Ajker Patrika

কোনটি সংস্কার বেশি জরুরি

আমীন আল রশীদ
কোনটি সংস্কার বেশি জরুরি

সরকারি চাকরিতে কোটা ইস্যুতে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের আলোকে ৯৩ শতাংশ উন্মুক্ত রেখে বাকি ৭ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও অন্যদের জন্য সংরক্ষণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার।

এটি কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলা শিক্ষার্থীদের একটি বিজয়, এতে সন্দেহ নেই। যদিও অত্যন্ত ন্যায্য দাবিতে গড়ে তোলা আন্দোলনটি শেষ পর্যন্ত সহিংসতায় রূপ নিল এবং অসংখ্য মানুষের প্রাণ গেল। অনেকে এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যও রয়েছেন।

যে প্রশ্নটি সম্ভবত সবাই এড়িয়ে যাচ্ছেন বা করছেন না, সেটি হলো—১৮ কোটি লোকের দেশের চাকরির বাজারে সরকারি চাকরির অংশ কতটুকু? যদি সরকারি চাকরিতে ১ শতাংশও কোটা না থাকে, তারপরও কোটা সংস্কারের দাবিতে যাঁরা আন্দোলন করলেন, তাঁদের সবার পক্ষে সরকারি চাকরি পাওয়া সম্ভব নয়। দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, সরকারি চাকরি পেতে শিক্ষিত তরুণদের এত আগ্রহ কেন?

বেসরকারি চাকরির বাজার ছোট এবং সেখানে নিশ্চয়তা নেই বলে, নাকি সরকারি চাকরি করে ঘুষ-অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে রাতারাতি ধনী হওয়া যায় বলে? যদি সরকারি চাকরিতে ঘুষ খাওয়ার সুযোগ না থাকে, কতজন শিক্ষিত তরুণ সরকারি চাকরি করতে চাইবেন? তৃতীয় প্রশ্ন, সরকারি চাকরি পেলে সারা জীবন দেশপ্রেম ও সততা বজায় রেখে চাকরি করবেন, ঘুষ খাবেন না, সেবাগ্রহীতা নাগরিকদের হাসিমুখে তাঁর কাজটি করে দেবেন, মানুষের কাছ থেকে ‘স্যার’ শব্দটি শোনার জন্য লালায়িত থাকবেন না, বেতন-ভাতা ও অন্যান্য বৈধ উপার্জনের বাইরে কায়দা-কানুন করে নানাবিধ সুবিধা গ্রহণ করবেন না—এমন প্রতিশ্রুতি কতজন দিতে রাজি আছেন? অর্থাৎ আন্দোলনে শুধু সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নয়; বরং এর সঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারের দাবিটিও যদি তরুণেরা তুলতেন, সেটি দেশের জন্য মঙ্গল হতো।

কোটা সংস্কারের দাবিতে যখন এই আন্দোলন চলছিল, তখন গণমাধ্যমে দারুণভাবে আলোচিত হয় দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া সরকারি কর্মচারীদের ভয়াবহ দুর্নীতির খবর। গত ১৪ জুলাই সাম্প্রতিক চীন সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, তাঁর বাসায় কাজ করতেন এমন একজন ব্যক্তিগত সহকারীও এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক; হেলিকপ্টার ছাড়া চলেন না। জাহাঙ্গীর আলম নামে তাঁর ওই সাবেক কর্মচারী এই সংবাদ সম্মেলনের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।

জাহাঙ্গীর আলমের আগে গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় সবচেয়ে আলোচিত নামটি ছিল আবেদ আলী—সরকারি কর্ম কমিশনের সাবেক গাড়িচালক; বিসিএসসহ বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে যিনি সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। পুলিশ এরই মধ্যে তাঁকে এবং এই চক্রের আরও অনেককে গ্রেপ্তার করেছে।

আবেদ আলীর আগে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল বিত্তবৈভব গড়ে তোলার মাধ্যমে যাঁরা সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমান প্রমুখ।

যখন এভাবে একের পর এক নাম আসছিল, তখন জনপরিসরে এ প্রশ্নটিও উঠেছিল যে এরপর কার কার নাম আসবে এবং কোন স্তর পর্যন্ত দুর্নীতিবাজদের নাম জানা যাবে? বিশেষ করে যাঁদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সরকারি কর্মচারীরা এভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে শত বা হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে গেলেন—তাঁদের নামগুলোও জানা যাবে কি না? যদিও এরই মধ্যে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে সারা দেশ অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠলে দুর্নীতিবাজদের খবরগুলো আড়াল হয়ে যায়।

প্রশ্ন হলো, যে দেশে গরুর মাংসের কেজি ৮০০ টাকা হয়ে গেলে মানুষের মন খারাপ হয়ে যায়; আলুর কেজি ৫০ টাকা হয়ে গেলে যে দেশের বিরাটসংখ্যক মানুষের দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়; ব্রয়লার মুরগির কেজি ২০০ টাকা হয়ে গেলে যে দেশের অসংখ্য মানুষকে আমিষ নিয়ে চিন্তিত হতে হয়—সেই দেশের সরকারি কর্মচারীরা দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা কামিয়ে ফেলেন; প্যালেস তৈরি করে ফেলেন; রাজধানী ঢাকার গুলশান-বনানী-বারিধারার মতো অভিজাত এলাকায় তিন-চার কোটি টাকা দামের ফ্ল্যাট কেনেন; স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য কোটি টাকার গাড়ি কেনেন; ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও অসহায় মানুষদের জন্য লাখ লাখ টাকা অনুদান দেন—এটা কী করে সম্ভব?

রাষ্ট্রীয় কাঠামোর কোন দুর্বলতার কারণে আবেদ আলীর মতো একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীও শত শত কোটি টাকার মালিক হয়ে যেতে পারেন? রাষ্ট্রীয় কাঠামোর কোন ত্রুটির কারণে একজন আইজিপি, কমিশনার, ডিআইজি, এনবিআর বা কাস্টমস কর্মকর্তা শত বা হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে যেতে পারেন?

তাঁরা কী করে রাষ্ট্রের এত আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিজের, স্ত্রীর ও সন্তানদের নামে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন? তাঁরা কী করে ধরা পড়ার আগেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারেন? কী করে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ হওয়ার আগেই সেখান থেকে সব টাকা সরিয়ে ফেলতে পারেন? গণমাধ্যমের খবর বলছে, দুদকের অনুসন্ধান শুরুর এক দিন আগেই সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের নামে ১১৬টি অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরিয়ে ফেলা হয়। এটা কী করে সম্ভব? তার মানে পুরো প্রক্রিয়ায় যেসব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যুক্ত, তাঁরাও দুর্নীতিবাজদের দ্বারা সুবিধাভোগী?

সুতরাং মূল দাবিটা হওয়া উচিত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার। বিভিন্ন সরকারের আমলে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শুদ্ধাচার চর্চায় সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে বলে শোনা গেছে। কিন্তু দিন শেষে কারা কোন মানদণ্ডে শুদ্ধাচার পুরস্কার পান, তা নিয়েও প্রশ্নের অন্ত নেই। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক না হলে; সেখানে সংস্কার করা না হলে যে তরুণেরা কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করলেন, তাঁরাও চাকরি পেয়ে একেকজন আবেদ আলী, বেনজীর কিংবা মতিউরে পরিণত হবেন।

পরিশেষে, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবির সঙ্গে সরকারও যেহেতু একমত ছিল এবং শিক্ষার্থী ও দেশের মানুষের অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সর্বোচ্চ আদালতও একটি যৌক্তিক ও সময়োপযোগী নির্দেশনা দিয়েছেন, অতএব এখন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার জরুরি। কীভাবে এই সংস্কার করা যাবে, সেটি ভাবতে হবে। সেই ভাবনাটা শিক্ষিত তরুণদের মধ্য থেকেই আসতে পারে। তবে কাজটা করতে হবে সরকারকেই। সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলেই কেবল সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে জনবান্ধব ও দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব।

সাংবাদিক ও লেখক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

‘ভারতে ঢুকে’ পাকিস্তানি সেনাদের গুলি, সীমান্তে সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে

এনবিআর চেয়ারম্যানের কক্ষের সামনে কর্মকর্তাদের অবস্থান

বন্ধুকে ছাত্রলীগ সাজিয়ে পুলিশে দিয়ে তাঁর প্রেমিকাকে ধর্ষণ করলেন ছাত্রদল নেতা

মানিকগঞ্জে রাতের আঁধারে স্থানান্তর করা বিদ্যালয় ভবন পরিদর্শনে কর্মকর্তারা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত