্যে জি-২০ সম্মেলনে এই দুই নেতা মুখোমুখি হন। এ সময় মোদির কার্যালয় কানাডায় শিখ সম্প্রদায়ের চরমপন্থাকে সমর্থনের জন্য ট্রুডোকে তিরস্কার করেছিল।

তবে ট্রুডোর মন্তব্য থেকে এটাও বোঝা যায়, হরদীপ হত্যার ইস্যুকে স্পষ্টভাবে এবং প্রকাশ্যে নিয়ে আসার ব্যাপারে তিনি শুরুতে আগ্রহী ছিলেন না। হত্যার সঙ্গে ‘ভারতীয় এজেন্টদের’ জড়িত থাকার ব্যাপারটি পরিস্থিতিকে জটিল করেছে।

এত কিছুর পরেও ট্রুডো সহযোগিতার আহ্বান অব্যাহত রেখেছেন। তবে এতে নয়াদিল্লি অনাগ্রহ দেখালে সারা বিশ্বেই ভারতের সুনাম বিনষ্ট হবে। বিশ্ববাসীর কাছে অনুমিত হবে, ভারতই হারদীপকে হত্যা করেছে। সবকিছু মিলিয়ে ভারত এখন এমন পরিস্থিতিতে রয়েছে, যেখানে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে অংশীদারত্বমূলক সম্পর্ক গড়া কঠিন হয়ে উঠতে পারে।

 (দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন আবদুল বাছেদ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত