Ajker Patrika

যে রূপকথার মৃত্যু হয় না

হাসনাত শোয়েব, ঢাকা
আপডেট : ২৭ নভেম্বর ২০২১, ১৮: ০২
যে রূপকথার মৃত্যু হয় না

তাঁর বাঁ পা ইচ্ছে করলে স্তব্ধ করে দিতে পারত গোটা পৃথিবীকে। তাঁর বাঁ পা চাইলেই সৃষ্টি করতে পারত ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ কিংবা ‘নিঃসঙ্গতার ১০০ বছর’-এর মতো অনবদ্য আরেকটি সাহিত্যকর্ম। মিকেলাঞ্জেলোর বিখ্যাত ‘দ্য ক্রিয়েশন অব অ্যাডাম’ ছবির দিকে তাকালেও আপনার মনে পড়তে পারে ডিয়েগো ম্যারাডোনার কথা। ফুটবলে সৃষ্টিশীলতার কথা বললেও আপনার মনে পড়বে তাঁর কথা। তিনি নিছক কোনো খেলোয়াড় ছিলেন না, ছিলেন শিল্পী। অনেকের কাছে ফুটবলশিল্পেরও শেষ নাম ম্যারাডোনা।

৩০ অক্টোবর, ১৯৬০ সালে বুয়েনস এইরেস থেকে যাত্রা শুরু করেছিল ম্যারাডোনা নামক রূপকথাটি। গত বছরের এই দিনে সেটি বিরতি নিয়েছে বটে, তবে খুব দ্রুত থামবে বলে মনে হয় না। এমন রূপকথা এক বছর কেন, হাজার বছরেও যে থামার নয়!

  ম্যারাডোনার ম্যুরালে মাথা রেখে কাঁদছেন এক ভক্তজীবদ্দশাতেই ম্যারাডোনা হয়ে উঠেছিলেন রূপকথার মহান এক চরিত্র। যিনি সব সময় হয়তো নায়ক নন, কিন্তু নায়কের চেয়েও বেশি কিছু। দেখতে তিনি হয়তো রক্তমাংসের সাধারণ মানুষই ছিলেন। তবে মানুষের মাঝে হয়তো একটু বেশিই মানুষ! বেঁচে থাকতেই তাই স্বর্গ-নরক দুটোই একসঙ্গে দেখে গেছেন। মৃত্যুর পরও কি নয়?

ম্যারাডোনা আসলে কেমন, তা জানাতে গিয়ে তাঁর আত্মজীবনী ‘এল ডিয়েগো’র ভূমিকায় মার্সেলা মোরা যা লিখেছেন তা অনেকটা এ রকম—ঈশ্বর থেকে রাজনৈতিক কৌশলী, সন্ত থেকে মাদকসেবনকারী আর ভিলেন থেকে নির্যাতিত সবকিছুই যেন একবিন্দুতে মিলে যায়। ম্যারাডোনা এমনই। ভক্তরা যতই তাঁকে স্বর্গের দূত বানাতে চেয়েছেন, ম্যারাডোনা যেন ততই চেয়েছেন নিজেকে রক্তমাংসের একজন হিসেবে দেখাতে।

ডিয়েগো ম্যারাডোনাসাধারণ কোনো বাক্যে বা বিশেষণে মানুষ ম্যারাডোনাকে হয়তো আটকানো যায় না। এই ম্যারাডোনা যেন প্রশংসা ও নিন্দার মাঝে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে ঝুলতে থাকা ধাঁধা। তবে ফুটবলার ম্যারাডোনা প্রশ্নাতীত এক ভালোবাসার নাম। তাঁর পা শিল্পের অপর নাম। আর হাত হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের হাতিয়ার। ফকল্যান্ড যুদ্ধের প্রতিশোধ নিতেই তো ম্যারাডোনার হাত হয়ে উঠেছিল ‘হ্যান্ড অব গড’! তবে তাঁর ওপর আরোপিত এই ঐশ্বরিক মর্যাদার ভার সামলাতে ম্যারাডোনা প্রতিনিয়ত হিমশিম খেয়েছেন। তাল হারিয়ে শিরোনাম হয়েছেন অসংখ্য নেতিবাচক খবরের। কিন্তু এসব কি আর মানুষের ভালোবাসাকে রুখতে পারে? বুয়েনস এইরেসের সীমানা ছাড়িয়ে নেপলসের দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছিলেন তিনি। নেপলসে নেমেই ম্যারাডোনা তাই বলতে পেরেছিলেন, ‘আমি নেপলসের দরিদ্র শিশুদের আদর্শ হতে চাই। কারণ, তারা আমার মতোই। বুয়েনস এইরেসে ছোটবেলায় আমি এমনই ছিলাম।’

অথচ ম্যারাডোনার আগে নাপোলিকে ‘না’ করে দিয়েছিলেন ইতালির কিংবদন্তি তারকা পাওলো রসি। কারণ একটাই, নেপলসে মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য। আত্মজীবনীতে ম্যারাডোনা লিখেছিলেন, ‘সত্যি কথা হচ্ছে, আমি আসার আগে কেউ নেপলসে আসতে চাইত না।’ নেপলসের সঙ্গে ম্যারাডোনার সম্পর্ক নিয়ে সত্য, অর্ধ-সত্য ও মিথ্যা অনেক গল্প আছে। কথিত আছে, একবার নাপোলির জয়ের পর রাস্তায় নেমে হই-হুল্লোড় করছিলেন ম্যারাডোনা ও তাঁর সতীর্থরা। এক বৃদ্ধা লাঠি হাতে রাগ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এরা কোন শয়তান!’ ম্যারাডোনার পাল্টা জবাব, ‘আমি ডিয়েগো, নেপলসের রাজা!’ বৃদ্ধা চিনতে পেরে আদর করে বলেন, ‘আরে সত্যিই তো, এ আমাদের রাজাই দেখছি।’

ম্যারাডোনার মাটির মূর্তি হাতে নেপলসের কারুশিল্পের বাজারে এক ভক্ত।মৃত্যুর এক বছর পর ম্যারাডোনাকে শ্রদ্ধা জানাতে নেপলসে আসা ফাকুন্দো পেরেজ নামের এক আর্জেন্টাইন বললেন, ‘আমার কাছে ডিয়েগো হচ্ছেন ঈশ্বর! এখানে এসেছি মানুষ তাঁকে কতটা ভালোবাসে, তা দেখতে।’

ম্যারাডোনা নামের রূপকথাটি চূড়ান্ত উৎকর্ষতা ছুঁয়েছিল ১৯৮৬ বিশ্বকাপে। প্রায় একক নৈপুণ্যে মাঝারি মানের একটি দলকে তিনি বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিলেন। সেই বিশ্বকাপে তিনি একাই জন্ম দিয়েছিলেন ইতিহাস গড়া একাধিক মুহূর্তের। এমনকি ডোপ পাপে ১৯৯৪ বিশ্বকাপ থেকে ম্যারাডোনা ছিটকে যাওয়ার পর বাংলাদেশেই আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন অনেক সমর্থক।

ম্যারাডোনার মৃত্যুর এক বছর পরও থামেনি তাঁকে নিয়ে চলতে থাকা এই সব গল্পগাথা। তাঁর মৃত্যু স্বাভাবিক কি না, সে প্রশ্ন যেমন উঠেছে, তেমনি তাঁর বিরুদ্ধে উঠেছে ধর্ষণের মতো গুরুতর অভিযোগও। মৃত্যুর পরও বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না তাঁকে। তবে এসব বিতর্কের গা ঘেঁষে ফুটবলের মহান এক শিল্পী হয়ে অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন এই জাদুকর। যে জাদুকর মর্ত্যলোক ছেড়ে যাননি, সে রূপকথার কোনো মৃত্যু হয় না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

শেখ মুজিবকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ছাত্রদল নেতার পোস্ট, শোকজ পেয়ে নিলেন অব্যাহতি

আলাস্কা বৈঠকে পুতিনের দেহরক্ষীর হাতে ‘মলমূত্রবাহী স্যুটকেস’ কেন

সিলেটের ডিসি হলেন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে শাস্তি পাওয়া সারওয়ার আলম

অপারেশন সিঁদুরে নিহত প্রায় দেড় শ সেনার তালিকা প্রকাশ করে মুছে ফেলল পাকিস্তানি টিভি

আমরা দখল করি লঞ্চঘাট-বাসস্ট্যান্ড, জামায়াত করে বিশ্ববিদ্যালয়: আলতাফ হোসেন চৌধুরী

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত