Ajker Patrika

মব জাস্টিস কি ফ্রিডম টু কিল

কাজী মাহমুদুর রহমান
মব জাস্টিস কি ফ্রিডম টু কিল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে তোফাজ্জল হত্যা নিয়ে এখন কথা হচ্ছে বিস্তর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটা ঘটনপটীয়সী বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এলাকা। এখানে যা ঘটে তা ভাইরাল হতে সময় লাগে না। সারা দুনিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শত রকমের মানদণ্ডের ভিত্তিতে র‍্যাঙ্কিং করা হয়। ভাইরাল ঘটনার বিচারে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিপুল বিক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম স্থানে অধিষ্ঠিত হবে বলে আমার বিশ্বাস। 

কয়েক দিন আগে টিএসসিতে ছাত্রসমাজের আহ্বানে দেশের বিভিন্ন বন্যাদুর্গত অঞ্চলের মানুষকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছে আপামর জনসাধারণ। অনেকেই বলেছেন, এমন দৃশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেখেনি কখনো। অল্প বয়সীরাই শুধু না, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং মুরব্বি সমাজেও এই কথা বলতে দেখেছি। আমি নিজে তিরিশ বছর ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছি। আমি কিন্তু জাতীয় দুর্বিপাক, দুর্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে মানবিক মূর্তি নিয়ে সক্রিয় দেখেছি। বাঁধনের কর্মী হিসেবে পরীক্ষার আগের রাতে মানুষের জন্য সারা রাত রক্ত জুগিয়ে ফেরা আমাদের ছাত্রজীবন কেটেছে বন্যার সময় টিএসসিতে রুটি বেলে। আমি যখন বলেছি এমন মানবিকতার দৃষ্টান্ত নতুন নয়, তখন কতিপয় বন্ধু গোসসা করেছেন। 

আজ বলব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এফ এইচ হলের ঘটনা নতুন কোনো প্রবণতা নয় এবং বাংলাদেশের জন্যও এই তথাকথিত মব জাস্টিস নতুন বা ব্যতিক্রম কিছু না। 

এর মূলে রয়েছে এই দেশের মানুষের নিজ হাতে ‘বিচার’ করার এক প্রায় সর্বজনীন প্রবণতা। কিন্তু আমরা সেসব নিয়ে কথা বলতে সাহস পাই না। 

যে দেশের একজন প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত একজন অভিযুক্তকে পানিতে চুবানি দেওয়ার রায় দিয়ে দেন ঠাট্টাচ্ছলে, যে দেশের শান্তিতে নোবেল বিজয়ী প্রধান উপদেষ্টা বঙ্গবন্ধুর নিদারুণ অপমানকে ‘কন্যার দোষে’ প্রয়াত পিতার প্রতি মানুষের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গণ্য করেন, সেই দেশের ‘নতুন স্বাধীন মেধাবী ছাত্রসমাজ’ যদি মোবাইল চুরির বিচার নিজেরা করে ফেলে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু আমি অন্তত খুঁজে পাই না। বরং এক অনুশোচনা এসে ভর করে, নিজের দেশ নিয়ে, নিজের বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কত গর্বের কথা বলেছি বারংবার! যাদের বলেছি, বিশেষ করে সন্তান এবং আগামী প্রজন্মের প্রতিনিধিদের কাছে মিথ্যুক হয়ে গেলাম! এটা অত্যন্ত গ্লানিকর। 

এফ এইচ হলের ছাত্ররা তো কয়েক দিন আগে বিপ্লব সফল করেছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের মধ্যে নিশ্চয়ই তাঁদের কেউ কেউ আছেন। এমনকি উপদেষ্টা পরিষদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক অ্যালামনাই ভরপুর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এখন সারা দেশে দায়িত্ব পালন করছেন—আনসার বিদ্রোহ, সুপ্রিম কোর্ট দখল, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, এইচএসসি অটোপাসের আন্দোলন—সবই তাঁরা সফল সমাধান করে দিচ্ছেন। তাঁরা যা বলছেন সরকার তা করতে বাধ্য হচ্ছে। তবে কি তাঁদের কাছে একটা কথিত ‘চোরের’ জীবন মূল্যহীন? একটা মানসিক ভারসাম্য হারানো মানুষকে তাঁরা পিটিয়ে বিচার করে দিলেন? এটা অনুভব করি যে ছাত্ররা ছেলেটিকে হয়তো প্রাণে মেরে ফেলতে চাননি। তাঁরা যে যথেষ্ট মানবিক তার পরিচয় তো তাঁরাই দিলেন! নইলে ‘মোবাইল চোর’কে কেউ ভাত খেতে দেয়? 

তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যাটা হলো, ছাত্ররা দেখেছেন মব জাস্টিস করে প্রধান বিচারপতি থেকে শুরু করে একযোগে পুরো বিচারালয়কে বিতাড়িত করে দেওয়াকে রাষ্ট্র উৎসাহ দেয়। তাঁরা দেখেছেন দেশের নানা স্থানে মব জাস্টিসের নামে ফ্রিডম টু কিল চলছে।

তাঁরা জেনেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু বছর ধরে কোনো হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয়নি। তাঁরা দেখে এসেছেন এই দেশে পকেটমার সন্দেহে, ছেলেধরা সন্দেহে মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। তাঁরা দেখেছেন, মানুষের জীবন খুব তুচ্ছ এ দেশে। 

এই দেশে কোনো দিন আইনের শাসন কার্যকর ছিল বলে আর কেউ বিশ্বাস করে না। তাই যাঁদের সামর্থ্য আছে তাঁরা বিচার নিজের হাতেই করে নেন। পিটিয়ে মারা একধরনের মৃত্যুদণ্ড। মব কিলিংকে আপনি যখন মব জাস্টিস বলছেন, তখন আপনি পিটিয়ে মেরে ফেলাকেও এক অর্থে জাস্টিসই মানছেন। এভাবেই মব জাস্টিস জাস্টিফাই হয়ে যায় এ দেশে!

লেখক: কাজী মাহমুদুর রহমান,লেখক ও ব্যাংকার

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত