Ajker Patrika

নেলসন ম্যান্ডেলার কারাজীবনের যে গল্পটি সত্য নয়

ফ্যাক্টচেক ডেস্ক
আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭: ১৯
নেলসন ম্যান্ডেলার কারাজীবনের যে গল্পটি সত্য নয়

১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, দীর্ঘ ২৭ বছর কারাভোগ শেষে মুক্ত হন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি নেলসন ম্যান্ডেলা। দেশটির কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। নেলসন ম্যান্ডেলার কারাজীবন নিয়ে ইন্টারনেটে বহুল প্রচলিত গল্প আছে। 

গল্পটি দীর্ঘ ২৭ বছর কারাগারে থাকা নেলসন ম্যান্ডেলাকে কারাগারে পানির বদলে প্রস্রাব খেতে দিত। সূর্যের আলো দেখেননি কারাবন্দী অবস্থায়। নেলসন ম্যান্ডেলা কারামুক্তির পর, তিনি আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হলেন। একদিন শহরের অলিগলি ঘুরে হঠাৎ ক্ষুধা লাগলে সহকর্মীদের তিনি বললেন, ‘সামনে যেখানে খাবারের রেস্তোরাঁ থাকে, সেখানে আমরা সবাই খাব। তখন তার সহকর্মীরা অবাক হলেন। তারপর একটি সাধারণ রেস্তোরাঁয় সবাইকে নিয়ে টেবিলে খেতে বসলেন।’

তার পাশের টেবিলে একটি বয়স্ক লোককে দেখে বললেন, ‘তাঁকে তাদের খাবার টেবিল নিয়ে একসঙ্গে খাবারের জন্য পাশে ডেকে বসালেন ও বললেন, ওনার খাবারের বিলও আমরা পরিশোধ করব। খাবার খেতে খেতে দুজন গল্প করলেন। কিন্তু ওই বয়স্ক লোকটি কিছুই খেতে পারছিল না। নেলসন ম্যান্ডেলা তাঁর মুখে খাবার তুলে খাওয়ালেন। তারপর বয়স্ক লোকটি বিদায় নিলেন। উনি ঠিকমতো দাঁড়াতেই পারছিলেন না, তখন তিনি সহকর্মীদের গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিতে বললেন। বয়স্ক লোকটি রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে পড়ে যেতে চেয়েছিলেন, তাকে উঠে দাঁড় করালেন। তার এক সহকর্মী প্রশ্ন করল, উনি হয়তো অসুস্থ।’ 

তখন নেলসন ম্যান্ডেলা বললেন, ‘আমি যখন কারাগারে ছিলাম, উনি ওই কারাগারের কারারক্ষী ছিলেন। কারাবন্দী অবস্থায় ওই লোকটি আমাকে বেদম মারতো, আমি পানি চাইলেই পানির বদলে আমার শরীরে প্রস্রাব ছুড়ে মারতেন। আমি আজ দেশের প্রেসিডেন্ট, উনি আমার মুখে প্রস্রাব দিয়েছেন এবং আমাকে মেরেছেন। আমি তাঁর পরিবর্তে তাঁর মুখে খাবার তুলে দিয়েছি, উনি যখন পড়ে গিয়েছিলেন উঠে দাঁড়ানোর জন্য আমি তাকে সাহায্য করেছি। আমি এখন সবার প্রেসিডেন্ট। আমার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও আমি ক্ষমতার প্রয়োগ করিনি। তিনি বলেছিলেন, আমি মনে করি, আমার কাছে দেশের প্রত্যেকটা নাগরিকের ভালোমন্দ দেখাশোনা করা এটাই আমার কাজ।’

নেলসন ম্যান্ডেলার কারাজীবন নিয়ে প্রচারিত এ গল্প কি সত্য? কারাগারে কি তিনি এমন কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন? 
গল্পটির সত্যতা যাচাইয়ে নেলসন ম্যান্ডেলার বিভিন্ন উক্তির অনলাইন সংগ্রহশালা অক্সফোর্ড রেফারেন্সে খুঁজে তাঁর বর্ণনায় এমন কোনো ঘটনা সম্পর্কে জানা যায় না। অনুরূপভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারি বার্তা সংস্থা সাউথ আফ্রিকান গভর্নমেন্ট নিউজ এজেন্সির ওয়েবসাইটনেলসন ম্যান্ডেলা ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে নেলসন ম্যান্ডেলার জীবনের বিভিন্ন বিখ্যাত উক্তির একটি সংগ্রহ পাওয়া যায়। এসব ওয়েবসাইটেও কারাজীবন পরবর্তী সময়ে নেলসন ম্যান্ডেলার বর্ণনায় এমন কোনো ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়নি।  

গল্পটির সত্যতা যাচাইয়ে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক (আইএফসিএন) স্বীকৃত আফ্রিকাভিত্তিক ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান আফ্রিকা চেক নেলসন ম্যান্ডেলা ফাউন্ডেশনের আর্কাইভ অ্যান্ড রিসার্চ ডিরেক্টর রাজিয়া সালেহের সঙ্গে যোগাযোগ করে। 

তিনি আফ্রিকা চেককে বলেন, নেলসন ম্যান্ডেলার নামে প্রচারিত এ ঘটনা সম্পর্কে আমাদের কাছে অনেকেই জানতে চেয়েছেন। তবে এটি সত্য নয়। নেলসন ম্যান্ডেলা সব সময়ই বলতেন, তিনি কারাগারে কখনো নির্যাতনের শিকার হননি। পাশাপাশি কারাগারে কোনো কারারক্ষী বা অন্য কেউই তাঁকে কখনো প্রস্রাব খেতে দেননি। 

নেলসন ম্যান্ডেলার কারাজীবন নিয়ে ইন্টারনেটে প্রচারিত গল্পটি সত্য নয়প্রতিষ্ঠানটি নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে প্রচারিত এই গল্পের উৎস বের করতে পারেনি। তবে প্রতিষ্ঠানটি নিশ্চিত করেছে, এই ঘটনা সত্য হওয়ার কোনো প্রমাণও নেই। অর্থাৎ কারাগারে নেলসন ম্যান্ডেলাকে পিপাসা পেলে কারারক্ষী কর্তৃক প্রস্রাব বা ক্ষুধার সময় পচা দুর্গন্ধযুক্ত খাবার দেওয়ার ঘটনাটি বানোয়াট, ভিত্তিহীন।  

ম্যান্ডেলা তাঁর ২৭ বছরের কারাজীবনের মধ্যে প্রথম ১৮ বছর কাটান রোবেন দ্বীপের ভয়ানক কারাগারে। ছোট্ট একটি সেলে রাখা হয় তাঁকে, ছিল না কোনো বিছানা। বাধ্য করা হয়েছিল একটি পাথরের খনিতে কঠোর পরিশ্রম করতে। বাইরের জগতের সঙ্গে ছিলেন প্রায় যোগাযোগবিচ্ছিন্ন। প্রতি ছয় মাসে একটি চিঠি লিখতে পারতেন। তেমনি এ সময়ের মধ্যে একটি চিঠি পেতে পারতেন। বছরে একবার তাঁকে ৩০ মিনিটের জন্য এক দর্শনার্থীর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়। 

ওই কারাগারেই ক্রিস্টো ব্র্যান্ড নামে এক আফ্রিকান শ্বেতাঙ্গ কারারক্ষী নেলসন ম্যান্ডেলার আদর্শ, আচরণে মুগ্ধ হয়ে তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। ক্রিস্টো ব্র্যান্ড যখন ১৯৭৮ সালে রোবেন দ্বীপের কারাগারে যোগ দেন, তখন তাঁর বয়স ছিল ১৮। নেলসন ম্যান্ডেলার সংস্পর্শে এসে তাঁর ও দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী আচরণ সম্পর্কে ক্রিস্টো ব্র্যান্ডের ধারণা বদলে যায়। 

ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে ২০০৭ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ক্রিস্টো ব্র্যান্ডকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ‘আমি যখন রোবেন দ্বীপের কারাগারে আসি, নেলসন ম্যান্ডেলার বয়স তখন প্রায় ৬০ বছর। আমার সঙ্গে তিনি খুব ভালো আচরণ করতেন এবং তাঁর জন্য আমার মনে সম্মান বাড়তে থাকে। কারারক্ষী হওয়া সত্ত্বেও কিছুদিন পর নেলসন ম্যান্ডেলা ও আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এটি ছিল কারাগারের গরাদের ব্যবধানে গড়ে ওঠা এক বন্ধুত্বের সম্পর্ক।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ফোন-ইন্টারনেট ভাতা পাচ্ছেন মাঠ প্রশাসনের সব কর্মচারী

ভাড়া বাড়িতে চলা ১৬ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিসহ সব শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ

পিপির বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব ৪৯ জন সহকারী পিপির

জোবাইদার নিরাপত্তার নামে প্রতিবেশীদের বিরক্ত না করার নির্দেশ তারেক রহমানের

শান্ত যে কারণে টি-টোয়েন্টি দলে, মিরাজ কেন নেই

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত