Ajker Patrika

সমরাস্ত্রের বাজারে বাংলাদেশের কদর

কূটনৈতিক প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০২১, ১৫: ০৪
সমরাস্ত্রের বাজারে বাংলাদেশের কদর

বিশ্বের সমরাস্ত্রের বিক্রেতাদের নজর এখন বাংলাদেশের দিকে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, তুরস্ক, জাপান, জার্মানি, রাশিয়া, ইতালির কাছে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও অত্যাধুনিক অস্ত্রের সম্ভাব্য ক্রেতা। সে কারণে এসব দেশ থেকে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ও সমরাস্ত্র বিক্রির বিভিন্ন প্রস্তাবও বাংলাদেশের কাছে এসেছে।

পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেছেন, পশ্চিমা দেশগুলো এখন বাংলাদেশের কাছে অত্যাধুনিক অস্ত্র বিক্রিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। এসব প্রস্তাব যাচাই-বাছাইয়ের পর বাংলাদেশের সক্ষমতা অনুযায়ী দাম, মান ও কৌশলগত দিক বিবেচনা করে সেগুলো নেওয়া হবে।

দেশের সামরিক বাহিনীগুলোকে আধুনিকায়নের উদ্দেশ্যে ২০০৯ সালে প্রথম ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’ গ্রহণ করে বাংলাদেশ। ২০১৭ সালে তা সংশোধন করা হয়। এর মাধ্যমে দেশের সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীকে যুগোপযোগী ও আধুনিক করার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়। তারই অংশ হিসেবে আধুনিক সমরাস্ত্র কেনার বিষয়টি সামনে আসছে।

তা ছাড়া পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের পরিবর্তন এনেছে বাংলাদেশ। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে কৌশলগত পর্যায়ে নিয়ে গেছে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ায় বাংলাদেশকে নিয়মিত বাণিজ্যের পাশাপাশি সমরাস্ত্রের সম্ভাব্য বাজার হিসেবে বিবেচনা করছে পশ্চিমা দেশগুলো। সে কারণে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক চর্চা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা, বিচারব্যবস্থাকে আরও কার্যকরী করা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্বাচন, নির্বাচন কমিশন গঠন, বিরোধী মতকে প্রাধান্য না দেওয়ার মতো ইস্যুগুলো নিয়ে আগের মতো সমালোচনা করছে না পশ্চিমারা। বাংলাদেশকে না চটিয়ে ব্যবসায় মনোযোগ দিয়ে কৌশলে পরিবর্তন করছে তারা।

পাশাপাশি চীনকে ঠেকাতে ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল তো রয়েছেই। সেই দলেও বাংলাদেশকে নিতে চায় পশ্চিমারা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এত দিন আর্থিক সক্ষমতার অভাবে চীন থেকে কম দামে সমরাস্ত্র সংগ্রহ করেছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারও স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশে অস্ত্রের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশই চীনের তৈরি। বাংলাদেশ এখন সেই অনুপাত কমানোর দিকে মনোযোগ দিয়েছে। আগে পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশকে অস্ত্র বিক্রির জন্য বিবেচনা করত না। অত্যাধুনিক দামি অস্ত্র নেওয়ার ক্ষমতা নেই বলেই মনে করত। এখন তাদের মধ্যেও এ অবস্থার পরিবর্তন এসেছে।

পররাষ্ট্রসচিব বলেন, বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় মাথায় রেখে কাজ করছে। প্রথমটি হলো দাম। যে সক্ষমতা রয়েছে, তার মধ্যে থেকেই অস্ত্র সংগ্রহ করবে বাংলাদেশ। দ্বিতীয়টি হলো অস্ত্রের গুণগত মান। এ জায়গাটিতে জোর দেবে বাংলাদেশ। সাশ্রয়ী মূল্যে ভালো মানের অস্ত্র সংগ্রহে ভূমিকা পালন করবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আর সর্বশেষ হলো কৌশলগত দিক বিবেচনা। ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কৌশলগত দিক বিবেচনায় সমরাস্ত্র সংগ্রহ করবে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি দেশ অস্ত্র বিক্রিতে যথেষ্ট আগ্রহ দেখাচ্ছে বলেও জানান মাসুদ বিন মোমেন।

সূত্র জানায়, চলতি বছরের জুনে তুরস্কের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও সমরাস্ত্রবিষয়ক চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে তুরস্কের তৈরি অস্ত্র কেনা, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং যৌথ উৎপাদনের মতো বিষয়গুলো রয়েছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এসেছে।

তুরস্কের গণমাধ্যম আনাদোলুর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালের প্রথম চার মাসে ১০০ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশের মধ্যে ৬ কোটি ডলারের পণ্য কিনেছে বাংলাদেশ। বিমানবাহিনীর জন্য তুরস্ক থেকে লেজার গাইডেড মিসাইল টাইগার মিসাইল সিস্টেম এবং নৌবাহিনীর জন্য অ্যান্টি-শিপ মিসাইল কেনা হয়েছে। এ ছাড়া ভূমি থেকে ভূমিতে এবং এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম বা আকাশ সুরক্ষার সমরাস্ত্র কিনেছে।

পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন

ইতিমধ্যে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর কাছে পাঁচটি সি-১৩০ পরিবহন উড়োজাহাজ বিক্রি করেছে যুক্তরাজ্য। বাংলাদেশ নৌবাহিনী বেশ আগে থেকেই যুক্তরাজ্য থেকে জাহাজ সংগ্রহ করে থাকে। দেশটি থেকে পাঁচটি যুদ্ধজাহাজ কিনবে বাংলাদেশ। এর তিনটি জাহাজ যুক্তরাজ্য থেকে রপ্তানি করা হবে। আর বাকি দুটি জাহাজ বাংলাদেশে যৌথভাবে তৈরি হবে। এ ছাড়া দেশটি বাংলাদেশের কাছে ইউরো ফাইটার, টাইফুন বিমান ও আরও সি-১৩০ পরিবহন উড়োজাহাজ বিক্রি করতে চায়।

চলতি বছরের মে মাসে বাংলাদেশ ও জার্মান প্রশিক্ষণ বিমান সরবরাহের চুক্তি করে। জার্মানির গ্রোব এয়ারক্রাফট বাংলাদেশ বিমানবাহিনীকে ২৪টি প্রশিক্ষণ বিমান বিক্রি করবে। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফ্রান্স সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা-বিষয়ক সম্মতিপত্র সই হয়েছে। দেশটি বাংলাদেশের কাছে রাফালসহ অন্যান্য পরিবহন বিমান ও সমরাস্ত্র বিক্রি করতে চায়।

এ ছাড়া স্পেন বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, নেদারল্যান্ডস নৌবাহিনীর জন্য জাহাজ, জাপান নৌ-প্রতিরক্ষায় সহযোগিতা বৃদ্ধিসহ ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র এবং বেশ কিছু কনসোর্টিয়াম বাংলাদেশের কাছে জঙ্গিবিমান, হেলিকপ্টার, সাবমেরিন, বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, মাইন সুইপারসহ বিভিন্ন অস্ত্র বিক্রির প্রস্তাব নিয়ে এসেছে।

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও রাষ্ট্রদূত মো. তৌহিদ হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ৩০ বছর আগেও সামরিক শক্তিতে বাংলাদেশের থেকে পিছিয়ে ছিল মিয়ানমার। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। আর সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকবার মিয়ানমার বাংলাদেশকে উসকানি দিয়েছে। ফলে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য এখন সময়ের দাবি।

পশ্চিমা মিশনের এক রাজনৈতিক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, একসময় ওডিএর (উন্নয়ন সহযোগিতা) পরিমাণ অনেক বেশি ছিল। তখন যে সরকারই থাকুক না কেন, তাদের ওপর পশ্চিমাদের খবরদারি বেশি ছিল। কিন্তু ওডিএ কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমাদের সেই শক্তিও কমে গেছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ২০০১ সালে বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের চুক্তি হয়েছিল সুশাসন, মানবাধিকার, বাণিজ্য ও বিনিয়োগকে সামনে রেখে। আর এখন প্রাধান্য পাচ্ছে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ। সুশাসন ও মানবাধিকারের বিষয়টি গৌণ হয়ে গেছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব) মনিরুজ্জামান বলেন, ফোর্সেস গোল ২০৩০-কে লক্ষ্য রেখে সমরাস্ত্র সংগ্রহ করছে বাংলাদেশ। এগুলো সংগ্রহ করে ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে। যে অস্ত্রগুলো আমাদের কাছে মজুত নেই, সেগুলোই কেনা হচ্ছে। বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থানে সম্ভাব্য যে শক্তি বজায় রাখা প্রয়োজন, সেই দিকে লক্ষ্য রেখে আমাদের সমরাস্ত্র সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত