অজয় দাশগুপ্ত
এখন বিজয়ের মাস। এ মাসে আমরা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি। গর্ব করি। কিন্তু ইতিহাস বিষয়ে পালনীয় কর্তব্য পালন করি কি? আজ আমি এমন একজন মানুষের কথা লিখব, যিনি মারা যেতে পারেন জেনেও বাঙালির জন্য, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। বাঙালির জন্য ঝুঁকি নেওয়ার তিনি কেউ ছিলেন না। না বাঙালি, না বাংলাদেশি, না ভারতীয় বা পাকিস্তানি। ডাচ, মানে হল্যাল্ডের মানুষ। পরে আমাদের মতো অভিবাসী হয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ায়। বাটার বড় পদবির রাশভারী কর্মকর্তা। আর তিনিই হয়ে উঠেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ওলন্দাজ-অস্ট্রেলীয় সামরিক কমান্ডো অফিসার উইলিয়াম এ এস ওডারল্যান্ড।
যে দেশে বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন আহমদ থেকে খালেদ মোশাররফের কথা মানুষকে ভুলিয়ে রাখা হতো, সেই সমাজে তাঁকে মনে করবে কে?আর যারা যখন সরকারে তারা মুখে যা-ই বলুক, সব সময় নিজেদের হাইলাইট করতেই ব্যস্ত। ফলে এসব মানুষকে আমরা জানি না। জানলেও চিনি না। আর চিনলেও মনে রাখি না। অথচ তাঁরাই আমাদের সেই সব মানুষ, যাঁদের কারণে আজ কেউ মন্ত্রী, কেউ আমলা, কেউ রাজনীতিক।
ওডারল্যান্ডের কথা জানার পরপরই আমি উতলা হয়ে পড়েছিলাম তাঁর সান্নিধ্য আর দেখা পাওয়ার জন্য। তখন তিনি সিডনি থেকে বহু দূরে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার পার্থ শহরে শেষ দিনগুলো পার করছিলেন। ভীষণ ইচ্ছে ছিল তাঁর সঙ্গে দেখা করার। কিন্তু তখন আমি নতুন অভিবাসী। মাত্রই এসেছি এ দেশে। নিজেরা থিতু হওয়ার সংগ্রাম করছি। সে সময় সম্ভব ছিল না অতটা পথ পাড়ি দিয়ে যাওয়া। কিন্তু আমি প্রায়ই ফোন করতাম। নম্বর জোগাড় হওয়ার পর আমার অবিরাম চেষ্টার ফলে তাঁর স্ত্রী একবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। বারণ ছিল উত্তেজিত করার। জানা যায় পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর উল্লাসরত তাঁর এক কর্মচারীকে বরখাস্ত করেছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু, সৈয়দ নজরুল ও তাজউদ্দীনের মৃত্যু তিনি সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। তলায় জমে থাকা বাংলাদেশের জন্য ভালোবাসা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অনুরাগ ছিল স্পষ্ট।
আর পাঁচজন বিদেশির মতোই অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক ডব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড চাকরি করতে এসেছিলেন বাংলাদেশে। দেশ তখন পাকিস্তানের পূর্বাংশ। ১৯৭১ সাল। পরিস্থিতি সুবিধাজনক নয়। স্বাধিকারের দাবিতে দৃঢ়সংকল্প বাঙালির আন্দোলনে উত্তাল সমগ্র দেশ।ওডারল্যান্ড ওই বছরের শুরুতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়ে যোগ দিয়েছেন বাটা শু কোম্পানিতে। টঙ্গীতে তাঁর কার্যালয়। দেশের পরিস্থিতি আঁচ করতে মোটেই অসুবিধা হয়নি তাঁর। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ২৫ মার্চ বাঙালিদের গণহত্যা ওডারল্যান্ডকে অত্যন্ত বিচলিত করে তোলে। জঘন্য গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিকাণ্ড, নারী নির্যাতন ওডারল্যান্ডের মনে এক পুরোনো ক্ষত যেন নতুন করে জাগিয়ে তোলে। রক্তের ভেতর আবার সেই পুরোনো ডাক অনুভব করেন তিনি যুদ্ধে যাওয়ার। বহুজাতিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর্তা ৫৪ বছর বয়সী ওডারল্যান্ড আবার ঝাঁপিয়ে পড়েন যোদ্ধার ভূমিকায়।
বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হিসেবে যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানে অবাধে চলাচলের সুযোগ ছিল তাঁর। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে হত্যা-নির্যাতনের ছবি তুলে সেসব ছবি গোপনে বিদেশের গণমাধ্যমে পাঠাতে থাকেন। সেই সঙ্গে চেষ্টা করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নীতিনির্ধারক পর্যায়ে যোগাযোগ সৃষ্টির। একটা পর্যায়ে তিনি গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ও পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি, রাও ফরমান আলীসহ পাকিস্তানি সেনাদের মাথা-মুরব্বিদের সঙ্গে দহরম-মহরম করে তথ্য সংগ্রহের কাজটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গেই করছিলেন। যেমন করেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির সেনাশিবিরে গিয়ে।
অস্ট্রেলিয়া ওডারল্যান্ডের পিতৃভূমি হলেও ১৯১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর তাঁর জন্ম হল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডামে। জীবিকার তাগিদে ১৭ বছর বয়সে তিনি একটি ছোট প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন, পরে সেখান থেকে বাটা শু কোম্পানিতে। জার্মানির নাৎসি বাহিনী হল্যান্ড আক্রমণ করলে তিনি ডাচ সেনাবাহিনীতে সার্জেন্ট হিসেবে যোগ দেন। নাৎসিরা ১৯৪০ সালে বিমান হামলা করে তাঁর জন্মশহর বিধ্বস্ত করে দেয়, হল্যান্ড চলে যায় তাদের দখলে। ওডারল্যান্ড বন্দী হন জার্মানদের হাতে। তবে কৌশলে তিনি বন্দিশিবির থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধফেরত সৈনিকদের ক্যাম্পে কাজ করতে থাকেন। যোগ দেন ডাচ-প্রতিরোধ আন্দোলনে। ডাচদের বিভিন্ন আঞ্চলিক ও জার্মান ভাষা রপ্ত ছিল তাঁর। এই সুযোগ নিয়ে তিনি জার্মানদের গোপন আস্তানায় ঢুকে পড়েন। তথ্য সংগ্রহ করে পাঠাতে থাকেন মিত্রবাহিনীর কাছে। ১৯৪৩ সালে তিনি কমান্ডো বাহিনীতে যোগ দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে অত্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কমান্ডো সৈনিক ওডারল্যান্ড এ অভিজ্ঞতাই কাজে লাগিয়েছেন ঢাকায় নানাভাবে। প্রথম পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ করলেও শুধু এতেই সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি তিনি। এমন একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন আমাদের সঙ্গে, যিনি নিজের পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে নিয়াজির সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। আর সেই সুযোগে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে সব খবর পৌঁছে যেত মুক্তিবাহিনীর কাছে। পদে পদে বিপদকে মাথায় রেখে এই মানুষটি লড়াই করেছেন। বাংলাদেশে ঢাকায় তাঁর নামে একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে।
দেশ স্বাধীনের পর সম্ভবত একবার গিয়েছিলেন। কিন্তু ইতিহাস বিকৃতি আর মুক্তিযুদ্ধের অপমান মানতে পারতেন না বলে আর যাননি।আমাদের সমাজে এখনো যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভ্রান্তি, এখনো যে তর্ক, তা নিরসনে এই মানুষদের জানা জরুরি। এত বছর পর আমরা কিন্তু আমাদের শিশু-কিশোর ও তরুণদের জানাতে পারিনি তাঁদের কথা। ওডারল্যান্ড বাংলাদেশকে কেমন ভালোবাসতেন, তা তাঁর একমাত্র সন্তান অ্যানি হ্যামিলটনের কথাতেই জেনেছি। অ্যানি এসেছিলেন সিডনিতে বাংলা সংস্কৃতি সম্মেলনের আয়োজনে। বাবা তাঁকে বলতেন, ‘বাংলাদেশ আমার মন। আমি বাংলাদেশকে ভালোবাসি।’ এই মানুষটি আমাদের পতাকা, সংগীত ও স্বাধীনতার এক মূর্ত প্রতীক। জর্জ হ্যারিসন, রবিশঙ্কর, আঁদ্রে মারলো—এমন কিছু মানুষের পাশাপাশি তিনিও আমাদের মনে করিয়ে দেন, আমরা একা না। আমাদের মা জননী দেশ কখনো একা ছিল না।
শেষ জীবনেও ওডারল্যান্ড থাকতেন বাংলাদেশের ভাবনায় ব্যাকুল। দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে যাওয়ার পরেও বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো লেখা পেলেই চোখের সামনে মেলে ধরতেন। নিকটজনকে বলতেন পড়ে শোনাতে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, এমনকি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় তিনি বিক্ষুব্ধ হতেন। তাঁর জন্য এটাই ছিল স্বাভাবিক, কারণ তিনি স্বচক্ষে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, নিজে যুদ্ধ করেছেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি নিজের ছেলের মতো দেখতেন।
অকুতোভয় এই বীর মুক্তিযোদ্ধা একাত্তরে আমাদের হয়ে শুধু যুদ্ধ করেননি, এখনো তাঁর পরিচয়ে সে স্মৃতি বহন করে চলেছেন। তাঁর প্যাডে দেখেছি ডব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড বি.পি. লেখা। এই যে বীর প্রতীক (বি.পি.) খেতাবটি, নিজের নামের সঙ্গে তাঁর সংযুক্ত বজায় রেখে ‘তিনি আমাদের লোক’ এই পরিচয় তুলে ধরেছেন আজীবন।
এই একমাত্র বিদেশি বীর প্রতীক ওডারল্যান্ড তাঁর একমাত্র কন্যাকে সব সময় বলতেন, ‘মনে রেখো, বাংলাদেশ আমাদের ভালোবাসা। পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি আবেগের এ ধারাটা অব্যাহত রেখো।’ শুভ জন্মদিন ওডারল্যান্ড।
লেখক: অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কলামিস্ট
এখন বিজয়ের মাস। এ মাসে আমরা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি। গর্ব করি। কিন্তু ইতিহাস বিষয়ে পালনীয় কর্তব্য পালন করি কি? আজ আমি এমন একজন মানুষের কথা লিখব, যিনি মারা যেতে পারেন জেনেও বাঙালির জন্য, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। বাঙালির জন্য ঝুঁকি নেওয়ার তিনি কেউ ছিলেন না। না বাঙালি, না বাংলাদেশি, না ভারতীয় বা পাকিস্তানি। ডাচ, মানে হল্যাল্ডের মানুষ। পরে আমাদের মতো অভিবাসী হয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ায়। বাটার বড় পদবির রাশভারী কর্মকর্তা। আর তিনিই হয়ে উঠেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ওলন্দাজ-অস্ট্রেলীয় সামরিক কমান্ডো অফিসার উইলিয়াম এ এস ওডারল্যান্ড।
যে দেশে বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন আহমদ থেকে খালেদ মোশাররফের কথা মানুষকে ভুলিয়ে রাখা হতো, সেই সমাজে তাঁকে মনে করবে কে?আর যারা যখন সরকারে তারা মুখে যা-ই বলুক, সব সময় নিজেদের হাইলাইট করতেই ব্যস্ত। ফলে এসব মানুষকে আমরা জানি না। জানলেও চিনি না। আর চিনলেও মনে রাখি না। অথচ তাঁরাই আমাদের সেই সব মানুষ, যাঁদের কারণে আজ কেউ মন্ত্রী, কেউ আমলা, কেউ রাজনীতিক।
ওডারল্যান্ডের কথা জানার পরপরই আমি উতলা হয়ে পড়েছিলাম তাঁর সান্নিধ্য আর দেখা পাওয়ার জন্য। তখন তিনি সিডনি থেকে বহু দূরে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার পার্থ শহরে শেষ দিনগুলো পার করছিলেন। ভীষণ ইচ্ছে ছিল তাঁর সঙ্গে দেখা করার। কিন্তু তখন আমি নতুন অভিবাসী। মাত্রই এসেছি এ দেশে। নিজেরা থিতু হওয়ার সংগ্রাম করছি। সে সময় সম্ভব ছিল না অতটা পথ পাড়ি দিয়ে যাওয়া। কিন্তু আমি প্রায়ই ফোন করতাম। নম্বর জোগাড় হওয়ার পর আমার অবিরাম চেষ্টার ফলে তাঁর স্ত্রী একবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। বারণ ছিল উত্তেজিত করার। জানা যায় পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর উল্লাসরত তাঁর এক কর্মচারীকে বরখাস্ত করেছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু, সৈয়দ নজরুল ও তাজউদ্দীনের মৃত্যু তিনি সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। তলায় জমে থাকা বাংলাদেশের জন্য ভালোবাসা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অনুরাগ ছিল স্পষ্ট।
আর পাঁচজন বিদেশির মতোই অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক ডব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড চাকরি করতে এসেছিলেন বাংলাদেশে। দেশ তখন পাকিস্তানের পূর্বাংশ। ১৯৭১ সাল। পরিস্থিতি সুবিধাজনক নয়। স্বাধিকারের দাবিতে দৃঢ়সংকল্প বাঙালির আন্দোলনে উত্তাল সমগ্র দেশ।ওডারল্যান্ড ওই বছরের শুরুতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়ে যোগ দিয়েছেন বাটা শু কোম্পানিতে। টঙ্গীতে তাঁর কার্যালয়। দেশের পরিস্থিতি আঁচ করতে মোটেই অসুবিধা হয়নি তাঁর। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ২৫ মার্চ বাঙালিদের গণহত্যা ওডারল্যান্ডকে অত্যন্ত বিচলিত করে তোলে। জঘন্য গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিকাণ্ড, নারী নির্যাতন ওডারল্যান্ডের মনে এক পুরোনো ক্ষত যেন নতুন করে জাগিয়ে তোলে। রক্তের ভেতর আবার সেই পুরোনো ডাক অনুভব করেন তিনি যুদ্ধে যাওয়ার। বহুজাতিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর্তা ৫৪ বছর বয়সী ওডারল্যান্ড আবার ঝাঁপিয়ে পড়েন যোদ্ধার ভূমিকায়।
বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হিসেবে যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানে অবাধে চলাচলের সুযোগ ছিল তাঁর। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে হত্যা-নির্যাতনের ছবি তুলে সেসব ছবি গোপনে বিদেশের গণমাধ্যমে পাঠাতে থাকেন। সেই সঙ্গে চেষ্টা করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নীতিনির্ধারক পর্যায়ে যোগাযোগ সৃষ্টির। একটা পর্যায়ে তিনি গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ও পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি, রাও ফরমান আলীসহ পাকিস্তানি সেনাদের মাথা-মুরব্বিদের সঙ্গে দহরম-মহরম করে তথ্য সংগ্রহের কাজটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গেই করছিলেন। যেমন করেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির সেনাশিবিরে গিয়ে।
অস্ট্রেলিয়া ওডারল্যান্ডের পিতৃভূমি হলেও ১৯১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর তাঁর জন্ম হল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডামে। জীবিকার তাগিদে ১৭ বছর বয়সে তিনি একটি ছোট প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন, পরে সেখান থেকে বাটা শু কোম্পানিতে। জার্মানির নাৎসি বাহিনী হল্যান্ড আক্রমণ করলে তিনি ডাচ সেনাবাহিনীতে সার্জেন্ট হিসেবে যোগ দেন। নাৎসিরা ১৯৪০ সালে বিমান হামলা করে তাঁর জন্মশহর বিধ্বস্ত করে দেয়, হল্যান্ড চলে যায় তাদের দখলে। ওডারল্যান্ড বন্দী হন জার্মানদের হাতে। তবে কৌশলে তিনি বন্দিশিবির থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধফেরত সৈনিকদের ক্যাম্পে কাজ করতে থাকেন। যোগ দেন ডাচ-প্রতিরোধ আন্দোলনে। ডাচদের বিভিন্ন আঞ্চলিক ও জার্মান ভাষা রপ্ত ছিল তাঁর। এই সুযোগ নিয়ে তিনি জার্মানদের গোপন আস্তানায় ঢুকে পড়েন। তথ্য সংগ্রহ করে পাঠাতে থাকেন মিত্রবাহিনীর কাছে। ১৯৪৩ সালে তিনি কমান্ডো বাহিনীতে যোগ দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে অত্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কমান্ডো সৈনিক ওডারল্যান্ড এ অভিজ্ঞতাই কাজে লাগিয়েছেন ঢাকায় নানাভাবে। প্রথম পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ করলেও শুধু এতেই সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি তিনি। এমন একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন আমাদের সঙ্গে, যিনি নিজের পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে নিয়াজির সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। আর সেই সুযোগে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে সব খবর পৌঁছে যেত মুক্তিবাহিনীর কাছে। পদে পদে বিপদকে মাথায় রেখে এই মানুষটি লড়াই করেছেন। বাংলাদেশে ঢাকায় তাঁর নামে একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে।
দেশ স্বাধীনের পর সম্ভবত একবার গিয়েছিলেন। কিন্তু ইতিহাস বিকৃতি আর মুক্তিযুদ্ধের অপমান মানতে পারতেন না বলে আর যাননি।আমাদের সমাজে এখনো যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভ্রান্তি, এখনো যে তর্ক, তা নিরসনে এই মানুষদের জানা জরুরি। এত বছর পর আমরা কিন্তু আমাদের শিশু-কিশোর ও তরুণদের জানাতে পারিনি তাঁদের কথা। ওডারল্যান্ড বাংলাদেশকে কেমন ভালোবাসতেন, তা তাঁর একমাত্র সন্তান অ্যানি হ্যামিলটনের কথাতেই জেনেছি। অ্যানি এসেছিলেন সিডনিতে বাংলা সংস্কৃতি সম্মেলনের আয়োজনে। বাবা তাঁকে বলতেন, ‘বাংলাদেশ আমার মন। আমি বাংলাদেশকে ভালোবাসি।’ এই মানুষটি আমাদের পতাকা, সংগীত ও স্বাধীনতার এক মূর্ত প্রতীক। জর্জ হ্যারিসন, রবিশঙ্কর, আঁদ্রে মারলো—এমন কিছু মানুষের পাশাপাশি তিনিও আমাদের মনে করিয়ে দেন, আমরা একা না। আমাদের মা জননী দেশ কখনো একা ছিল না।
শেষ জীবনেও ওডারল্যান্ড থাকতেন বাংলাদেশের ভাবনায় ব্যাকুল। দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে যাওয়ার পরেও বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো লেখা পেলেই চোখের সামনে মেলে ধরতেন। নিকটজনকে বলতেন পড়ে শোনাতে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, এমনকি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় তিনি বিক্ষুব্ধ হতেন। তাঁর জন্য এটাই ছিল স্বাভাবিক, কারণ তিনি স্বচক্ষে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, নিজে যুদ্ধ করেছেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি নিজের ছেলের মতো দেখতেন।
অকুতোভয় এই বীর মুক্তিযোদ্ধা একাত্তরে আমাদের হয়ে শুধু যুদ্ধ করেননি, এখনো তাঁর পরিচয়ে সে স্মৃতি বহন করে চলেছেন। তাঁর প্যাডে দেখেছি ডব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড বি.পি. লেখা। এই যে বীর প্রতীক (বি.পি.) খেতাবটি, নিজের নামের সঙ্গে তাঁর সংযুক্ত বজায় রেখে ‘তিনি আমাদের লোক’ এই পরিচয় তুলে ধরেছেন আজীবন।
এই একমাত্র বিদেশি বীর প্রতীক ওডারল্যান্ড তাঁর একমাত্র কন্যাকে সব সময় বলতেন, ‘মনে রেখো, বাংলাদেশ আমাদের ভালোবাসা। পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি আবেগের এ ধারাটা অব্যাহত রেখো।’ শুভ জন্মদিন ওডারল্যান্ড।
লেখক: অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কলামিস্ট
‘দুই দিন আগেই বাড়ি থেকে পাথরঘাটায় চলে এসেছি। এখন পুরোনো জাল সেলাই করছি। এক সপ্তাহের বাজারও করে এনেছি। আজ বিকেলে সাগর মোহনায় যাব, গভীর রাত থেকে জাল ফেলব।’ কথাগুলো বলছিলেন বরগুনা সদরের বাইনচটকী এলাকার জেলে হোসেন আলী। গতকাল বুধবার সকালে বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে কথা হয় তাঁর...
১২ জুন ২০২৫ভারতের স্থলবন্দর নিষেধাজ্ঞার পর সীমান্তে আটকে থাকা তৈরি পোশাক, খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের ট্রাকগুলো ফেরত আনছেন রপ্তানিকারকেরা। তবে যেসব ট্রাক বন্দরে ঢুকে গিয়েছিল, সেগুলো ভারতে প্রবেশ করানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব ট্রাক ঢুকতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে।
১৯ মে ২০২৫আধুনিক যুগের সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলোর একটি হচ্ছে গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষের সঙ্গে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক রত্নসম্ভার। গতকাল বুধবার হংকংয়ে বিখ্যাত আর্ট নিলাম কোম্পানি সাদাবি’স-এর এক নিলামে এগুলো তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
০৮ মে ২০২৫পাকিস্তানে ভারতের হামলার সমালোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চীনও এই হামলাকে ‘দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করেছে। উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘও। উত্তেজনা যেন আরও না বাড়ে, সে জন্য দুই পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ। এদিকে ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করেছে...
০৮ মে ২০২৫