Ajker Patrika

মানবতা নেই দেয়ালেও

সাখাওয়াত ফাহাদ, ঢাকা
মানবতা নেই দেয়ালেও

বিগত প্রায় দুই বছর ধরে চলছে করোনা। মহামারি দেখিয়ে দিচ্ছে চরম বাস্তবতা আর অমানবিকতার চূড়ান্ত রূপ। অক্সিজেনের অভাবে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটছে মানুষ। অসহায় দিন কাটাচ্ছে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী, দিনমজুরেরা। রাস্তা, ফুটওভার ব্রিজে বেড়েছে ভ্রাম্যমাণ বাস্তুহীন মানুষের সংখ্যা। নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন প্রায় ২ কোটি মানুষ। এমন এক অনিশ্চিত বাস্তবতায় যান্ত্রিক শহরের মানবিকতার খোঁজ করতে গিয়ে দেখা যায়, মানবিকতা আছে কেবল কথায়, মুখে।  খোদ মানবিকতা নেই ‘মানবতার দেয়ালগুলোতেও’।

গত বছর মাগুরার আড়পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইয়াসমিন আখতার এবং কিশোরগঞ্জের দক্ষিণ মুকসুদপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক তানজীনা নাজনীন মিষ্টির এই মানবিক উদ্যোগটি রাজধানীসহ পুরো দেশে বেশ সাড়া ফেলেছিল। দেয়ালে ‘আপনার অপ্রয়োজনীয় কাপড় এখানে রেখে যান, প্রয়োজনীয় কাপড় নিয়ে যান’ লিখে সেখানে অসহায়, সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য কাপড় ঝুলিয়ে রাখা হতো। কিন্তু গতকাল বুধবার শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ মানবতার দেয়াল গুলোই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। 

গোড়ানের হাওয়াই গলির মুখেই ছিল একটি মানবতার দেয়াল। কিন্তু সেখানে এখন সাদা রং করে ফেলা হয়েছে। স্থানীয় এলাকাবাসী মেহেদী হাসান জানান, শীতের সময় শুরুতে বেশ কিছুদিন এখানে প্রতিনিয়ত কাপড় থাকলেও একটা সময় পর এখানে আর কেউ কাপড় রাখত না। তিনি বলেন, ‘দেওয়ার চেয়ে নেওয়ার লোক অনেক বেশি। শুরুতে বেশ কাপড় রাখা থাকত। আস্তে আস্তে কমতে শুরু করে। অনেক দিন এমনিতেই পড়ে ছিল দেয়ালটি।’ 

সেগুনবাগিচা হাই স্কুলের পাশের মানবতার দেয়ালটি বৃষ্টি এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। সবজি ব্যবসায়ী লিয়াকত মোল্লা বলেন, ‘এইখানে দেওয়ালে মানুষজন কাপড়-চোপড় রাখত। যাদের কাপড় কিনার একেবারেই সামর্থ্য নাই তারা এই দেয়ালের দিকে চায়া থাকত। কিন্তু বৃষ্টিতে দেওয়ালটা নষ্ট হইয়া গেছে। কেউ যদি দায়িত্ব নিয়া একটু মেরামতে রাখত তাইলে খুব ভালো হইতো।’ 

দৈনিক বাংলা মোড়ে দেখা যায়, একটি লেগুনা রাস্তার মাঝখানেই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যাত্রীরা নেমে যাচ্ছেন। লেগুনা চালক যাত্রীদের ধাক্কা দেওয়ার অনুরোধ জানালেও কেউ কানে তুলছেন না। উপায়ান্তর না পেয়ে নিজেই গাড়িটি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন। লেগুনা চালক জহির বলেন, ‘গাড়ির গ্যাস শেষ হয়ে যাওয়ায় গাড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে। বললাম একটু ধাক্কা দিয়ে ফিলিং স্টেশনটার কাছে নিয়ে দিতে কিন্তু কেউ কানেই নিল না। মাইনসের মধ্যে আর কোনো মানবিকতাই নাই।’ 

পল্টন থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার যাওয়ার সময় নওগাঁর রিকশাচালক আব্দুল কুদ্দুস জানালেন, শহরে কোথাও মানবিকতা খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখানে সবাই নিজের দৌড় দৌড়াচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এই ঢাকা শহরে মানবিকতা পাইবেন কোথায়? মানবিকতা আছে হামাগের গেরামের মসজিদের পুকুর ঘাটে। সেখানে সবাই কাপড় কাচে, গোসল করে। বিকালে ওইখানে আড্ডাও চলে। প্রতি শুক্রবারে খাওন দেয়। কারো কোন মানা নাই।’ 

মানবিক দিক বিবেচনা করে দোকানপাট খোলা রাখার কথা বললেও গণমাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ভিড় নিয়ে সমালোচনা হওয়ায় সব দোকানপাট বন্ধ করে দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অনেকটা মাথা ব্যথা হওয়ায় মাথা কেটে ফেলার মতো অবস্থা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজেদের অব্যবস্থাপনা এবং দায়িত্বহীনতার দায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ওপর চাপাচ্ছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান গেটের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘লকডাউনে এত দিন দোকান বন্ধ ছিল। দুই দিন হলো ঠিকঠাক খুললাম। এখন আবার বন্ধ করে দিল। এমন অবস্থা হলে আমরা বাঁচব কীভাবে?’

ব্রাজিলের অধিবাসী সেরগিও ভিয়েরা দ মেলো জাতিসংঘের কূটনীতিক হিসেবে কাজ করার সময় ৩৪ বৎসরেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন মানবিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০০৩ সালে তিনি যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইরাকে যান এবং বাগদাদে কাজ শুরু করেন। সেখানে ১৯ আগস্ট এক বোমা হামলায় ২১ জন সহকর্মী সহ তিনি মারা যান। প্রায় তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যাঁরা যুদ্ধে সব হারিয়েছেন, সেই সব সর্বহারা মানুষের পাশে নিঃস্বার্থভাবে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি।

সেরগিও ভিয়েরা দ মেলো ও তাঁর সহকর্মীদের প্রয়াণ দিবসটিকে জাতিসংঘ ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ‘বিশ্ব মানবতা দিবস’ হিসেবে অধিভুক্ত করে এবং ২০০৯ সালের ১৯ শে আগস্ট প্রথমবারের মতো বিশ্ব মানবতা দিবস পালিত হয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত