Ajker Patrika

সময়োপযোগী দক্ষতায় পারদর্শী হতে হবে

অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর 
আপডেট : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৩: ৩৫
সময়োপযোগী দক্ষতায় পারদর্শী হতে হবে

বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটির সন্ধি বিচ্ছেদ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যা + আলয়। বিশ্ববিদ্যা হচ্ছে একটা প্রত্যয়। বিশ্ববিদ্যা হচ্ছে এমন একটি বিষয়, যা সারা বিশ্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে সেটির চর্চা হতে পারে, ক্যাম্পাসে সেটি নিয়ে আলোচনা হতে পারে; কিন্তু এটির আলো সারা বিশ্বে গিয়ে পড়বে অথবা বিশ্বের কোনো এক ক্যাম্পাস থেকে কোনো এক জায়গায় বিদ্যাচর্চা হলে, গবেষণা হলে সেটি এখানে এসে পৌঁছাবে। স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। স্কুল প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানকে ছড়িয়ে দেয় আর বিশ্ববিদ্যালয় নতুন জ্ঞানের সঞ্চালনা করে। বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার মধ্য দিয়ে নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি করে। আমাদের শিক্ষার্থীদের নতুন জ্ঞান সৃষ্টির দিকে মনোযোগী হতে হবে। পাশাপাশি আমাদের শিক্ষার্থীদের নানাবিধ গুণাবলি ও দক্ষতা অর্জন করাও অত্যাবশ্যকীয়।

হতে হবে গবেষণামুখী
গবেষণা আপনাকে একটা নতুন ধারণা কিংবা চিন্তা দেবে। সেটা মানুষ গ্রহণ করুক বা না করুক। পৃথিবীতে নতুন কথা একজনই প্রথম বলেছেন। সব সময় স্রোতের বিপরীতে সত্য কথা যারা বলবেন, নতুন কথা যারা বলবেন, তারা কম হয়ে থাকেন। কোপার্নিকাস কিংবা গ্যালিলিও যখন বলেছিলেন তখন সারা পৃথিবী বলেছিল, এটি সত্য না। তাঁদের ওপর নির্যাতন হয়েছিল। কিন্তু আজকে সারা পৃথিবী বলছে গ্যালিলিও সত্য, কোপার্নিকাস সত্য। এটিই হচ্ছে গবেষণা। আপনার গবেষণাকে প্রথমেই সবাই গ্রহণ করবে, হাততালি দেবে, এটা ভাববার কোনো কারণ নেই; বরং আমাদের আপনার একটা নতুন কথা দরকার, নতুন চিন্তা দরকার, একটা চাবি দরকার। গবেষণা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে হবে। গবেষণা খুব বড় করতে হবে তা নয়; বরং নতুন কিছু বের করে আনার চেষ্টার নামই গবেষণা। আর সেই গবেষণাকে জাতীয় উন্নতির সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।

আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে লড়তে হবে
আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ ছাড়া সুদৃঢ়ভাবে জীবনযাপন করা যায় না। মানুষ সব সময়ই সামনের দিকে এগোতে চায়, এটি মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা। কিন্তু তার সমস্ত ইচ্ছা পূরণ হয় না। এই ইচ্ছাটি পূরণ করার জন্য তার মধ্যে প্রতিজ্ঞা দরকার হয়। প্রতিনিয়ত তাকে লড়াই করতে হয়। জীবনভর লড়তে হয়।

পূর্ণ আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে
জাতিকে জাগ্রত করার জন্য নজরুল ইসলাম মাত্র ২২ বছর বয়সে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনা করেন। পৃথিবীতে যাঁরা অমরত্ব অর্জন করেছেন, তাঁরা সবাই তরুণ বয়স থেকে নিজেদের কর্মের মধ্য দিয়ে ইতিহাস রচনা করেছেন। নজরুল, ক্ষুদিরাম, বঙ্গবন্ধুর জীবনীতে এই চিত্রই আমরা দেখতে পাই। কখনো আত্মবিশ্বাস হারালে চলবে না, সমাজ পরিবর্তনে তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে। মেধার ওপর আস্থা রাখতে হবে। জীবনভর চলমান প্রতিযোগিতায় টিকবার জন্য নিজের ওপর পূর্ণ আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে।

থাকতে হবে যুক্তির পারম্পর্য
স্কুল-কলেজের জন্য নির্ধারিত টেক্সট বুক থাকে এবং সেই নির্ধারিত বইয়ের বাইরে খুব একটা কিছু লেখা যায় না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে টেক্সট বুক খুব একটা থাকবে না। কিছু টেক্সট বা পাঠ্য থাকবে, থাকবে রেফারেন্স। রেফারেন্স ঠিকভাবে দিয়ে যদি যথাযথভাবে প্রমাণ করতে পার যা বইয়ে লেখা আছে এর বাইরের সত্য, তাহলে শিক্ষক তোমাকে শুধু বেশি নম্বর নয়; বরং সর্বোচ্চ নম্বর দেবেন। এটিই বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে তোমাকে যুক্তির পারম্পর্য নিয়ে যেতে হবে, অযৌক্তিক বললে হবে না। সেটির একটি পদ্ধতিবিদ্যা আছে, সেই পদ্ধতিবিদ্যা অবলম্বন করে সেটি তোমাকে লিখতে হবে। গবেষণার মাধ্যমে ধীরে ধীরে তুমি নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করবে, ধীরে ধীরে পৃথিবীকে আলোকিত করবে।

প্রশ্ন করা শিখতে হবে
আরেকটি বড় ব্যাপার হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যুক্তি দিয়ে প্রশ্ন করা শিখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যদি প্রশ্ন করতে না পারে, তবেই শুরু হবে সংকট। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে প্রশ্নের জায়গা। এত দিন ধরে আমরা যা চর্চা করেছি, সেই চর্চার বাইরেও কিছু থাকতে পারে। এ জন্য আমাদের কথা বলতে হবে, জ্ঞানের বিনিময় করতে হবে।

সময়োপযোগী দক্ষতায় পারদর্শী হতে হবে
তরুণ সমাজের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এই যুগের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেওয়া। আমার মতো মানুষ, আমার জন্য এই চ্যালেঞ্জ ছিল। আমি আমার ছাত্রজীবনে কম্পিউটার স্পর্শও করতে পারিনি, কম্পিউটার কী আমি জানতাম না, আমার এমএ শ্রেণির থিসিস টাইপরাইটারে আমাকে টাইপ করতে হয়েছিল। আমি কম্পিউটার শিখেছি এর পরে। আমি যদি সেই কম্পিউটার না শিখতাম, আমি আরও পেছনে পড়ে যেতাম। ঢাকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শহরে উবার রয়েছে। তাদের নিজস্ব কোনো গাড়ি নেই, কিন্তু সারা পৃথিবীতে শুধু একটি অ্যাপের মাধ্যমে ব্যবসা করছে। নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে তাই নিজেদের খাপ খাওয়াতে হবে। নিজেদের দক্ষ করে তুলতে হবে। এই যুগে দক্ষতা ছাড়া সার্টিফিকেটের কোনো মূল্য নেই। তাই দক্ষতা অর্জন করতে পারলে কোনো শিক্ষার্থী বেকার থাকবে না। সে জন্য সময়ের সঙ্গে নিজেদের সময়োপযোগী দক্ষতায় পারদর্শী করতে হবে।

সহমর্মিতার চর্চা করতে হবে
সহমর্মিতা আজকে আমাদের সমাজ থেকে শেষ হয়ে যাচ্ছে। অথচ এই মাটির একটা বড় গুণ ছিল সহমর্মিতা। আমাদের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে, আমাদের মানুষ হওয়ার পেছনে যে হাজার হাজার মানুষের অবদান-আত্মত্যাগ সেসব মানুষকে আমরা যেন ভুলে না যাই। তাদের প্রতি সহমর্মী হতে হবে।

মাদক, জঙ্গিবাদ ও হতাশা দূরে রাখতে হবে
আজ তরুণ সমাজের সামনে সারা পৃথিবী উন্মুক্ত। সারা পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় চাকরি পেতে পার, উদ্যোক্তা হতে পার এবং সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে নিজের প্রতি আস্থাশীল হয়ে সারা পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পার। ক্লাসের পড়ার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্রিয়াশীল সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হও, সংগঠনগুলোয় সময় দাও, নিজেকে সংস্কৃতিমনা করে গড়ে তোলো। নিজেকে বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তোলো, নিজের মধ্যে জিজ্ঞাসাকে প্রশ্রয় দাও। মাদক, জঙ্গিবাদ ও হতাশা—এই তিন শত্রুকে দূরে রেখে মানুষের মতো মানুষ হতে হবে।

অতীতকে ভুলে যেও না
তোমরা যখন জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন পেছনের কথা ভুলবে না। মা-বাবাকে ভুলবে না, প্রতিবেশীদের ভুলবে না এবং অবশ্যই সাধারণ মেহনতি মানুষ, গরিব মানুষ—তাদের কথা ভুলবে না। কারণ, বাংলাদেশে এই গরিব মানুষ, মেহনতি মানুষের রক্ত-শ্রম-ঘামে এই আমরা দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের ঋণ শোধ করতে হবে। যদি আমরা নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধচ্যুত হয়ে যাই, মানবিকতা নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে আমরা এই সুন্দর পৃথিবীটাকে রক্ষা করতে পারব না।

অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকবে
ইতিহাসের পরম্পরায় আমাদের এগোতে হয়। আমরা সামনের দিকে যখন এগোব তখন আমাদের পেছনটিও কতটা শক্ত, সুদৃঢ় সেটি আমাদের মনে রাখা দরকার। তরুণ ছাত্রছাত্রীদের বুঝতে হবে, কতটা কঠিন পথ অতিক্রম করে আজকের এই বাংলাদেশ। এ জন্য অবশ্যই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে আমাদের পরিচয়, মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে আমাদের আদর্শের ঠিকানা। মুক্তিযুদ্ধের বই পড়তে হবে, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে হবে, মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে জানতে হবে। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের পথ দেখাবেন, যখন আমরা চরমভাবে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যাব।

লেখক: উপাচার্য, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

অনুলিখন: মো. আশিকুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত