Ajker Patrika

নতুন বাংলাদেশ ও আমাদের প্রত্যাশা

ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন
নতুন বাংলাদেশ ও আমাদের প্রত্যাশা

আজ ২৫ সেপ্টেম্বর। বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস। ইন্টারন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল ফেডারেশন (এফআইপি) কাউন্সিল ২০০৯ সালে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে প্রতিবছর ২৫ সেপ্টেম্বরে ‘বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস’ পালনের ঘোষণা দেয়।

ইন্টারন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল ফেডারেশনের আহ্বানে ২০১০ সাল থেকে প্রতিবছর সারা বিশ্বে ফার্মেসি পেশাজীবীরা জনসাধারণকে স্বাস্থ্যসেবায় এই পেশার অবদান সম্পর্কে সচেতন করতে সভা-সেমিনার, শোভাযাত্রা, রক্তদান কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এ দিনটি পালন করে আসছেন। প্রতিবছর এফআইপি এই দিবস উপলক্ষে এক একটি থিম বা প্রতিপাদ্য ঘোষণা করে। এবারকার প্রতিপাদ্য: ফার্মাসিস্টস: মিটিং গ্লোবাল হেলথ নিডস (ফার্মাসিস্ট: বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য চাহিদা মেটাচ্ছেন)।  

১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি বিভাগ খোলার পর দুই দশকের অধিক সময় পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় ফার্মেসি বিভাগ খোলা হয়। বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুসারে, বর্তমানে ১৩টি সরকারি ও ৩০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে ৪ থেকে ৫ বছর মেয়াদি ফার্মেসি শিক্ষা চালু রয়েছে, যারা গ্র্যাজুয়েট তথা ‘এ’ ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্ট তৈরি করছে। এ ছাড়া ১৭টি সরকারি ও ৪১টি বেসরকারি ইনস্টিটিউট ৪ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ডিগ্রি প্রদানের মাধ্যমে ‘বি’ ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্ট তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল ও বাংলাদেশ কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্টস সমিতি যৌথভাবে ওষুধ ব্যবসায়ে আগ্রহী ব্যক্তিদের জন্য একটি ত্রৈমাসিক ফার্মেসি সার্টিফিকেট রেজিস্ট্রেশন কোর্স পরিচালনা করে আসছে। বর্তমানে দেশের ৫৫টি জেলায় কেমিস্ট সমিতির ৭৫টি কেন্দ্রে এই কোর্স পরিচালিত হচ্ছে। ওই কোর্স সম্পন্ন করে প্রশিক্ষণার্থীরা বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলের অধীনে অনুষ্ঠিত ফার্মেসি সার্টিফিকেট রেজিস্ট্রেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে ফার্মেসি কাউন্সিল তাদের ‘সি’ ক্যাটাগরিতে ফার্মেসি টেকনিশিয়ান হিসেবে রেজিস্ট্রেশন প্রদান করে। 

বিশ্বময় স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন আঙ্গিকে ফার্মাসিস্টরা এক অতুলনীয় ভূমিকা রেখে আসছেন। ফার্মেসি কারিকুলামের উদ্দেশ্য—ওষুধের বিভিন্ন দিক ও আঙ্গিকের ওপর দক্ষ এবং বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের জনবল তৈরি করাই এর উদ্দেশ্য। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ৪ বছর মেয়াদি ব্যাচেলর কিংবা ৫ বছর মেয়াদি ফার্ম. ডি. (ডক্টর অব ফার্মেসি) কোর্স অফার করে আসছে। এই দীর্ঘ পরিক্রমায় ফার্মেসির একজন ছাত্রকে ওষুধের ব্যবহার ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বিষয়ে ব্যাপক প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি ওষুধের মূল ও সহায়ক উপাদান আহরণ/সংশ্লেষণ, বিভিন্ন উপাদানের সমন্বয়ে ট্যাবলেট/ক্যাপসুল ইত্যাদি প্রোডাক্ট তৈরি, মান নিয়ন্ত্রণ, সংরক্ষণ, বিপণন, বিতরণ, ওষুধ ব্যবহারকালে রোগীর অবস্থা পর্যবেক্ষণসহ ওষুধ সম্পর্কিত সব দিক ও আঙ্গিকের ওপর দক্ষ করে গড়ে তোলা হয়। 

পেশাগতভাবে বিবেচনা করলে ফার্মাসিস্টদের কর্মক্ষেত্রসমূহকে ৩টি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়: ১. কমিউনিটি/রিটেইল ফার্মেসি (ফার্মেসি শপ), ২. হাসপাতাল এবং ৩. ওষুধশিল্প। মোটা দাগে বলা চলে ৮০-৮৫ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট কমিউনিটি ও হসপিটাল ফার্মেসিতে পেশাগত সেবা দিয়ে থাকেন, যেখানে তাঁরা চিকিৎসক ও রোগীর মাঝখানে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেন। ওষুধ সম্পর্কে চিকিৎসক ও রোগী উভয়কেই বিশেষজ্ঞ সেবা দেওয়ার পাশাপাশি ওষুধের যথার্থ প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ ও অপপ্রয়োগ রোধের গুরুত্বপূর্ণ কাজটি তাঁরাই করেন। আমাদের দেশে বর্তমান সময়ে বিপুলসংখ্যক গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট তৈরি হলেও নীতিনির্ধারকদের যথেষ্ট মনোযোগের অভাব এবং একটি মহলের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে এই অধিক্ষেত্রে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের অংশগ্রহণ এখনো শূন্যের কোঠায়। 

দেশে এ মুহুর্তে কিছু গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট স্ব-উদ্যোগে এবং কিছু বেসরকারি হাসপাতাল গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের তত্ত্বাবধানে ‘মডেল ফার্মেসি’ নামে কিছু রিটেইল/কমিউনিটি ফার্মেসি চালু করেছে। ওষুধ প্রশাসনও গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের পরিচালনায় কিছু মডেল ফার্মেসির লাইসেন্স প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু, ‘সি’ গ্রেডের ফার্মাসিস্টদের মাধ্যমে ফার্মেসি পরিচালনার সুযোগ অবারিত রাখলে এবং ওষুধ ব্যবসায়ীরা গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগে উৎসাহিত/বাধ্য হন, এমন কিছু নিয়মকানুন প্রণয়ন না করলে এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন আসবে না।  

যতক্ষণ না জাতীয় স্বার্থে ও দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের প্রয়োজনে হাসপাতাল ও রিটেইল ফার্মেসিতে ফার্মাসিস্টদের যথোচিত ভূমিকা নিশ্চিতের গুরুত্ব জোরালোভাবে তুলে ধরা যাবে, ততক্ষণ নীতিনির্ধারকদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে প্রণোদিত/বাধ্য করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। 

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশের সামগ্রিক পরিমণ্ডলে পরিবর্তন ও সংস্কারের যে আবহ তৈরি হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য সেক্টরে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনয়নের একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। দেশের ফার্মেসি পেশাজীবীরা দীর্ঘকাল যাবৎ সরকারি হাসপাতালে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগের জন্য যে দাবি জানিয়ে আসছেন, তা বর্তমান সরকারের সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে আমাদের বিস্তারিতভাবে তুলে ধরতে হবে। এ সমস্যার সঠিক সমাধান নিশ্চিত করতে হলে সিভিল সার্ভিসে চিকিৎসকদের মতো ফার্মাসিস্টদের জন্যও টেকনিক্যাল ক্যাডার সৃষ্টি করা জরুরি।

ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন, সভাপতি, ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত