Ajker Patrika

যুবক-ডেসটিনির পথেই কি ই-কমার্স গ্রাহকদের ভাগ্য

সাজ্জাদ মাহমুদ খান ও অর্চি হক, ঢাকা
যুবক-ডেসটিনির পথেই কি  ই-কমার্স গ্রাহকদের ভাগ্য

২০১১ সালে এমএলএম প্রতিষ্ঠান ডেসটিনিতে পণ্য কিনতে দেড় লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন বেলাল। বহু ধাপ বিপণনব্যবস্থায় কয়েক মাসে ১৫ হাজার টাকা আয় করেন। এভাবে লাভ দেখে আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার করে আরও দেড় লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন তিনি। এরপর একদিন হঠাৎ করে লাভের টাকা আসা বন্ধ হয়ে যায়।

ডেসটিনির বেলালের মতো কয়েক লাখ মানুষ ইউনিপে টু ইউ, যুবকসহ বিভিন্ন এমএলএম কোম্পানিতে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে নিঃস্ব হয়েছেন। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ইভ্যালি, ধামাকা শপিং বা ই-অরেঞ্জের মতো ই-কমার্সে বিনিয়োগ করা গ্রাহকদেরও একই পরিণতি হবে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে কীভাবে গ্রাহকেরা টাকা ফেরত পাবেন, সে ব্যাপারে পরিষ্কার করে কিছু বলতে পারছে না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো।

 অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো কোনোভাবেই গ্রাহকদের প্রতারণার দায় এড়াতে পারে না। প্রশাসন তাঁদের গ্রেপ্তার করল এবং শাস্তিও দিল। কিন্তু যাঁরা প্রতারণার শিকার হলেন, তাঁরা টাকা ফেরত না পেলে ভুক্তভোগীদের তো কোনো লাভ হবে না। 

 ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রোমানা হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, একটি প্রতিষ্ঠানের সম্পদের চেয়ে যদি দেনা বেশি থাকে, তাহলে তো গ্রাহকদের টাকা ফেরত পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে যায়। এ ছাড়া মামলার তদন্ত ও বিচারের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতার কারণেও গ্রাহকেরা হয়রানির শিকার হন। তাঁরা আর টাকা ফেরত পাবেন না।

ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ রাসেলের বরাত দিয়ে র‍্যাব বলছে, তাঁর দেনা হাজার কোটি টাকা। গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার মতো অর্থ তাঁর নেই। তিনি বড় বিনিয়োগ পেলে টাকা ও পণ্য ফেরত দিত পারবেন। না হলে পৃথিবীর অন্যান্য কোম্পানির মতো নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করতেন।

তাঁর মতো গ্রাহকদের ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমান বর্তমানে কারাগারে আছেন। প্রতিষ্ঠানটির কথিত হোতা বনানী থানার সাময়িক বরখাস্ত হওয়া পরিদর্শক (তদন্ত) সোহেল রানা ভারতে আটক হয়েছেন।

আরেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ধামাকা শপিংয়ের বিরুদ্ধে ৫ লাখ গ্রাহকের ৮০৩ কোটি ৫১ লাখ টাকা ও সরবরাহকারীর ২০০ কোটি মিলে মোট ১ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে দুই মাস অনুসন্ধান করে অন্তত ৮৯ কোটি টাকা মানি লন্ডারিংয়ের প্রমাণ পেয়েছে সিআইডি। অসুস্থতার অজুহাতে কোম্পানিটির মূল মালিক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জসিমউদ্দিন চিশতি পাড়ি জমিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে।

বাজারমূল্যের অর্ধেক দামে গ্রাহকদের ফ্রিজ, কম্পিউটার, ল্যাপটপসহ বিভিন্ন পণ্য দেওয়ার নামে ৭৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল নিরাপদ ডটকম। গত ১১ জুলাই গ্রেপ্তার হন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহরিয়ার খান। বুমবুম ডটকম, কিউকম, শ্রেষ্ঠ ডটকমসহ ডজনখানেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে টাকা নিয়েও গ্রাহকদের পণ্য না দেওয়ার অভিযোগ উঠছে।

প্রতারিত গ্রাহকদের টাকা ফেরত পাওয়া প্রসঙ্গে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের মহাপরিচালক বাবলু কুমার সাহা আজকের পত্রিকাকে বলেন, কেউ অভিযোগ করলে এ ধরনের ঘটনায় সর্বোচ্চ শাস্তি ২ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে। এই ২ লাখ টাকা জরিমানা করলে অভিযোগকারী পাবেন ৫০ হাজার টাকা। পাশাপাশি প্রতারণাকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হতে পারে।  

এমএলএমে প্রতারিতরা ফেরত পাননি অর্থ
 অর্থ পাচার ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি এবং ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশন লিমিটেডের বিরুদ্ধে করা মামলার বিচার শেষ হয়নি দীর্ঘ ৯ বছরেও। নিম্ন আদালতে ডেসটিনির মামলা পরিচালনাকারী দুদকের বিশেষ পিপি মীর আহম্মেদ আলী সালাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির মামলার এখন তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। এ মামলায় প্রায় ৩০০ জন সাক্ষীর মধ্যে ২০২ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।

ডেসটিনির ট্রি-প্ল্যান্টেশনের মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। কো-অপারেটিভ সোসাইটির মামলাটি শেষ হলেই অন্যটি দ্রুত এগিয়ে নেওয়া হবে। 

রাজধানীর কলাবাগান থানায় ২০১২ সালের ৩১ জুলাই প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের দুটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ডেসটিনি গ্রুপের এমডি রফিকুল আমীনসহ ১২ জনের নাম দুটি মামলাতেই রয়েছে। ৪ হাজার ১১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং এর মধ্যে ৯৬ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ আনা হয় আসামিদের বিরুদ্ধে।

তবে ডেসটিনির হিসাব অনুযায়ী, তাদের মোট গ্রাহক, পরিবেশক ও বিনিয়োগকারী ছিল ৪৫ লাখ। ৩৪টি প্রতিষ্ঠানের মোট সম্পদ ৯ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা। ২২ জেলায় রয়েছে তাদের সম্পদ।

১৯৯৬ সালে নিবন্ধন নিয়ে কাজ শুরু করে যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি (যুবক)। এরপর বেশি লাভের লোভ দেখিয়ে জনগণের কাছ থেকে সঞ্চয় সংগ্রহ করতে শুরু করে। যুবকের ৩ লাখ ৩ হাজার ৭৩৯ জন গ্রাহকের দাবির পরিমাণ ২ হাজার ৫৮৮ কোটি ১১ লাখ টাকা। প্রতারণার অভিযোগে ২০০৬ সালে যুবকের কার্যক্রমও বন্ধ করে দেয় সরকার। যুবকে যাঁরা টাকা দিয়েছেন, তাঁরা সেই টাকা আজও ফেরত পাননি। 

২০০৯ সালের অক্টোবরে এমএলএম ব্যবসা শুরু করে ইউনিপে টু ইউ। মাত্র দেড় বছরের মধ্যে ৬ লাখ বিনিয়োগকারীর ৬ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতিষ্ঠানটি। ইউনিপে টু ইউর চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ মোট ছয়জন কর্মকর্তাকে ১২ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। ২০১১ সালের পর ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি রায়ে দণ্ডিত হয়ে এখন কারাগারে রয়েছেন ইউনিপে টু ইউর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ মুনতাসির হোসেন, ব্যবস্থাপক জামশেদ রহমান ও পরিচালক আরশাদ উল্লাহ। বাকি তিনজন পলাতক। ২ হাজার ৭০২ কোটি ৪১ লাখ ১১ হাজার ৭৮৪ টাকা ১৪ পয়সা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। এই টাকাও আদায় হয়নি। গ্রাহকেরাও তাঁদের বিনিয়োগ ফিরে পাননি। এই অবস্থায় ইভ্যালির গ্রাহকেরাও টাকা ফেরত পাবেন না, তা সহজেই অনুমেয়।

 জানতে চাইলে আইনজীবী শাহদীন মালিক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ফৌজদারি আইনে মামলা করলে অপরাধীর বিচার হবে। কিন্তু প্রতারিত গ্রাহকেরা আর টাকা ফেরত পাবেন না। এসব ঘটনায় দেওয়ানি আইনে মামলা হলে বিচার শেষে বিবাদীর মালামাল জব্দ করা হয়। সেখান থেকে ভুক্তভোগীরা তাঁদের অর্থ ফেরত পেতে পারেন। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেওয়ানি মামলা করা হয় না। 

বিষয়:

ই-কমার্স
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত