Ajker Patrika

জাবির ইবনে হাইয়ান: রসায়নশাস্ত্রকে অধিবিদ্যা থেকে বিজ্ঞানে উন্নীত করেন যিনি

মুফতি আবু আবদুল্লাহ আহমদ 
জাবিরের পাতন প্রণালী। ছবি: অ্যাবাউট ইসলাম
জাবিরের পাতন প্রণালী। ছবি: অ্যাবাউট ইসলাম

জাবির ইবনে হাইয়ান (৭২১–৮১৫ খ্রিষ্টাব্দ), যিনি ‘গেবার’ নামেও পরিচিত, ছিলেন ইসলামের সোনালি যুগের একজন প্রতিভাবান রসায়নবিদ, দার্শনিক ও বহুমুখী বিজ্ঞানী। তাঁকে আধুনিক রসায়নের পথিকৃৎ বলা হয়। তাঁর অগণিত গবেষণা, উদ্ভাবন ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ শুধু বিজ্ঞানকে নয়, সভ্যতাকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।

প্রাথমিক জীবন

জাবির ইবনে হাইয়ান ৭২১ খ্রিষ্টাব্দে পারস্যের খোরাসানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা একজন ওষুধ প্রস্তুতকারক ছিলেন এবং তিনি সম্ভবত তাঁর পিতার কাছ থেকেই প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি ইরাকের কুফায় চলে যান এবং খলিফা হারুন অর-রশিদের অধীনে কাজ করেন। তাঁর জীবন ও কাজ সম্পর্কে অনেক তথ্যই কিংবদন্তি এবং ঐতিহাসিক উৎস থেকে এসেছে, যা অনেক সময় পরস্পরবিরোধী হতে পারে। তবে এ কথা নিশ্চিত যে জাবির ছিলেন এক বিস্ময়কর মেধাবী এবং গবেষক। (জি সালিবা, ২০০৭, ইসলামিক সায়েন্স অ্যান্ড দ্য মেইকিং অব দ্য ইউরোপিয়ান রেনেসাঁ)

রসায়নে অবদান

জাবির ইবনে হাইয়ানের প্রধান খ্যাতি রসায়ন শাস্ত্রে। তিনি রসায়নকে প্রাচীন ‘আলকেমি’ থেকে বিজ্ঞানের মর্যাদায় উন্নীত করেন। তাঁর কাজের মূল দিকগুলো হলো—

পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের ভূমিকা: জাবির প্রথমবারের মতো পরীক্ষানির্ভর গবেষণার ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, ‘পরীক্ষা না করে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত নয়।’ (এ ম্যাকলিন, ২০০৭, আলকেমিক্যাল ট্র্যাডিশনস: ফ্রম ইন্টিকুইটি টু দ্য অ্যাভেন্ট-গ্রেড)

আধুনিক রাসায়নিক প্রক্রিয়া আবিষ্কার: তিনি বহু রাসায়নিক প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন, যেমন: পাতন (ডিসটিলেশন), গলন (মেল্টিং), বিশুদ্ধকরণ (পিউরিফিকেশন), স্ফটিকীকরণ (ক্রিস্টালাইজেশন) ইত্যাদি। তাঁর আবিষ্কৃত ‘আলেম্বিক’ যন্ত্রটি আধুনিক পরীক্ষাগারে পাতনের প্রাথমিক যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। (এম এম পোস্টান, ১৯৩৯, দ্য হিস্টোরি অব কেমিস্ট্রি)

অম্ল ও ক্ষারের গবেষণা: জাবির অম্ল (অ্যাসিড) ও ক্ষার (বেইজ) নিয়ে গবেষণা করেন এবং প্রথমবারের মতো সালফিউরিক এসিড, নাইট্রিক এসিড এবং হাইড্রোক্লোরিক এসিড প্রস্তুত করেন। (পি এম পেটেল, ২০১৬, জাবির ইবনে হাইয়ান: দ্য ফাদার অব দ্য কেমিস্ট্রি)

ধাতুর প্রকৃতি বিশ্লেষণ: তিনি ধারণা দেন যে ধাতুসমূহ মূলত এক ধরনের মৌলিক উপাদান থেকে গঠিত এবং বিভিন্ন ধাতুর মধ্যে রূপান্তর সম্ভব। যদিও আধুনিক বিজ্ঞান এই ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছে, এটি রসায়নের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। (জি সালিবা, ২০০৭, ইসলামিক সায়েন্স অ্যান্ড দ্য মেইকিং অব দ্য ইউরোপিয়ান রেনেসাঁ)

সাহিত্যকর্ম

জাবিরের লেখা হাজারের বেশি বই রয়েছে বলে মনে করা হয়, যার মধ্যে অনেকগুলোর অনুবাদ লাতিন ভাষায় করা হয়েছে। তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থগুলো হলো:

কিতাব আল-কিমিয়া (দ্য বুক অব কেমিস্ট্রি) : এটি মধ্যযুগে অত্যন্ত প্রভাবশালী একটি গ্রন্থ। (এ ম্যাকলিন, ২০০৭, আলকেমিক্যাল ট্র্যাডিশনস: ফ্রম ইন্টিকুইটি টু দ্য অ্যাভেন্ট-গ্রেড)

কিতাব আল-তাজমিয়াত: যেখানে ধাতুর স্ফটিকায়ন নিয়ে আলোচনা রয়েছে।

কিতাব আল-হিজাব: রসায়নের গভীরতর তত্ত্ব নিয়ে লেখা। (এম এম পোস্টান, ১৯৩৯, দ্য হিস্টোরি অব কেমিস্ট্রি)

রসায়নে জাবিরের প্রভাব

জাবিরের কাজ শুধু ইসলামি জগতে সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি ইউরোপীয় রেনেসাঁর রসায়নবিদদের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। ‘গেবার’ নামে তাঁর কাজ লাতিন ভাষায় অনূদিত হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হত। তিনি আধুনিক বিজ্ঞানীদের জন্য একটি দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করেন। (এ ম্যাকলিন, ২০০৭, আলকেমিক্যাল ট্র্যাডিশনস: ফ্রম ইন্টিকুইটি টু দ্য অ্যাভেন্ট-গ্রেড)

দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি

জাবির কেবল বিজ্ঞানীই ছিলেন না, তিনি একজন গভীর দার্শনিকও ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে প্রকৃতির সবকিছু একটি নির্দিষ্ট নিয়ম ও সাদৃশ্যের মধ্যে আবদ্ধ। তাঁর কাজ ‘তত্ত্ব ও গবেষণা’র মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করে। (জি সালিবা, ২০০৭, ইসলামিক সায়েন্স অ্যান্ড দ্য মেইকিং অব দ্য ইউরোপিয়ান রেনেসাঁ)

উত্তরাধিকার

জাবির ইবনে হাইয়ানের কাজ আজও বিজ্ঞান, বিশেষত রসায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিনি পরীক্ষালব্ধ জ্ঞান ও যৌক্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিজ্ঞানকে একটি সুসংগঠিত শাস্ত্রে পরিণত করেন। (ই মাসুদ, ২০০৯, সায়েন্স অ্যান্ড ইসলাম: আ হিস্টোরি)

উপসংহার

জাবির ইবনে হাইয়ান ছিলেন এমন একজন বিজ্ঞানী, যিনি বিজ্ঞানের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিয়েছিলেন। তাঁর আবিষ্কার, গবেষণা ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করে। তাঁর জীবন থেকে আমরা শিখি যে জ্ঞান এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা কেবল বিজ্ঞানকেই সমৃদ্ধ করে না, বরং তা মানবসভ্যতার জন্য অমূল্য দিকনির্দেশনা দেয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

নতুন মেট্রো নয়, রুট বাড়ানোর চিন্তা

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত সড়ক কার্পেটিং বিচারপতি খিজির হায়াতের, প্রমাণ পেয়েছে দুদক

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত