Ajker Patrika

ডিম আলু গোল-মালামাল

ড. মো. ফখরুল ইসলাম
ডিম আলু গোল-মালামাল

ডিমের দাম নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার পর ক্রয়ক্ষমতা হারানো নিম্ন আয়ের মানুষের পুষ্টিপূরণ ক্ষমতা হারানোর ভীতি এখনো কাটেনি। এসব মানুষ আমিষের জন্য ডিম খাওয়ার কথা নিয়ে আর ভাবতে চান না। আমদানি করা ডিম প্রায় দেড় মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও দেশের বাজারে ঢুকেছে কি না, তা চিনতে পারবেন কেমন করে? দেশি ডিমের স্বাদের কথা ভুলে গেছেন কিন্তু বিদেশি সস্তা ডিমের রং ও স্বাদ কেমন তা পরখ করার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বাজারে আমদানি করা ডিমের আগমনের অপেক্ষায় থেকে থেকে হতাশ হয়েছেন।
অপেক্ষাকৃত কমদামি বিদেশি ডিমও যখন নাগালে ধরা দিচ্ছে না বলে সেটা ভুলে পেঁয়াজ-কাঁচা মরিচ ছাড়া দেশি আলুর ভর্তা বা ছালুন দিয়ে উদরপূর্তি করার মানসে দিন কাটাচ্ছেন, তখন দেশি আলুর বাজারে আগুন লাগার খবরে মাথায় বজ্রাঘাত শুরু হয়েছে। কৃষিমন্ত্রীর ভাষ্য থেকেই গণমাধ্যমে শোনা গেছে, এলাকা ও বাজারভেদে আলুর কেজিপ্রতি দাম ৬০, ৭০, ৮০ টাকা পর্যন্ত চাওয়া হচ্ছে। কারণ এখন জমিতে আলুর বীজ লাগানোর মৌসুম শুরু হয়েছে।

কোল্ডস্টোর বা হিমাগার থেকে সংরক্ষিত আলু একবার বাইরের বাতাসে বের করলে বেশি দিন রাখা যায় না। আলুর গায়ে চোখ বা চারা গজানোর লক্ষণ দেখা দেয়। হিমাগারে রাখা আলু বাইরের আলো-বাতাসে এলে দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে বীজ আলুতে পরিণত হয়। একই আলু কেউ খাদ্যের জন্য ব্যবহার করতে পারেন। কেউবা বীজ হিসেবে জমিতে লাগানোর জন্য কিনতে পারেন। এ বছর এমন একসময় আলুর দাম বেড়ে গেছে, যখন প্রাকৃতিক কারণে বাজারে শাকসবজির সরবরাহ খুব কম থাকে। সাধারণত বছরের এই সময়টাতে গোটা দেশের সাধারণ মানুষ বেশি করে আলু কিনে সবজির অভাব পূরণ করে থাকেন। এর সঙ্গে বীজআলু কেনার সময় শুরু হয়ে গেছে। 

এই দ্বিমুখী চাহিদায় সংরক্ষণকারী ও ব্যবসায়ীরা আলুর দাম বাড়িয়ে অগ্নিমূল্য তৈরি করে নতুনভাবে ‘আলুমূল্য সন্ত্রাস’ শুরু করে বাজারকে অস্থিতিশীলতার চরম পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। নতজানু কর্তৃপক্ষ এই কারসাজিতে দেশে আলু আমদানি করার ঘোষণা দিয়েছে। সরকার ডিমের মতো গোলআলু আমদানি করে অস্থিতিশীল বাজারের দ্রব্যমূল্য গোলমালের সমস্যার সমাধান করতে বদ্ধপরিকর।

অক্টোবরের শুরুতে ১৫টি প্রতিষ্ঠানকে ১৫ কোটি ডিম আমদানির জন্য এলসি খোলার অনুমতি দেওয়া হলেও তাদের তৎপরতা বা আমদানির অগ্রগতি কেউ ভালোভাবে বলতে পারছে না। তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত আমদানি করা ডিমের চালান দেশে আসেনি। ক্রেতা-বিক্রেতারা বলছেন, খোলাবাজারে আমদানি করা বিদেশি ডিম দেখা যায়নি। নভেম্বর শুরু হলেও ডিম সমস্যার ইতিবাচক কোনো সমাধান এখনো লক্ষ করা যায়নি বিধায় কারসাজির সিন্ডিকেট আলু আমদানির ঘোষণা শুনে মোটেও বিচলিত নয়। তারা মনে করছে, ডিম না খেলেও গরিব মানুষ বা কৃষকদের তেমন কিছু যায়-আসে না। কিন্তু কৃষকেরা জমিতে নতুন আলুর বীজ লাগাতে ব্যর্থ হলে সব দিকেই ক্ষতি।

এই ক্ষতি আগামী বছরের জন্য দেশে খাদ্যসংকট সৃষ্টি করে হাহাকার বয়ে আনতে পারে। কারণ, আলু আমাদের দেশের মানুষের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাদ্য। চালের চেয়ে আলু বেশ সস্তা ও সহজলভ্য। উৎপাদন খরচ কম ও সময়ও লাগে কম। ভাতের তুলনায় আলুতে পুষ্টিমান বেশি। বাংলাদেশে গোলআলুর বার্ষিক উৎপাদনের পরিমাণ ১ কোটি ১০ লাখ ৫২ হাজার টন, যা আমাদের চাহিদা ৯০ লাখ টনের তুলনায় অনেক বেশি। অথচ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে আলুর দামে অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি ঘটেছে—৭৮ শতাংশ।

কৃষ্টিগত কারণে দেশে আলু বাদ দিয়ে ভাতের ওপর নির্ভরশীলতা তৈরি হয়েছে। খরা ও বন্যার কারণে ধানের আবাদ নষ্ট হয়ে গেলেও বিগত বছরগুলোতে আলুর ফলন বেড়ে গেছে। বাজারে আলুর দাম কম থাকায় দরিদ্র জনগণ আলু খেয়ে ভাতের অভাব ভুলে থাকতে পেরেছেন। অথচ এ বছর সেই আলুর ওপর শনির দৃষ্টি পড়ে গেছে!

তাই শুধু আলুর ভোক্তারাই নন, আবাদের জন্য মৌসুমি কৃষকেরা আলুর আগুন দাম শুনে অবাক না হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।

কৃষকদের অবাক হওয়ার প্রধান কারণ, এত বেশি দামে আলুর বীজ কিনে জমিতে রোপণ করলে তার পরিণাম খুব খারাপ হতে পারে।

এ বছর কোনো কৃষক যদি ৬৫-৭০ টাকা কেজি দরে আলু কিনে সেটাকে বীজ হিসেবে ব্যবহার করেন তাহলে তাঁর ৭ থেকে ৮ হাজার টাকার বীজ আলুর প্রয়োজন হবে। গত বছর ১৬-১৭ টাকা কেজি দরে বীজআলু কেনা গিয়েছিল বিধায় খরচ হয়েছিল মাত্র দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। আগে জমিতে আলু লাগানোর তিন মাসের মাথায় নতুন আলু তুলে বাজারে বেশি দামে (৩০-৩৫) বিক্রি করে সব উৎপাদন খরচ মেটানোর পরও বিঘাপ্রতি ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা লাভ করতে পারতেন। পাশাপাশি আলু তোলার পর জমি বেশ উর্বর থাকে। সেখানে সেচের পানি প্রবেশ করালেই সামান্য চাষে রোপা বোরো ধানের বাম্পার ফলন ঘটানো সম্ভব।

কিন্তু বীজ আলুর অগ্নিমূল্য তৈরি হওয়ায় এ বছর কিছুই লাভ অবশিষ্ট থাকবে না। এই ক্ষতির হিসাব মাথায় রেখে জমি অনাবাদি রেখে দিলে আরও বেশি ক্ষতি হবে রোপা বোরো ধানের আবাদে। বীজ আলুর সংকটের কারণে আলুর নির্দিষ্ট জমিতে এ বছর আলুর চাষ বন্ধ হয়ে গেলে বসন্তকালীন বোরো ধানের আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাহলে ছয় মাস পরেই দেশে আলু-চালের অভাবে মারাত্মক খাদ্যসংকট দেখা দিতে পারে। এই খাদ্যসংকটে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে! দরিদ্র মানুষের অভাবের সময় সেদ্ধ গোলআলু যদি সোনার হরিণ হয়ে যায়, যদি দেশি ডিম, পেঁয়াজ-কাঁচা মরিচ ছাড়া আলুর ভর্তাও কৃষকের পাত থেকে হারিয়ে যায়, তাহলে বিষয়টি বড় কষ্ট ও হতাশার জন্ম দেবে।

আমাদের দেশে এই দুটো খাদ্যের জনপ্রিয়তা ও ব্যবহার অতিবেশি। অথচ এদের ওপর শ্যেনদৃষ্টি দিয়ে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়ার ঘৃণ্য পাঁয়তারা শুরু হয়ে গেছে; যা একটি অতিজঘন্য ষড়যন্ত্রও বটে। এই কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারীদের ঘৃণ্য কারসাজিকে কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার উপায় নেই।

পাড়ার মোড়ের সব দোকানের ঝুড়ি ও ডালিতে সব সময় ডিম ও আলু নামের দুটো সস্তা ভোগ্যপণ্য আমাদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও বেঁচে থাকার সাহস জোগাত, যা কিনা আকাল দ্রব্যের মধ্যে নিপতিত হয়ে পড়েছে। এসব গোল-মালামালের গোলমাল নিয়ে আরও বেশি গোলযোগ সৃষ্টি হবে, সন্দেহ নেই।

ড. মো. ফখরুল ইসলাম, অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

‘ভারতে ঢুকে’ পাকিস্তানি সেনাদের গুলি, সীমান্তে সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে

এনবিআর চেয়ারম্যানের কক্ষের সামনে কর্মকর্তাদের অবস্থান

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত