Ajker Patrika

অন্তঃসত্ত্বা কাঙ্গালিনী সুফিয়াকে বস্তাবন্দী করে ফেলা হয়েছিল নদীতে

তুহিন কান্তি দাস, ঢাকা
আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২২, ১৮: ১০
অন্তঃসত্ত্বা কাঙ্গালিনী সুফিয়াকে বস্তাবন্দী করে ফেলা হয়েছিল নদীতে

পাঁচ মাসের গর্ভবতী এক নারী বস্তাবন্দী অবস্থায় পড়ে ছিলেন কুমার নদে। তাঁর শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন। তারপর স্থানীয় জেলেদের মাধ্যমে উদ্ধার ও বেঁচে ফেরা। একেবারে মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে আসা সেই নারী এরপর থানা-আদালত ঘুরে ফিরেছিলেন স্বামীর কাছে; কিন্তু থাকা হয়নি। গর্ভে থাকা সেই পাঁচ মাসের ভ্রূণ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুকে নিয়েই তাঁকে ঘুরতে হয়েছে আখড়া থেকে আখড়ায় এবং সেই সূত্রে গানের সঙ্গে গাঁটছড়া। মাঝে মুক্তিযুদ্ধ, ভারতে আশ্রয়, সেখানেও গানই হয়ে থাকল তাঁর একমাত্র সখা। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হলো, বাংলাদেশ এগিয়ে গেল অনেকটাই, সেই নারীও ক্রমে এক আইকনে পরিণত হলেন, কিন্তু লড়াইয়ের ময়দান থেকে ফেরা হলো না। তাঁর নাম কাঙ্গালিনী সুফিয়া। 

কাঙ্গালিনী সুফিয়া সেই নাম, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে পরানের বান্ধবের খোঁজে বুড়িয়ে যাওয়া এক জীবনের দীর্ঘশ্বাস। সাধক ওয়াহিদের লেখা এই গান সুফিয়ার কণ্ঠের জাদুতে বাংলা লোকসংগীতের এক অনন্য নিদর্শন হয়ে আছে। বাউলশিল্পী হিসেবে দেশ-বিদেশে খ্যাতি অর্জন করা এই শিল্পীর ব্যক্তিজীবনের সংগ্রাম সম্পর্কে কতটুকু জানি আমরা? নজর পড়েছে কি কখনো শিল্পীর আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক অদম্য নারীর আত্মমগ্নতায়? 

এই দেশে নারীর একজীবনে তাকে যে কত নাম নিতে হয়, তার ইয়ত্তা নেই। তারপরও কাঙ্গালিনী সুফিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নামের হদিস নিতে গেলে বিস্মিত হতে হয়। এক দরিদ্র জেলে পরিবারের টুনি কিংবা অনিতা হালদার থেকে কালের পরিক্রমায় সুফিয়া খাতুন, সুফিয়া খাতুন থেকে বাউল সুফিয়া, আবার বাউল সুফিয়া থেকে কাঙ্গালিনী সুফিয়া হয়ে ওঠার সেই অজানা গল্পের প্রতিটি বাঁকে রয়েছে এক নারীর আজীবন ইস্পাতকঠিন লড়াইয়ের কাহিনি। 

সুফিয়ার আসল নাম ছিল অনিতা হালদার বা টুনি হালদার, ডাকনাম বুচি। কমলা হালদার ও খোকন হালদার দম্পতির তিন মেয়ে ও এক ছেলের সর্বশেষ টুনি হালদার। শৈশব থেকেই জেলে পরিবারের আবহমান অভাব-অনটনে বড় হয়েছেন। সুফিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী, বর্তমান রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার রামদিয়া গ্রামে ১৯৫৫-৫৬ সালে তাঁর জন্ম। তবে পাসপোর্টে তাঁর জন্মসাল লেখা ১৯৬২। 

ছোটকাল থেকেই গানের প্রতি সহজাত টানের দরুন পাশের সোনাপুরের বৈষ্ণব আখড়ায় সুফিয়া ছুটে গেছেন বহুবার। সব সময় গুনগুন করে গাইতেন পল্লিগান। একবার শুনেই যেকোনো গান মনে রাখতে পারতেন অবিকল। কিন্তু এই সংগীতযাত্রায় ঠিকভাবে নামার আগেই বদলে গেল সব। ভাগ্যের ফেরে বারো-তেরো বছর বয়সে সুধীর হালদারের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। 

সুদর্শন সুধীর হালদার পাতলা গড়নের শ্যামলা অনিতাকে পছন্দ করতেন না। ফলে প্রায় সময়ই স্বামীর শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতেন অনিতা। পাঁচ মাসের গর্ভবতী অনিতাকে একবার অজ্ঞান অবস্থায় তাঁর স্বামী বস্তাবন্দী করে ফেলে দেন কুমার নদে। 

সেখান থেকে খোলা চুল দেখে মাছ ধরতে আসা জেলেরা উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যান অনিতাকে। খবর পেয়ে মা-বাবা এসে স্বামীর বাড়ি থেকে নিয়ে যান মেয়েকে। নির্যাতন মামলায় স্বামী কয়েক মাস কারাবাসের পর স্ত্রী-কন্যার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেওয়ার শর্তে সমঝোতা হয়। কিন্তু তাতেও সমস্যার সমাধান মেলেনি। ফলে মেয়ে পুষ্পকে নিয়ে স্বামীর বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি পালিয়ে যান অনিতা। পরে মেয়ে পুষ্পকে রেখে মায়ের সহযোগিতায় বাবার হাত ধরে আশ্রয় নেন বৈষ্ণব আখড়ায়। ফেরা হলো গানের জগতে। 

অনিতা বৈষ্ণব ধর্মের দীক্ষা গ্রহণ করে প্রায় পাঁচ বছর সোনাপুর আশ্রমে কাটান। সেখানেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয় দেবেন ক্ষ্যাপা ও গৌর মোহন্তের। তাঁদের গুরু মেনে বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্বের পাঠ নেন তিনি। 

এই আখড়াতেই অনিতা হালদারের নাম বদলে হয় অনিতা ক্ষ্যাপী। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা বৈষ্ণব আখড়ায় হামলা চালালে দেশ ত্যাগ করে তিনি আশ্রয় নেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলা ও সীমান্তবর্তী লালগোলায়। সেখানকার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে প্রায়ই তিনি গান শুনিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আনন্দ দিতেন, প্রেরণা জোগাতেন। ক্যাম্পে গান গাইতে গাইতে পরিচয় হয় মুক্তিযোদ্ধা মান্দার ফকিরের সঙ্গে। দেশ স্বাধীন হলে অনিতা ক্ষ্যাপী মান্দার ফকিরের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গায় চলে যান। সেখানে গিয়ে ধর্মান্তরিত হয়ে নিজ নাম বদলে রাখেন সুফিয়া খাতুন। 

গানের জগতে বিচরণের জন্য সুফিয়া খাতুন ভাঙ্গা থেকে আবার চলে আসেন তৎকালীন পাবনা জেলার অন্তর্ভুক্ত ও বর্তমান সিরাজগঞ্জ সদরে। এই সময়ে তিনি পালাগানের নতুন জগৎ গড়ে তোলেন। পাল্লা দিয়ে গান গাইতে গাইতে তিনি বাউল সুফিয়া হিসেবে পরিচিতি পান। 

সমসাময়িক শিল্পীদের পরামর্শে মেয়ে পুষ্পকে নিয়ে ১৯৭৬ সালের দিকে ঢাকায় চলে আসেন বাউল সুফিয়া। সুফিয়ার ভাষায়, ‘একজন শিল্পী বলছিল ঢাকায় না গেলে নামকরা শিল্পী হওয়া যাবে না। তুমি ঢাকায় যাও, দেখবা একদিন নামকরা শিল্পী হইবা।’ 

সুফিয়া ঢাকার বাড্ডায় শাহাজাদপুরে এসে ওঠেন। হাইকোর্টের মাজারের মজমায় গান গাইতেন নিয়মিত। বিভিন্ন মজমায় লালন ও বাউলগান গেয়ে সংসার চালাতেন তিনি। সেই মজমাতেই একদিন কবি আসাদ চৌধুরী দেখা পান বাউল সুফিয়ার। 

হাইকোর্ট মাজারের সামনে শিল্পী কানাইলাল শীলের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী পালন করছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী এবং আরও কয়েকজন। সেখানে গান গাইতে আসেন বাউল সুফিয়া। অসাধারণ কণ্ঠে তিনি মুগ্ধ করেন সবাইকে। অনুষ্ঠান শেষে আসাদ চৌধুরী সুফিয়াকে বাংলা একাডেমিতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। এভাবেই বাংলা লোকসংগীতের কালজয়ী ফেরিওয়ালা কাঙ্গালিনী সুফিয়াকে আবিষ্কার করেছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী। 

আসাদ চৌধুরী সে সময় বাংলা একাডেমিতে কর্মরত ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি বিটিভিতে ‘প্রচ্ছদ’ নামে একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন। সেই অনুষ্ঠানে এবং পরে বাংলা একাডেমিতে সুফিয়াকে গান গাওয়ার আমন্ত্রণ জানান তিনি। তৎকালীন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার। তিনি কোরিয়ায় অনুষ্ঠেয় একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া বাংলাদেশ দলের প্রধান হিসেবে সহকর্মীদের অনুরোধ করেন গ্রামবাংলার প্রতিভাবান কোনো শিল্পীর সন্ধান করতে। 

সেই অনুরোধে সাড়া দিয়ে সহকর্মীরা মুস্তাফা মনোয়ারের কাছে নিয়ে আসেন সুফিয়াকে। সুফিয়ার অপূর্ব গায়কি, ভাব-আবেগ মুগ্ধ করে মুস্তাফা মনোয়ারকে। সুফিয়াকে গান গাইতে কোরিয়ায় যাওয়ার প্রস্তাব দেন তিনি। কিন্তু সুফিয়া তখন ছিলেন আর্থিকভাবে নাজেহাল। তাঁর এই করুণ চিত্র দেখেই মুস্তাফা মনোয়ার তাঁর নাম দিয়েছিলেন সুফিয়া কাঙ্গালিনী। সময়ের বিবর্তনে ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন কাঙ্গালিনী সুফিয়া। 

শেষ এই নামটিই আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন সুফিয়া। যদিও তাঁর জীবনের ভাঁজে ভাঁজে রয়ে গেছেন সেই বুচি, টুনি বা অনিতা হালদারেরা। রয়ে গেছে আখড়ায় বা বৈষ্ণবদের কাছ থেকে পাওয়া অনিতা ক্ষ্যাপী নামটি। মজমায় মজমায় গান গেয়ে বেড়ানো সুফিয়া এক আজন্ম বাউল। বয়সী এই মানুষটির সঙ্গী হিসেবে রয়ে গেছে শুধু দুটি জিনিস—গান আর পুষ্প। মায়ের মতো পুষ্পও গান করেন। কুমার নদে বস্তাবন্দী পড়ে থাকা সুফিয়া বা অনিতার পক্ষে একজীবনে সব বাধা ভাঙা সম্ভব না হলেও, সব লড়াইয়ে জয় পাওয়া সম্ভব না হলেও বহু মানুষকে তিনি লড়াইয়ের শক্তি জুগিয়েছেন, যেমন জুগিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সময়। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কোচির ইহুদি পরিবারের ঐতিহ্য যেভাবে বাঁচিয়ে রাখছেন এক মুসলিম

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
কোচির ইহুদি পাড়ায় সারা আন্টির রেখে যাওয়া দোকানের সামনে ইব্রাহিম থাহা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
কোচির ইহুদি পাড়ায় সারা আন্টির রেখে যাওয়া দোকানের সামনে ইব্রাহিম থাহা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

দক্ষিণ ভারতের কোচি শহরের সরু, নুড়ি-পাথর বিছানো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ে ছোট্ট একটি ফলক। তাতে লেখা, ‘সারা কোহেনের বাড়ি।’ জনাকীর্ণ এই রাস্তাটির নাম জু টাউন। কয়েক দশক আগেও এখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বসবাস করত ইহুদি পরিবার। প্রাচীন সামগ্রী, পারস্যের কার্পেট আর মসলার দোকানে ঠাসা এই এলাকাই একসময় পরিচিত ছিল কোচির ইহুদি পাড়া হিসেবে।

এই রাস্তাতেই রয়েছে থাহা ইব্রাহিমের দোকান। কোচির শেষ ইহুদি নকশার দোকান। এক তপ্ত দুপুরে কয়েকজন মার্কিন পর্যটক দোকানে ঢুকতেই দেখা গেল, ৫৫ বছর বয়সী থাহা মনোযোগ দিয়ে একটি কিপ্পা (ইহুদি পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী ছোট, বৃত্তাকার টুপি যা তারা ঈশ্বরকে সম্মান জানাতে এবং নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করতে পরে থাকে) সেলাই করছেন। দোকানের দেয়ালে ঝোলানো একটি ছবির সামনে পর্যটকেরা ভিড় জমালেন। ছবিটি ২০১৩ সালের। তৎকালীন ব্রিটিশ যুবরাজ (বর্তমানে রাজা) চার্লস জু টাউনের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলছেন।

ছবির দিকে আঙুল তুলে থাহা বললেন, ‘ওই ইনিই সারা আন্টি।’ এরপর যোগ করলেন, ‘এটা ছিল সারা কোহেনের বাড়ি ও তাঁর সেলাইয়ের দোকান।’

আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬ বছর বয়সে মারা যাওয়ার পর পুরোপুরি দায়িত্ব নেন তিনি।

থাহা বলেন, ‘আমি ছিলাম তাঁর ছেলের মতো। নিজের মায়ের চেয়েও বেশি সময় তাঁর দেখাশোনা করেছি। আমি তাঁর জন্য কোশার (ইহুদিদের এক ধরনের খাবার) আর মাছ কিনে আনতাম। সময় কাটাতাম আর দোকান বন্ধ করার পরই কেবল ফিরতাম।’

এক ইহুদি নারী আর ভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমির এক মুসলমান পুরুষের এই বন্ধুত্ব প্রায় চার দশক ধরে টিকে ছিল। মৃত্যুর আগে সারা তাঁর দোকানটি থাহার নামে উইল করে যান। থাহা প্রতিজ্ঞা করেন, জু টাউনে তিনি সারার স্মৃতি আর ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখবেন। যেখানে আঠারো শতকে প্রায় আড়াই হাজার ইহুদি বাস করতেন, সেখানে এখন কেবল একজন অবশিষ্ট। থাহা বলেন, ‘এক দিক থেকে, এখানকার ইহুদি সম্প্রদায় যাতে বিস্মৃত না হয়, আমিও সেই চেষ্টাই করছি।’

কেরালায় ইহুদিদের আগমনের সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনি বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লিখিত রাজা সোলোমনের সময়ের, প্রায় দুই হাজার বছর আগেকার। প্রথমে তাঁরা মালাবার উপকূলে ক্রাঙ্গানোরে, বর্তমান কোডুঙ্গাল্লুরের কাছে প্রাচীন বন্দরের আশপাশে বণিক হিসেবে বসতি গড়েন। পরে তাঁরা কোচিতে চলে আসেন। এই প্রাচীন বসতির কারণে তাঁরা পরিচিত হন মালাবারি ইহুদি নামে।

এর বহু পরে, ১৫৯২ সালে, স্প্যানিশ নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা সেফার্ডিক ইহুদিরা কেরালায় পৌঁছান। পর্তুগাল, তুরস্ক আর বাগদাদ হয়ে তাঁরা কোচিতে বসতি গড়ে তোলেন এবং পরিচিত হন পারাদেসি বা বিদেশি ইহুদি নামে। মালাবারি ও পারাদেসি—এই দুই ধারার মানুষ মিলেই পরিচিত হন কোচিন ইহুদি নামে।

ইব্রাহিম থাহার সারা আন্টি তাঁর পরিণত বয়সে। ছবি: ইব্রাহিম থাহার সৌজন্যে
ইব্রাহিম থাহার সারা আন্টি তাঁর পরিণত বয়সে। ছবি: ইব্রাহিম থাহার সৌজন্যে

পর্তুগিজ, আরব, ব্রিটিশ আর ওলন্দাজদের দীর্ঘদিনের বাণিজ্যকেন্দ্র কোচিতে তাঁরা রাজাদের সুরক্ষায় নিরাপদে বসবাস করতেন। বিশ শতকের গোড়ায় সারা কোহেনের জন্ম। তখন জু টাউন ছিল প্রাণবন্ত। সারা আর তাঁর স্বামী জ্যাকব—যাঁর জন্মও এখানেই—১৯৪৪ সালে বিয়ে করেন।

আশির দশকের গোড়ায় আচমকাই থাহার সঙ্গে কোহেন দম্পতির পরিচয় হয়। তেরো বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দেওয়া থাহা তখন পর্যটকদের কাছে পোস্টকার্ড বিক্রি করে জীবিকা চালাতেন। জু টাউনে আসা পর্যটকেরা নিয়মিতই যেতেন পারাদেসি সিনাগগে, যা ১৫৬৮ সালে কোচিনের রাজার দেওয়া জমিতে নির্মিত।

থাহা বলেন, ‘তখন প্রচুর পর্যটক আসত আর আমি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পোস্টকার্ড বেচতাম।’ এক রোববার, যে গুদামঘরে থাহা পোস্টকার্ড রাখতেন, তার মালিক না আসায় জ্যাকব তাঁকে তাঁদের বাড়িতে জায়গা দেন। সারা এতে খুশি ছিলেন না। থাহার মনে আছে, প্রায় তিন বছর তিনি তাঁর সঙ্গে তেমন কথা বলেননি।

ইব্রাহিম থাহা বলেন, ‘মাঝে মাঝে আমি তাঁর স্বামীর ছোটখাটো কাজ করে দিতাম। অথবা যখন তাঁদের জানালার বাইরে থেকে টিভিতে ক্রিকেট দেখতাম, তিনি আমাকে ভেতরে আসতে বলতেন।’ একদিন সারা তাঁকে সিনাগগের জন্য একটি কুশন কভার সেলাই করতে সাহায্য করতে বলেন। তখনই বোঝা যায়, থাহার মধ্যে সেলাই ও নকশার সহজাত দক্ষতা আছে। সম্ভবত দরজি বাবাকে ছোটবেলা থেকে সাহায্য করার ফলেই। তিনি বলেন, ‘আমি যে নকশা আঁকতে আর সেলাই করতে পারি, তা জানতামই না।’

উনিশ বছর বয়সে থাহা সারাকে সাহায্য করেন তাঁদের বৈঠকখানা থেকে ‘সারার হস্ত-সেলাই’ নামে একটি দোকান খুলতে। দোকানটি আজও সেই নামেই পরিচিত। সেখানে বিক্রি হতো কিপ্পাহ, চাল্লাহ কভার আর মেনোরাহ। তিনি বলেন, ‘তিনিই আমাকে সব শিখিয়েছেন।’

এই বন্ধুত্ব নিয়ে থাহা বেশ দার্শনিক। তিনি বলেন, ‘জু টাউনে ইহুদি আর মুসলমানেরা একে অপরের সঙ্গে তেমন মিশতেন না। তাঁরা একে অপরের প্রতি সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু সারা আন্টি আর জ্যাকব আংকেল কখনোই আমাকে বহিরাগত মনে করতে দেননি, যদিও আমাদের পটভূমি আলাদা ছিল।’

সারা আন্টির দোকানে কিপ্পা সেলাই করছেন ইব্রাহিম থাহা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
সারা আন্টির দোকানে কিপ্পা সেলাই করছেন ইব্রাহিম থাহা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

থাহার বাবা-মা এই সম্পর্কে আপত্তি করেননি। তাঁরা দেখেছিলেন, কোহেন পরিবার তাঁদের ছেলেকে জীবনের একটি উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করছে। কিন্তু এই ঘনিষ্ঠতার সময়েই কোচির ইহুদি জনসংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। চল্লিশের দশকে যেখানে ছিল প্রায় ২৫০ জন, নব্বইয়ের দশকে তা নেমে আসে ২০ জনে। এখন মাত্র একজন আছেন—৬৭ বছর বয়সী কিথ হ্যালেগুয়া।

১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর অনেক পরিবার সেখানে চলে যায়। কেরালার ইহুদিদের ওপর ডক্টরেট থিসিস করা আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘কোচিন ইহুদিরা হয়তো স্বদেশে ফিরে যাওয়ার ধারণায় ইসরায়েলে গিয়েছিলেন। তবে উন্নত জীবনের আকর্ষণের মতো অর্থনৈতিক কারণও ছিল। তাঁরা এটাও অনুভব করেছিলেন যে কেরালায় উপযুক্ত জীবনসঙ্গীর অভাব ছিল।’

ধর্মীয় নিপীড়ন কখনোই তাঁদের কোচি ছাড়ার কারণ ছিল না। শহরটি শত শত বছর ধরে তাঁদের স্বাগত জানিয়েছে। কিছু বয়স্ক ইহুদি থেকে গিয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে নিঃসন্তান কোহেন দম্পতিও ছিলেন। ১৯৯৯ সালে জ্যাকব মারা যাওয়ার আগে থাহাকে সারার দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে যান। তখন থাহা বিবাহিত, তিন সন্তানের জনক।

থাহা বলেন, ‘আমি জ্যাকব আংকেলকে বলেছিলাম, সারা আন্টি যদি আমাকে সুযোগ দেন, তবে আমি তাঁর দেখাশোনা করব। আমি তাঁকে সুযোগ দিতে বলেছিলাম, কারণ ইসলামে মৃতপ্রায় ব্যক্তির শেষ ইচ্ছা পূরণ করা গুরুত্বপূর্ণ। না করলে পাপ হয়।’

সারার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে থাহা তাঁর পরিবারকে জু টাউনের কাছাকাছি নিয়ে আসেন। সারা মারা গেলে তিনি তাঁর কফিনের জন্য স্টার অব ডেভিড (ইসরায়েলি পতাকায় অঙ্কিত তারকা) আঁকা একটি কফিন কভার তৈরি করান। আজও তিনি নিয়মিত ইহুদি কবরস্থানে তাঁর সমাধিতে যান। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক কোচি ঘুরতে আসেন। তাঁদের মধ্যে অনেক ইহুদিও থাকেন। আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে ইহুদিরা জু টাউনে আসেন এক ধরনের আপন অনুভব করার জন্য।’

তিনি বলেন, এখানকার ইহুদিরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজের মধ্যেও নিজেদের পরিচয় বজায় রেখেছিলেন। একই সঙ্গে সমাজের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। স্থানীয় ভাষা মালয়ালমই ছিল তাঁদের দৈনন্দিন ভাষা। থাহা যেভাবে সারা কোহেনের ঐতিহ্য আগলে রেখেছেন, তা তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি বলেন, ‘একজন মুসলমান কীভাবে এক ইহুদি নারীর যত্ন নিয়েছেন, তা দৃষ্টান্তস্বরূপ। তিনি এখনো সারা-র ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলো বজায় রেখেছেন।’

থাহা দোকানটিকে ঠিক সেভাবেই রেখেছেন, যেমনটি সারা চালাতেন। ইহুদিদের সাব্বাথ উপলক্ষে তিনি শনিবার দোকান বন্ধ রাখেন। ইব্রাহিম থাহা আরও বলেন, ‘আমি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা মুসলমান, কিন্তু সারা আন্টির জন্য এটা খুব জরুরি ছিল বলে আমি শুক্রবার সন্ধ্যায় একটি প্রদীপ জ্বালাই। কারণ, এই ক্ষণ সাব্বাথের শুরু হওয়াকে চিহ্নিত করে। এই বিষয়টি আমার কাছে এটা ধর্ম সংক্রান্ত নয়, পুরোটাই মানবিক।’

বিবিসি থেকে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

গাবতলী সেতু বধ্যভূমি

সম্পাদকীয়
গাবতলী সেতু বধ্যভূমি

মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল পাশবিক হত্যাযজ্ঞ। ঢাকার গাবতলীর পাশের তুরাগ নদের উত্তর পারেই সাভারের কাউন্দিয়া ইউনিয়নের ইসাকাবাদ গ্রাম অবস্থিত। গ্রামটি থেকে স্পষ্ট দেখা যেত গাবতলী সেতু। সেই গ্রামেরই বয়স্ক এক ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা করেছেন এভাবে, প্রতিদিন রাতের বেলা মিলিটারি আর বিহারিরা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রাকে করে এই সেতুতে মানুষদের নিয়ে আসত। রাত গভীর হলে সেতুর দুই পাশের বাতি নিভিয়ে গুলি চালানো হতো। পুরো যুদ্ধের সময় এখানে এমন রাত ছিল না, যে রাতের বেলা সেখানে লাশ ফেলানো হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ দশকের বেশি সময় পার হলেও এখনো এ জায়গাকে বধ্যভূমি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ছবি: সংগৃহীত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

সাহিত্যচর্চা এবং মানুষের প্রতি কমিটমেন্ট

সম্পাদকীয়
সাহিত্যচর্চা এবং মানুষের প্রতি কমিটমেন্ট

সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।

অনেক লেখকই আছেন যাঁরা খুব ধর্মপ্রাণ, কেউবা আবার কমিউনিস্ট ৷ হিউম্যানিস্ট লেখক যেমন আছেন, তেমনই আছেন অথোরিটারিয়ান লেখক।

তবে সে যা-ই হোক, ভালো সাহিত্যিকের মধ্যে দুটো কমিটমেন্ট থাকতেই হবে—সততা আর স্টাইলের দক্ষতা। নিজের কাছেই যে-লেখক অসৎ, যা লেখেন তা যদি তিনি নিজেই না বিশ্বাস করেন, তাহলে সেই লেখকের পতন অনিবার্য।

কোনো লেখক আবার যদি নিজের ভাষার ঐশ্বর্যকে ছেঁকে তুলতে ব্যর্থ হন, একজন সংগীতশিল্পীকে ঠিক যেভাবে তাঁর যন্ত্রটিকে নিজের বশে আনতে হয়, ভাষার ক্ষেত্রেও তেমনটা যদি কোনো লেখক করতে না পারেন, তাহলে একজন সাংবাদিক ছাড়া আর কিছুই হতে পারবেন না তিনি। সত্য এবং স্টাইল—একজন সাহিত্যিকের বেসিক কমিটমেন্ট হলো শুধু এই দুটো।

সূত্র: সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ টুডে’ পত্রিকার মার্চ, ১৯৮৪ সংখ্যায়, সাক্ষাৎকার গ্রহীতা সেরাজুল ইসলাম কাদির, অনুবাদক নীলাজ্জ দাস, শিবনারায়ণ রায়ের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ, পৃষ্ঠা-২৭।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

রমনা কালীবাড়ি বধ্যভূমি

সম্পাদকীয়
রমনা কালীবাড়ি বধ্যভূমি

বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে। প্রায় ৫০০ বছর আগে বদ্রী নারায়ণের যোশী মঠের সন্ন্যাসী গোপাল গিরি ঢাকায় এসে রমনায় প্রথমে একটি আখড়া স্থাপন করেন। তখন এ আখড়াটি কাঠঘর নামে পরিচিত ছিল।

পরে সম্ভবত ১৭ শতকের প্রথম দিকে এ স্থানেই হরিচরণ গিরি মূল মন্দিরটি নির্মাণ করেন। কালীবাড়ি মন্দিরটি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়। তারা মন্দির ও আশ্রমটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মন্দিরের সেবায়েতসহ প্রায় ১০০ সন্ন্যাসী, ভক্ত এবং সেখানে বসবাসরত সাধারণ মানুষ নিহত হন। যদিও এখন বধ্যভূমির কোনো চিহ্ন নেই। তবে সেটাকে বধ্যভূমি হিসেবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ছবি: সংগৃহীত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত